গরুর লেজ, মহিষের পিঠ
গ্রামের প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত জীবনে যেমন কোন হঠাৎ চমক নেই তেমনি অপর দিকে আছে বিনা পয়সায় অফুরন্ত আনন্দের অনুষঙ্গ। শিশু কিশোরদের জন্য তো গ্রাম একেবারে রুপকথার গল্পের স্বপ্নপুরি। বাড়িতে চিরায়ত বাংলা প্রবাদঃ “বাঙালির গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ” এর সাথে মিল রেখেই ছিল অনেক গরু। আর তাদের দেখভাল করার জন্য একজন মানুষকে প্রতি বছর হিসাবে কামলা রাখা হত। তাঁকে আমরা বলতাম রাখাল। আসলে গ্রামের ছেলেদের প্রায় সবকিছু শেখার শুরুই হয় এই রাখালদের হাত ধরে। আমি প্রথম তাস খেলা থেকে শুরু করে বিড়ি খাওয়া সবকিছুরই তালিম পেয়েছিলাম আমাদের বাসার রাখালদের কাছ থেকে। ঠিক তেমনি অনেক মজার এবং তখন পর্যন্ত সবচেয়ে দুঃসাহসী কিছু আনন্দের ছোয়াও পেয়েছিলাম। বর্ষার শেষের দিকে যখন নদীর পানি কমতে শুরু করতো তখন নদীতে নতুন নতুন চর জেগে উঠতো। যেই জায়গাটাতে আমার জন্ম সহজ হিসাবে বললে দাঁড়ায় পদ্মা নদীর একেবারে মাঝ বরাবর। তাই বর্ষার পর যখন নদীর পানি শুকাতে শুরু করতো তখন আমাদের ভিটেমাটি জাগতে শুরু করতো। সেই জেগে উঠা চরে চাষাবাদ করার জন্য চরে গরু নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়তো। সাধারণতঃ দেখা যেতো নদী শুকিয়ে পাড়ের কাছে একটা খালের মত থাকতো যেটাকে আমরা নদীই বলতাম সেটা পার হতে পারলেই অবারিত চর শুরু হত। আর আমি রাখালদের পিছন কখনই ছাড়তাম না।
আমি ছাড়া সবাই মোটামুটি সাতার পারে। এখন কিভাবে আমি এই নদী পার হব সেটা নিয়ে আমিতো মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের রাখাল ভাই বললেন, কোন সমস্যা নাই। তুমি গরুর লেজ ধরে নদীটা পার হবা। আমি তখনও বুঝি নাই, সে কি বলছে? গরু যখন সাতরে নদী পার হওয়ার জন্য পানিতে নামতে যাচ্ছে রাখাল ভাই আমাকে গরুর লেজটা ধরিয়ে দিলেন। বললেন যাই হোক না কেন, এটা ছাড়বা না। ব্যস! আমি দুই হাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা ধরে রাখলাম। এরপর যে ঘটনাটা ঘটলো আমার জীবনে এখন পর্যন্ত এত্ত ভয়ের এবং রোমাঞ্চকর মূহুর্ত আর আসে নাই। এখনকার ছেলে মেয়েরা “রোলার কোস্টার” এ চড়েও মনে হয় এত্ত আনন্দ পায় না। গরুটা সাতার কেটে নদী পাড় হচ্ছে আর আমিও গরুর সাথে সাথে অবলীলায় নদী পার হয়ে যাচ্ছি। একদিকে ভয়, যদি লেজটা হাত থেকে ছুটে যায়। আর অন্যদিকে এক অদ্ভুত রকমের আনন্দ, আমি সাতার জানি না কিন্তু নদী পার হচ্ছি। অপর পাড়ে পৌছে আমার ভয়টা কেটে গেলো। আবার ফেরার পথেও একইভাবে নদী পার হয়েছিলাম।
গরুর লেজ নিয়ে আরো একটা ঘটনা আমাকে খুবই আনন্দ দিত। কলের লাঙল তখনও আমাদের এলাকায় আসে নাই। সমস্ত চাষাবাদের কাজকর্ম তাই ছিল গরু আর কাঠের লাঙল নির্ভর। প্রথমে লাঙল দিয়ে জমি চাষ দেয়া হত, তারপর কয়েকদিন সেইভাবেই ফেলে রাখা হত। তারপর আগাছা পরিষ্কার করে সেটাতে বীজ বুনে মই দেয়া হত। গরুর জোয়ালের থেকে দড়ি দিয়ে টানা দিয়ে মই ঝুলিয়ে রাখা হত। তারপর সেটার উপর একজন দাঁড়িয়ে যেত। আর তার ওজোনের চাপে জমি আস্তে আস্তে সমান হয়ে যেত। আমি আর আমার শৈশবের একমাত্র খেলার সাথি সকল কুকর্মের জোগানদার আমার ফুপাত ভাই আনোয়ার মাঠে প্রায়ই দেখা যেত আব্বার জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। তো মই দেয়ার সময় যাতে গরুর একটু কম কষ্ট হয় আর আমাদেরও একটু মজা নেয়া হয় তাই আমাদের দুইজনকে দুই গরুর লেজ ধরিয়ে দিয়ে মইয়ের দুপ্রান্তে উঠিয়ে দিতেন। আমরা দুজন আরম করে সারা মাঠ ঐ মইয়ে চড়ে ঘুরে বেড়াতাম অন্যদিকে জমিও সমান হয়ে যেত। এখনকার ছেলেমেয়া গাড়িতে চড়েও মনে হয় না এতটা আনন্দ পায়?
আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে এখন পর্যন্ত যত জন্তু-জানোয়ার দেখেছি মহিষের মত এত শান্ত, নির্বিবাদি এবং পরিশ্রমি প্রাণী আর দ্বিতীয়টি দেখি নাই। আসলে মহিষ হচ্ছে আমাদের দেশের গাধা, হাজার পরিশ্রমেও একটু রা নেই। মহিষকে দিয়ে গ্রামের মানুষজন হেন কাজ নাই যেটা করাতো না। তবে তাদের মুল কাজ ছিল গরুর গাড়ি টানা। আমি এখনও একটা ব্যাপার বুঝি না, গরুর গাড়িকে কেন গরুর গাড়ি বলা হয়। আসলে ঐটার নাম হওয়া উচিৎ মহিষের গাড়ি। যদি কারও মহিষ না থাকতো তখন ছুটা কাজ চালানোর জন্য গরু দিয়ে ঐটা টানানো হত। কিন্তু গরুকে দিয়ে কখনই মহিষের মত এত বেশি মালামাল টানানো সম্ভব হত না। হেমন্তের শেষে নতুন ধান কাঁটা শুরু হলে গাড়োয়ানদের মুখে হাসি ফুটতো। তখন তাদের কাজের ব্যস্ততা শুরু হত পুরোদমে। গাড়ি ভর্তি করে ধান গেরস্থের মাঠ থেকে খোলায় পৌছে দিয়ে ধানের আঁটি হিসাবে এক আটি করে ধান পেত মজুরি হিসাবে। একদিকে ধান কাঁটা হচ্ছে অন্যদিকে গাড়ি এসে হাজির। ধান গাড়িতে বোঝায় হওয়ার ফাঁকে গাড়োয়ান মহিষটাকে ক্ষেতের চারদিকে খাওয়ার জন্য ছেড়ে দিত। তখন আমার আর আনোয়ারের দায়িত্ব হচ্ছে ওদেরকে দেখে রাখা যাতে ক্ষেতে মুখ না দেয়। আমাকে আর ওকে দুই মহিষের পিঠে তুলে দেয়া হত। প্রেথম দিকে একটু ভয় লাগতো কিন্তু পরের দিকে আমরা খুব আগ্রহ নিয়েই কাজটা করতাম। অনেক বেশি মজা লাগতো। আমার মনে হয় না এখনকার ছেলেমেয়েরা “ম্যাজিক কার্পেটে” চড়েও এত্ত আনন্দ পায়। গাড়ি বোঝায় হয়ে গেলে বাড়ি ফেরার পথে আমরা কখনও গাড়োয়ানের সামনে আবার কখনও গাড়ির ধানের গাদার উপরে চড়ে বাড়ি ফিরতাম। গরুর গাড়ির একঘেয়ে “ক্যা-কু” শব্দ আর দুলুনি সে এক স্বর্গিয় অনুভুতি।
গরুর গাড়ি আরো একটা সময় একেবারে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যাবহার করা হত। সেটা হল বিয়ের সময়। কেউ বিয়ে করতে যাবে গাড়ির উপর একটা অর্ধ-বৃত্তাকার চাটাইয়ের ছাউনি দিয়ে সেটাকে হরেক বর্ণের রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো হত। এমনকি মহিষের শিং পর্যন্তও বাদ পড়তো না। সবাই হেটে হেটে যাবে আর বর, ছোট বাচ্চা-কাচ্চা আর মহিলা বরযাত্রিরা যাবে গাড়িতে। তারপর বিয়ে শেষে বর-বউ, বাচ্চা-কাচ্চা আর মহিলারা ফিরতো গাড়িতে করে। তবে গ্রামে একটা মজার ব্যাপার ছিল সেটা হল যেই বিয়ে করে ফিরুক না কেন। বিভিন্ন পাড়ার মানুষরা রাস্তায় রাস্তায় বিশাল বিশাল বাশ দিয়ে ব্যারিকেড দিত। তাদেরকে বখশিস না দিলে তারা রাস্তা ছাড়তো না। এবং তাদেরকে বখশিস দিয়ে খুশি করে বর নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতো।
এছাড়াও নতুন বউ তার বাপের বাড়িতে ফেরৎ যেত এই গরু গাড়িতে করে। আর একটু অবস্থাসম্পন্নরা কখনই তাদের বাড়ির বউকে গাড়ি ছাড়া বাপের বাড়িতে পাঠাতো না। সেই অর্ধ-বৃত্তাকার ছাঊনির আগে-পিছে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হত যাতে কোনভাবেই তাদেরকে দেখা না যায়। গেলেই সর্বনাশ, পরিবারের মান-সম্মান সব ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। আমি বেশ কয়েকবার আমার মায়ের সাথে নানি-বাড়ি যাওয়ার সময় এভাবে গরুর গাড়িতে করে গেছি।
সময় কত দ্রুত বদলায়। কাঠের লাঙলের জায়গা দখল করে নিয়েছে কালো ধোয়া উদগিরনকারী কলের লাঙল আর গরুর গাড়ির জায়গা দখন করে নিয়েছে নছিমন-করিমন আর ভটভটি। এবং তারা প্রায়শই পত্রিকার শিরোনামও হয় মানুষ মারার যন্ত্র হিসাবে। প্রযুক্তি আমাদেরকে যেমন এগিয়ে দিচ্ছে ঠিক তেমনি আমাদের পরিবেশকেও করছে দুষিত আর আমাদেরকে করছে অলস ও অকর্মণ্য। এখন আর ছেলেমেয়েরা কোন কিছুতেই সহজেই মজা পায় না, কারণ আকাশ সংস্কৃতি তাদেরকে আগেই জানিয়ে দিচ্ছে কোথায় কি ঘটছে। তাদের মস্তিষ্ক আর এখন আগের মত দ্রুত কাজ করে না। বয়সের চেয়ে তাদের চশমার পাওয়ারের সংখাটা বড়।
Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
Bangladesh, China India at the Climate Summit at the UN
The UN climate summit was held on 23rd September which was the largest high-level climate meeting since 2009. Hosted by
Udichi’r Shuborno Joyonti – Shampa Barua with Kamrul Ahsan Khan
Bangladesh Udichi Shilpigosthi is a leading progressive cultural organization in Bangladesh. The organisation’s goal is the struggle to build what
Quarantiny – Chapter 8 – Day 9
Day 9Saturday 25 April 2020 “Learning new minimalistic ways of beingnot merely looking, but really seeing” ANZAC Day morning in