ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসা

ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসা

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব তার বিবেকের গুণে। কারণ অন্যান্য প্রাণীর যেখানে বিবেববোধ নাই সেখানে মানুষ তার বিবেক দিয়ে ভালো মন্দ বিচার করে তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রাখছে। মানুষের বিবেকের মধ্যে ভালো মন্দ দুটাই বিচারের স্বাধীনতা রয়েছে এবং সেখান থেকে কোনটা বেছে নেবে সেটার দায়িত্বও মানুষের। আর বিবেকের তাড়নায়ই মানুষের মধ্যে মানবীয় অনুভুতিগুলোর সমাবেশ ঘটে। সেখানে যেমন আছে ঘৃণা আবার পাশাপাশি আছে ভালোবাসা। যদিও দুইটা অনুভূতি একটা অন্যটার একেবারে বিপরীতমুখী তবুও এই দুইটা অনুভুতিই মানুষের মধ্যে প্রকটভাবে বিদ্যমান। বিশেষকরে আমরা বাংলাদেশিদের মধ্যে এই দুটা অনুভূতির কন্ট্র্যাস্ট খুবই প্রকট।

দীর্ঘ সময়ের উপনিবেশ পার হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের প্রত্যেকটি ক্ষণেই ঘৃণা এবং ভালোবাসার সহাবস্থান দেখতে পাই। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশরা আমাদেরকে হিন্দু এবং মুসলমান দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে তাদের শাসনের যখন ইতি ঘটিয়েছিল তখন খুবই সুক্ষভাবে আমাদের মধ্যে এক ধর্মের লোকেদের প্রতি অন্য ধর্মের লোকদের ঘৃণা তৈরি করে দিয়েছিল। কারণ তাদের শাসনের মূলনীতিই ছিল “ডিভাইড এন্ড রুল”। তাই আমরা খাতা কলমে তাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেলেও আসলে আমরা তাদের রোপিত বিভেদের বীজ নিয়েই এগিয়ে চলেছি। এরপর যখন আবার পাকিস্তানে ভাষার দ্বন্দ্ব শুরু হল তখনও আমরা এক ভাষার লোকের প্রতি অন্য ভাষার লোকের ঘৃণার প্রকাশ দেখতে পাই।

কিন্তু এই ঘৃণার বিপরীতে আমরা ভালোবাসারও অনন্য দৃষ্টান্ত দেখেছি এবং দিনশেষে সবসময় ভালোবাসাই জয়লাভ করেছে। ভারতের স্বাধীনতাকামী নেতা ভগৎ সিং জন্মভূমির প্রতি তার ভালোবাসার জন্য হাসতে হাসতে ফাঁসিতে ঝুলেছেন। এমনই আরো কত স্বাধীনতাকামী শুধুমাত্র দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবেসে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে মায়ের ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে কত ছাত্র নিজেদের প্রাণের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছেন। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদেরা তো কোন কিছুর ভয় না করে শুধুমাত্র দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আবার তাদের প্রতি ভালোবাসায় আমাদের মায়েরা কত কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন। শহীদ আজাদের মা তার ছেলের প্রতি ভালোবাসায় জীবনে আর কোনদিন ভাত মুখে তুলেন নাই কারণ তার ছেলে জীবনের শেষ দিনে তার হাতের ভাত খেতে চেয়ে পাই নাই।

এরপর বাংলাদেশে আমরা যখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একে অপরের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ দেখতে দেখতে হতাশ হয় আবার সেখানেই সাধারণ মানুষের একে অপরের প্রতি ভালোবাসার উদাহরণগুলো দেখে উজ্জীবিত হই। এর বাইরে আছে এক ধর্ম-অন্য ধর্মের, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের, ধনী-গরীবের, উঁচু-নিচুর, ফর্সা-কালোর, সহপাঠি-সহপাঠিনীর, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর, ছলে-মেয়ের এক অপরের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। বিশেষকরে ফেসবুকের কল্যানে এই বহিঃপ্রকাশটা এখন অনেক বড় আকারে প্রকাশ পায় এবং তার প্রভাবও হয় খুবই ভয়ংকর। বাংলাদেশের মত উন্নয়ণশীল দেশে আসলে ফেসবুকের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যতটা না ভালো কাজে ভূমিকা রাখছে তার বেশি খারাপ কাজে উৎসাহ দিচ্ছে। তবুও মাঝেমধ্যে ঘৃণার বিপরীতে যেয়ে ভালোবাসার প্রকাশটা আমাদেরকে আবারো স্বপ্ন দেখায়।

এরপর এই হিংসার প্রকাশ একসময় দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও মাথা গজায়। এই সুদূর অস্ট্রেলিয়াতেও দেখি এর নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। এখানেও একেবারে দেশের মত সবরকমের ঘৃণার প্রকাশ দেখে হতাশ হতে হয়। আর এখানে বাংলাদেশিরা সংখ্যায় কম হওয়াতে সেটা খুব সহজেই সবার কাছে ধরা পড়ে যায়। উপরন্তু এখানে ঘৃণার প্রকাশটা আরো বেশি মাত্রা পায়। দেশিও ঘরানার ঘৃণার বাইরে গিয়ে এখানে যোগ হয় অন্য জাতির, ধর্মের প্রতি বাংলাদেশিদের ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। তবে ভালো দিক হচ্ছে এখানে আইনের কড়াকড়িতে কেউই আসলে একে অন্যের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে না। কিন্তু মনেমনে ঠিকই ঘৃণাটা ধরে রাখে এবং মাঝেমধ্যে দু’একজনের মধ্যে সেটার বহিঃপ্রকাশও দেখা যায়। উন্নত দেশগুলো উন্নতই হয়েছে ঘৃণা বাদ দিয়ে ভালোবাসাটার প্রকাশের মাধ্যমে। নিজে যতই খারাপ অবস্থার মধ্যে থাকুক না কেন মুখের কোণে এক চিলতে হাসি ধরে রেখে অন্যকে শুভেচ্ছা জানানোর অভ্যাসটা আসলেই অনেক বেশি দরকারি।

ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসার প্রকাশটা খুবই জরুরি বর্তমানের এই অশান্ত পৃথিবীতে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি কেউ যখন আপনার প্রতি ঘৃণার প্রকাশ করবে আপনি যদি সাথেসাথেই সেটার উত্তর না দিয়ে একটু ধৈর্য ধরে নিজের মনকে সান্ত্বনা দেন। তাহলে কিছুক্ষণ পরে দেখবেন নিজের কাছেই অনেক ভালো লাগছে। আপনি যদি ঘৃণার বিপরীতে ঘৃণার প্রকাশটা করে ফেলেন তাহলে দেখবেন মনের মধ্যে এক ধরণের অশান্তি কাজ করছে। আপনি কোন কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারছেন না। এমনকি ঘৃণার বিপরীতে আপনার এই ভালোবাসার প্রকাশটা ঘৃণা প্রকাশকারীকেও ছুঁয়ে যেতে পারে এবং তিনিও তার আচরণের জন্য আপনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন। অন্ততপক্ষে আপনি ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসা প্রকাশ করতে নাও পারেন যদি চুপও থাকেন তাহলে দেখবেন ঘৃণা প্রকাশকারী ব্যক্তি একটু হলেও উপলব্ধি করবেন বা আরো বেশি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন। কিন্তু আপনি যদি সাথে সাথেই ঘৃণার বিপরীতে নিজের ঘৃণাটাও প্রকাশ করে ফেলেন তবে দেখবেন ঘৃণা প্রকাশের একটা অসীম লুপ তৈরি হয়ে যাবে। একসময় আপনার এবং আপনার চারপাশের অন্যদিকে ঘৃণা প্রকাশকারী এবং তার চারপাশের সবাই জোটবদ্ধভাবে একে অপরের প্রতি বিষোদ্গার করে চলেছেন। আর ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণা যেহেতু দ্রুত ছড়ায় তাই সেটা ডালপালা গজিয়ে কম সময়েই মহীরুহের আকার নেয়। এর থেকে মুক্তির একটাই উপায় একটু থেমে সময় নিয়ে ভাবা যে ঘৃণার এই প্রকাশে কে কতখানি লাভবান হচ্ছে, তাহলে দেখবেন ঘৃণা প্রকাশের এই মাত্রাটা এমনিতেই স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে।

ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসার প্রকাশটা আমরা কিভাবে চর্চা করতে পারি? আপনি খেয়াল করলে দেখবেন একজন শিশু অন্য শিশুর সাথে অবলীলায় মিশছে, খেলছে, খুনসুটি করছে। সেই অন্য শিশুটা অন্য ভাষার, না অন্য ধর্মের, না অন্য লিংগের, না অন্য রঙের এটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেয়। একজন খেলার সাথী পেয়েছে এই খুশিতেই তারা উদ্বেলিত। তাই আমরা খুবই ছোটবেলা থেকে যদি আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের মধ্যে এই বোধটা তৈরি করে দিতে পারি যে পৃথিবীর সব মানুষই সমান এবং তাদেরকে সম্মান করতে হবে তাহলেই তুমি অন্যের দ্বারা সম্মানিত হবে। তাহলে দেখবেন ওরা যখন বড় হবে তখন ঠিকই এগুলোর চর্চা অব্যাহত রাখবে। কেউ আপনার বাচ্চাকে কোন কাজে সাহায্য করেছে তখনই তাকে শিখিয়ে দিন উপকারিকে ধন্যবাদ দিতে, কোন একটা খেলনা নিয়ে সে এক খেলছে তখনই তাকে শিখিয়ে দিন পাশের বাচ্চাটার সাথে সেটা ভাগাভাগি করে খেলতে দেখবেন ও যখন বড় হবে তখন অন্যের বিপদে এগিয়ে যাবেই যাবে। এমন আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। মর্মকথা হচ্ছে ভালো গুণগুলোর চর্চা শুরু করতে হবে একেবারে শিশুকাল থেকেই। তাহলেই ওরা একে অপরের প্রতি ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসার বোধ নিয়ে বেড়ে উঠবে।

ঘৃণার বিস্তারটা যেহেতু ভালোবাসার চেয়ে দ্রুত গতিতে হয় তাই বর্তমান পৃথিবীতে চারিদিকে ঘৃণার ছড়াছড়ি। এক জাতি অন্য জাতির মানুষকে ঘৃণা করছে, এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করছে, এক দেশের মানুষ অন্য দেশের মানুষকে ঘৃণা করছে, এক মহাদেশের মানুষ অন্য মহাদেশের মানুষকে ঘৃণা করছে। এই সকল ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ থেকে কালে কালে দেশে দেশে যুদ্ধ অশান্তি লেগেই আছে। কিন্তু আমরা কেউই একটু শান্ত হয়ে বসে এর পরিণাম নিয়ে ভাবছি না। আমরা ভুলেই যাচ্ছি যে আমাদের জাতি, দেশ, কাল ভিন্ন হলেও আমরা সবাই একই গ্রহের বাসিন্দা। তাই পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষকে খারাপ বলে অন্য প্রান্তের মানুষের ঘৃণা প্রকাশ করে স্বস্তির ঢেকুর তোলার কোনোই সুযোগ নেই। বিশেষকরে আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে যেখানে সমগ্র পৃথিবীই একটি গ্রাম সেখানে অন্যকে অশান্তিতে রেখে আপনি কখনওই শান্তিতে থাকতে পারবেন না। তাই আসুন আমরা, ভৌগলিক সীমারেখা, কালের ব্যবধান, মানসিকতার ব্যবধান, ধর্মের ব্যবধান, বিশ্বাসের ব্যবধান, মতের ব্যবধান ভুলে একে অপরের প্রতি ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসার প্রকাশ করি তা না পারলে নিদেনপক্ষে আমরা ঘৃণার বিপরীতে একটু চুপ থেকে ঘৃণা প্রকাশকারীকে একটু ভাববার অবকাশ দেই। তাহলেই একদিন পৃথিবীর আকাশে বাতাসে বারুদের, রক্তের গন্ধের পরিবর্তে ফুলের সুবাস, পাখির কুজন শোভা পাবে।

Md Yaqub Ali

Md Yaqub Ali

আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।


Place your ads here!

Related Articles

Why did President Obama receive the Nobel Peace Prize?

President Barack Obama won the Nobel Peace Prize on 9th October in a stunning decision that honored the first-year of

সাহিত্যে নোবেল পেলেন এক ফরাসি লেখক – ওয়াসিম খান পলাশ প্যারিস থেকে

সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন ৬৮ বছর ফরাসি সাহিত্যিক মোসিও জ্যা মারি গুস্তাভ ল্যা ক্লেজিও

হয়ার ডু আই বিলং ?

হয়ার ডু আই বিলং ? ফারিনা মাহমুদ ….. গল্প কাহিনীতে শুনেছি , অপঘাতে মৃত বা আত্মহত্যা করা মানুষের আত্মার নাকি

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment