চোখের আয়না মনের জানালা

চোখের আয়না মনের জানালা

দাদি মেজোকে কোলে নিয়ে আমাকে বলল চল নদী দেখে আসি। আমি দাদির শাড়ির আচল ধরে পিছনে পিছনে চললাম। নদীর পাড়ে হিমেল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড় সামান্যই উচু। নদীভাঙ্গন চলছে একেবারে উৎসব করে। মনের হচ্ছে যেন নদীর মনে অনেক অভিমান জমা হয়েছিল। তাই পাড়ের মাটিগুলা অশ্রু হয়ে খসে খসে পড়ছে। আমি একেবারে পাড়ি যেয়ে দাড়াচ্ছি দেখার জন্য কিভাবে পানি এই অসাধ্য সাধন করছে। দাদি বারবারই সাবধান করে দিচ্ছে। প্রথমে নদীর পারে একটা ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে তারপর সেই ফাটল বরারবর মাটির চাইটা একেবারে দুরন্ত কিশোরের ভঙ্গিতে ডিগবাজি দিয়ে নদীতে আছড়ে পড়ছে। এ যেন এক মহা আনন্দের খেলা। একসময় নদীর সাথে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ওতোপোড়তভাবে জড়িয়ে ছিল। নদীই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিত যেভাবে আমাদেরও ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

নদী ভাঙন (ছবিঃ ইন্টারনেট)

নদী ভাঙন (ছবিঃ ইন্টারনেট)

লতীফের ক্যানালে নৌকা বাইচ হচ্ছে। বাড়ির উঠোন থেকেই সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে। একইসাথে তারস্বরে বেজে চলেছে বিভিন্ন ধরণের বাদ্য যন্ত্র। দাদি বললেন চল নৌকা বাইচ দেখে আসি। আমি বললাম চল, আমিতো আসলে মনে মনে সেটাই চাইছিলাম। লতীফের ক্যনালে যেতে হলে মাঝে আরো দুটো পাড়া পড়ে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব হেটে লতীফের খালে পৌছে দেখি বাইচ শুরু হয়ে গেছে। ক্যানালের দুই পাড় লোকে লোকারণ্য, তিল ধারণের জায়গা নেই। ক্যানালে কত রকমের যে নৌকা এবং কি সুন্দর বাহারি সাজে তারা সেজেছে। আর নৌকার কিনার ধরে বসে আছে মানুষ তাদের হাতে রঙিন ছোট ছোট বৈঠা। নৌকার মাঝে একজন বা দুইজন দাঁড়িয়ে তারস্বরে বিভিন্ন শ্লোক বলে মল্লারদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। নৌকার আকারের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে প্রতিযোগিতাটাকে। একে একে বিভিন্ন ধাপ পেড়িয়ে ফাইনালে পুরুষ্কার হিসেবে দেয়া হলোঃ তিন ব্যান্ডের রেডিও, সাইকেল আর অন্য পুরুষ্কারটার কথা আজ আর মনে পড়ছে না।

নৌকা বাইচ (ছবিঃ ইন্টারনেট)

নৌকা বাইচ (ছবিঃ ইন্টারনেট)

গোয়ালদের পাড়ায় এসেছে পদ্মপুরাণ গানের দল থাকবে একসপ্তাহ। এই এক সপ্তাহজুড়ে তারা বিভিন্ন রকমের পালা পরিবেশন করবে। দাদিই আবার আমার বাহন, চলে গেলাম দাদির হাত ধরে। সবাই সাদা ধুতি আর কুর্তা পরে কি সুন্দর করেই না সেজেছে আর তাদের প্রত্যেকের কন্ঠেই কি যাদুমাখা গান। ঐদিন চলছিল বেহুলা লক্ষিন্দরের পালা। একটা সাদা পর্দায় ঘেরা ঘরকে লক্ষিন্দের লোহার বাসর ঘর বানিয়ে অভিনয় চলছে আর তার সাথে চলছে প্রত্যেকের কন্ঠেই যার যার চরিত্র অনুযায়ি বর্ণনা। একটা লাইন এখনও আমার মনে গেথে আছে। “কোন সাপে দংশীল লখাই রে, ও বিধি কি হইলো”। কিভাবে যে সারাটা দিন চলে যেত পালা দেখতে দেখতে। আহা দিনগুলো আরো বড় হলে ভালো হত, আমার মনে শুধু এমন চিন্তায় খেলা করতো।

বেহুলা লক্ষিন্দরের পালা (ছবিঃ ইন্টারনেট)

বেহুলা লক্ষিন্দরের পালা (ছবিঃ ইন্টারনেট)

পাড়ার রাস্তা দিয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে বায়োস্কোপওয়ালা যাচ্ছে। আমি দৌড়ে মায়ের কাছে যেয়ে বললাম দশটা পয়সা দাও বায়োস্কোপ দেখবো। মা তার কাজ ফেলে দিয়ে আমাকে আর মেজোকে দশ দশ বিশটা পয়সা দিয়ে দিল। আমরাতো স্বর্গের চাঁদ হাতে পেলাম। বায়োস্কোপের সামনে যেয়ে দেখি ইতোমধ্যেই পাড়ার বাচ্চারা লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। আমাদের সময় যখন আসলো আমরা দুভাই পাশাপাশই দুটা ছিদ্রতে চোখ রাখলাম। বায়োস্কোপ ছিল আমার শৈশবের সবচেয়ে আশ্চর্য এবং যাদুকরি খেলা। ভিতরে একের পর এক বিভিন্ন রাজরানি দৈত্য দানোর ছবি আসছে আর যাচ্ছে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত সেটা গিলছি। কিন্তু তার চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল আমার কাছে বায়োস্কোপওয়ালার ঘটনা পরম্পরা বর্ণনা করার অতিমানবীয় ক্ষমতা। আমি কখনই বুঝতে পারি নাই কিভাবে এই মানুষটা জানে যে ভিতরে এখন রাজা রানি, এখন দৈত্য দানো। উনাকে তখন ভূলোকের কেউ মনেহত না, মনেহত এই মানুষটা স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে শুধু আমাদেরকে এই আশ্চর্য খেলাটা দেখানোর জন্য।

বায়োস্কোপ (ছবিঃ ইন্টারনেট)

বায়োস্কোপ (ছবিঃ ইন্টারনেট)

বছরের একটা সময়ে একেবারে উৎসব করে বিভিন্ন পেশার মানুষ খেলা দেখাতে আসতো গ্রামগুলোতে। আমার মতে এদের মধ্যে ছিল সবচেয়ে সাহসি ছিলেন “সাপুড়ে”। তার কাঁধের বাকের দুপ্রান্তে দুটো বিশাল আকৃতির ঝুড়ি থাকতো। আর সেই ঝুড়ির মধ্যে থাকতো বিভিন্ন সাইজের বাক্স আর কত রকমের যে পোটলা! পাড়ার কিছু নির্দিষ্ট বাড়ির খোলায় (মুল বাড়ির বাইরে ধান মাড়াই এবং শুকানোর বিশাল জায়গা-যেটা সবসময়ই গোলাকৃতির) যেয়ে উনি বসতেন কারণ সব বাড়িওয়ালা উনাকে বসার অনুমতি দিতেন না। কেমন করে যেন পাড়ার সব বাড়িতে খবর চলে যেত আর পাড়ার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই সেই খোলা দেখতে হাজির হত। এরপর উনি উনার সেই যাদুকরি বিন বের করে বাজানো শুরু করতেন। আর এক একটা বাক্স খুলে এক এক ধরণের সাপ বের করতেন। উনাকে দেখার পরই বুঝলাম সাপের মত বিষধর প্রাণীকেও পোষ মানানো যায়। উনার কাছেই প্রথম এত রকমের সাপ দেখেছিলাম। যেমন-বেহুলা লক্ষিন্দরকে যে সাপে কামড়েছিল, একেবারে সুতার মত সাইজ এবং সেই কারণেই না কি সে লক্ষিন্দের লোহার বাসর ঘরে ঢুঁকে তাকে কামড়াতে পেরেছিল। দু-মুখো সাপ-বছরের ছয় মাস এক মুখ দিয়ে খায়, বাকি ছয় মাস অন্য মুখ দিয়ে খায়। আরো কত রকমের বাহারি এবং বিষাক্ত সাপ ছিল তার সবগুলোর কথা আজ আর মনে পড়ছে না। তবে সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং ভয়ংকর ব্যাপার ছিল তাবিজের ক্ষমতা দেখানোর প্রক্রিয়াটা। উনি উনার জিভটা অনেকখানি বের করে প্রথমে কামড়ে ধরতেন। এরপর একটা বিষধর সাপকে দিয়ে জিভের ঠিক মাঝখানে দংশন করাতেন। এবং হাতের ইশারায় সবাইকে দেখতে বলতেন রক্ত বের হচ্ছে কি না? এরপর উনি উনার একটা পোটলা থেকে বের করতেন সেই মহা ক্ষমতাশালী তাবিজ। এরপর সেই তাবিজ রাখতেন সেই রক্তের মাঝখানে। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত নাই হয়ে যেত। এরপর উনি জিভটা ভিতরে নিয়ে বলতেন এই তাবিজ লাগবে কার কার? এবং উনি নিজেই আবার তার ব্যবহারবিধিও বলে দিতেন। বাহুতে ব্যবহার করতে হলে এক নিয়ম আবার বাড়ি বন্ধনের অন্য নিয়ম। সে গল্প অন্য কোনদিন।

সাপের খেলা (ছবিঃ ইন্টারনেট)

সাপের খেলা (ছবিঃ ইন্টারনেট)

শৈশব, কৈশোর, তারুন্য, যৌবন পার করে এখন জীবন বার্ধ্যকের দিকে ঝুকছে। দেখেছি পৃথিবীর খুব সামান্যই। কিন্তু মনের জানালা দিয়ে চোখের আয়নায় দেখে ফেলেছি এই পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। চোখের আয়নাতে যতদূর সম্ভব দেখছি আর তার চেয়ে বেশি জানছি পৃথিবীর বৈচিত্র সম্বন্ধে। আর মনের মধ্যে সেগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছি যাতে হারিয়ে না যায়। আমরা অনেক কিছু দেখেও মনের দৈন্য দূর করতে পারি না সেদিক দিয়ে আমি ভাগ্যবান আমার মনের দৈন্য সেই শৈশবের দূর হয়ে গেছে প্রকৃতির কোমল স্পর্শে, যার সামান্য কয়েকটার বর্ণনা দিলাম উপরে। তাই বলে নতুন নতুন জায়গা দেখার লোভ যে একেবারে নেই তা না তবে সেটাকে উপভোগ করাটাই আসল ব্যাপার যাতে মনে গেথে থাকে। এখন ডিজিটাল যুগ আমরা সৌন্দর্য দেখার নাম করে বিভিন্ন যায়গায় যায় আর উদরপূর্তি করে খায় আর সে ছবি ফেসবুকে পোস্টাই। আমি বলছি না যে আমরা ফটো তুলবো না কিন্তু সেটা যেন যায়গা দেখার আনন্দকে ম্লান করে না দেয়। তা নাহলে স্মৃতি শুধুই থাকবে ক্যামেরার মেমরিতে মনের মেমরি থাকবে শুন্য।

Md Yaqub Ali

Md Yaqub Ali

আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।


Place your ads here!

Related Articles

সিডনির তুলি ভাবীর বাড়ির ঈদ

ফজলুল বারী: সিডনিবাসী শতাধিক প্রিয় প্রজন্মের জন্যে এবারও ঈদের খাবার রান্না করেছিলেন আলোচিত তুলি ভাবী। অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশুনা করতে আসা এসব

Sri Lankan President Visit to Bangladesh: A New Chapter of Relations

Sri Lankan President Mahinda Rajapakse’s three- day visit to Bangladesh from April 18th is of immense significance in terms of

A Dilruba Shahana Article: Allah Kothay Nei Bolota?

আল্লাহ্ কোথায় নেই বলতো? – দিলরুবা শাহানা এইতো জুলাইয়ের ১৬(২০১০সালে) তারিখের খবর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ার মানুষ

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment