ক্রিকেট, বল টেম্পারিং এবং ইত্যাদি

ক্রিকেট, বল টেম্পারিং এবং ইত্যাদি

এক
‘৭০ দশক পর্যন্ত ক্রিকেট ছিল তথাকথিত অভিজাত পরিবার এবং সামান্য সংখ্যক মানুষের খেলা। কেউ ক্রিকেটের অতো খোঁজ খবরও রাখতো না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তখন মাত্র ছয়টি দেশ- অস্ট্রেলিয়া ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ (অনেকগুলো দেশ মিলে) নিজেদের মধ্যে টেস্ট খেলতো। অনেক পরে শ্রীলঙ্কা এই গ্রুপে যোগ দেয়। বর্ণবাদী আচরণের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে বিতাড়িত ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক বছর নির্বাসন কাটিয়ে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কেপলার উইসেলস এর নেতৃত্বে ফেরত আসে। কেপলার উইসেলস অস্ট্রেলিয়ার হয়েও খেলেছিল।

দুই
আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত বা প্রতিপক্ষের প্লেয়ারের সাথে বনিবনা বা তর্ক হলে, মাঠেই তার সমাধান হয়ে যেত; আম্পায়ার দুইজনকে ডেকে দোস্তি পাতিয়ে দিতেন। ICC কে তেমন কিছুই করতে হতো না। ICC ছিল অনেকটা পাড়ার মুরুব্বির মতো। বাঙালির ভাষায় পাড়ার বড় ভাই, কোন মারামারি বা সমস্যা হলে সবাই উনার পরামর্শ নেয়, কথা শুনে- ওই পর্যন্তই। কেউ কেউ আড়ালে অসন্তুষ্ট হলেও প্রকাশ্যে কিছু বলতো না।

তিন
সত্তুরের আগে এবং আশির দশকের সামান্য সময় ক্রিকেট এই ভাবেই এগিয়েছে। ক্রিকেট প্রেমীরা সেই সময়ের ঘটনাবলী পড়ে অবাক হবেন যে তখনও অনেক প্লেয়ার ‘দুষ্ট’ ছিল। আম্পায়ার LBW এর আবেদনে সাড়া না দেয়ায় ডেনিস লিলির স্টাম্পে লাথি দেয়ার, বা আম্পায়ারের কলার ধরতে উদ্ধত ছবি গুগল করলে এখনো পাবেন। আউট হবার পর ব্যাট ছুড়ে মারাতো সেদিনের ব্যাপার। বিখ্যাত ক্রিকেট আম্পায়ার ডিকি বার্ড অস্ট্রেলিয়ান বোলার মার্ভ হিউজকে প্রতিবারই মনে করিয়ে দিতেন, “Boy, don’t be naughty”. কারণ বল হাতে মার্ভ হিউজ যখন ডিকি বার্ডকে অতিক্রম করতো তখন ডিকি বার্ড শুনতে পেতেন যে মার্ভ অকথ্য ভাষায় ব্যাটসম্যানকে গালাগালি করছে। ইমরান খান নাকি তার পকেটে কোকাকোলা বোতলের শক্ত এলুমিনিয়াম তৈরী ছিপি (উর্দু এবং হিন্দিতে ডিব্র্রি, বাংলায় মুখ্যা বলতাম) রাখতো; সুবিধা মতো তা দিয়ে বলের এক পাশে আঁচড় কেটে বলের মসৃণতা নষ্ট করতো। ইমরান এইসব ইংল্যান্ডে থাকতেই শিখেছিল। ময়লা পরিষ্কারের অজুহাতে নখ বা দাঁত দিয়ে বলের মসৃণতা নষ্ট করা এই সেদিনও আমরা দেখেছি। কিন্তু আম্পায়ার বা।CC র তেমন কোনো ক্ষমতা ছিল না। সবাই এইসব মেনে নিয়েই সব দল খেলেছে। পেশাদারি ব্যাপারটা তেমন জমজমাট হয়ে উঠেনি।

চার
ক্রিকেট বল টেম্পারিং বা তার মসৃণতা নষ্ট করলে কি হয়? বোলার কি ভাবে তা থেকে অন্যায্য সুবিধা পেয়ে থাকে? ব্যাপারটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কম্পিউটার সিমুলেশনের সাহায্যে বুঝানো যত সহজ, লিখে বুঝানো ঠিক ততটা কঠিন। পদার্থ বিজ্ঞানের aerodynamics আমার বিষয় না, তবে বিষয়টাকে একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যেতে পারে। আপনি দুইটা টেবিল টেনিস বল- একটা মসৃন অন্যটা সামান্য এবড়ো থেবড়ো, একই দূরত্ম থেকে একটা বস্তুকে একই বেগে টার্গেট করে ছুড়েন। দেখবেন মসৃন বলটা যতটা সরল রেখাকারে টার্গেটের কাছে পৌঁছেছে, এবড়ো থেবড়ো বলটা টার্গেটের কাছে সামান্য বিলম্বে পৌঁছেছে, তাও আবার অল্প বাঁক নিয়ে। কারণ কি? মসৃন বল বাতাসকে একই ভাবে ভেদ করে টার্গেটে পৌঁছেছে, বাতাস কোথাও আটকে যায় নাই। অন্যদিকে, এবড়ো থেবড়ো বলটার ভাজে বাতাস বাধাগ্রস্থ হয়েছে, অর্থাৎ বলটা যে গতিতে এবং যে রেখাপথে যাবার কথা সে ভাবে না গিয়ে সামান্য পরিবর্তিত হয়ে টার্গেটে পৌঁছেছে।

[caption।d=”attachment_12192″ align=”alignnone” width=”416″]নতুন এবং পুরাতন বলের সুইং নতুন এবং পুরাতন বলের সুইং[/caption] [caption।d=”attachment_12193″ align=”alignnone” width=”673″]রিভার্স সুইং এর প্রক্রিয়া রিভার্স সুইং এর প্রক্রিয়া[/caption] [caption।d=”attachment_12194″ align=”alignnone” width=”437″]গতানুগতিক বা কনভেন্সনাল সুইং গতানুগতিক বা কনভেন্সনাল সুইং[/caption] [caption।d=”attachment_12195″ align=”alignnone” width=”500″]রিভার্স বা ব্যাতিক্রম সুইং রিভার্স বা ব্যাতিক্রম সুইং[/caption]

পাঁচ
শক্ত পীচে ১৪০ কিমি বেগে আছড়ে পড়ে এবং ব্যাটের বাড়ি খেয়ে ক্রিকেট বল তার মসৃণতা হারাতে থাকে। প্রথম বিশ পঁচিশ ওভার বলের গতি বাড়াতে বোলার এবং ফিল্ডাররা বলের দুই পাশই প্যান্টে ঘষে চক চকে রাখে। কিন্তু বল একটু পুরানো হলে উপরের উপপাদ্য মেনে বোলার এবং অন্য ফিল্ডাররা সুযোগ পেলেই বলের এক পাশকেই শুধু মসৃন রাখার চেষ্টা করে, আর সেলাইয়ের অন্য এক পাশ ঠিক ততোধিক এবড়ো থেবড়ো বা অমসৃণ করতে চেষ্টা করে। বোলার তার গ্রিপও বদল করে খসখসে পাশকে নীচের দিকে রাখে। আবার কখনও সেলাইয়ের উপর আড়া আড়ি করেও ধরে। ফলে প্রায়শই দেখা যায় ব্যাটসম্যান যে গতিতে এবং যে রেখা বা লাইনে বল আশা করেছিল, তা না হয়ে দেখা যায় যে বল সামান্য (কয়েক পলক মাত্র) পরে এবং কাঙ্খিত লাইনে না এসে এক বা দুই ডিগ্রি বেঁকে গেছে। তাই দেখা যায় ব্যাটসম্যান বলকে ব্যাটের মাঝ দিয়ে আঘাত করতে ব্যাট বাড়িয়ে দিলেও বল ব্যাটের মাঝ বরাবর না এসে ব্যাটের কানায় লেগে ক্যাচ উঠে যায়, বা পেছনের ফার্নিচার ভেঙে দেয়। ব্যাটসম্যান বোকার মতো চেয়ে থাকে, বলতো সোজাই আসছিলো, শেষ মুহূর্তে এসে বাঁক নিচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাটসম্যানের কিছু করার নেই, দেরি হয়ে গেছে। কথা হচ্ছে তাহলে প্রতি বলেই বোলার উইকেট পায় না কেন? মাঠে বাতাসের বেগ এবং গতিপথ, বাতাসের আদ্রতা, বোলারের টার্গেট, গ্রিপ, আঙুলের ব্যবহার, বল ছাড়বার angle, উচ্চতা ও বাউন্স করার দৈর্ঘ্য- সব কিছু মিলিয়ে প্রতিটা ডেলিভারি একই রকম দেয়া বোলিং মেশিন দিয়েও সম্ভব না। কেউ কেউ অনেক বেশিবার একই ধরণের বল করতে পারতো, যেমন ওয়াসিম আকরাম। কি করে সম্ভব তা ওয়াসিমই বলতে পারবেন। তবে সেখানে অনেক মেধা খাটাতে হয়; আর কেউ কেউ ‘গিফটেড’- যার সঠিক কোন ব্যাখ্যা নেই। যেমন আমাদের মুস্তাফিজের অফ কাটার- টেকনিক্যালি নট অফ দ্যা সিম না হয়ে তার গ্রিপ, তারপ পীচ থেকে হচ্ছে… ক্যামনে- তা ওকেই জিজ্ঞাসা করেন। তবে কিছু ব্যাপার মিসট্রি থাকাই ভালো।

ছয়
২০০৫ এর এশেজ এ দেখা গেল ইংল্যান্ডের সাইমন জোন্স হটাত করেই নতুন, অর্থাৎ পনের-বিশ ওভার পরেই রিভার্স সুইং পাচ্ছে। ইংল্যান্ডের সবুজ পীচে বল পুরানো হতে সময়ও বেশি লাগে, তারপরেও সাইমন জোন্স ঝক ঝকে বলে সবুজ পীচে রিভার্স কি ভাবে পায়? অনেকের ধারনা, সাইমন জোন্স বলের একপাশে অতিরিক্ত লালা, ঘাম ব্যাবহার করে বলের ওই পাশকে ধীরে ধীরে বেশি ভারি করে তুলত ফলে বল প্রায় শেষ সময়ে সুইং করত। কথা হল সাইমন জোন্স এতো লালা পেত কোত্থেকে? দেখা গেছে সে অনেক বেশি নতুন চুইং গাম চিবুত, ফলে মুখে লালা বেশি তৈরি হতো। আপেলের মত কামড়ে মাথা মোটা আফ্রিদিকে বলের আকৃতি বদল করতে এই সেদিনও আমরা দেখলাম। তবে শিরিশ কাগজের ব্যাবহার এই প্রথম দেখলাম। অধিকাংশ সময়ে বোলাররা এই সবই করে ডেস্পারেশন এবং হতাশা থেকে।

সাত
পুরানো কথায় ফিরে আসি। ক্রিকেট এবং ICC এভাবেই চলছিল। ১৯৭৭ এ অস্ট্রেলিয়ার চ্যানেল নাইন এর মালিক ক্যারি পেকার ABC টেলিভিশনের কাছে ক্রিকেট সম্প্রচারসত্ম খোয়ানোর পর সব কিছু উল্টে যায়। ICC র সাথে পাল্লা দিয়ে World Series নামে নতুন ধরনের সীমিত ওভারের ক্রিকেট শুরু করে। পৃথিবীর নামি দামি ক্রিকেটারদের অনেক অনেক বেশি অর্থ দিয়ে ক্যারি পেকার তার ওয়ার্ল্ড সিরিজের জন্য চুক্তি বদ্ধ করে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এবং ICC র নিষেধাজ্ঞা এবং হুমকি উপেক্ষা করে অনেক দেশের ক্রিকেটার নিজ দেশকে উপেক্ষা করে ক্যারি পেকারের সাথে চলে আসে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তার কোন মাঠ ক্যারি পেকারকে দিতে না চাইলে ক্যারি পেকার স্থানীয় মাঠগুলোতে খেলার আয়োজন করে। ক্যারি পেকারের নিজস্ব কিউরেটর ড্রপ-ইন (গ্রিন হাউজে পীচ বানিয়ে বড় ট্রাকে করে নিয়ে মাঠে বসিয়ে দিত) পীচ প্রস্তুত করে খুব কম সময়ে খেলার উপযোগী মাঠ তৈরি করে ফেলে। ক্রিকেটারদের জন্য রঙ্গিন পোশাক, বিজ্ঞাপন, টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার- সব কিছু মিলিয়ে এক বিশাল বানিজ্য এবং রাজস্ব। নিউ সাউথ ওয়েলস সরকার তার নিজের রাজস্ব এবং রাজনীতি বুঝে।CC এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাথে ‘বেইমানি’ করে সিডনি ক্রিকেট মাঠে ক্যারি পেকারকে তার ওয়ার্ল্ড সিরিজের খেলা চালানোর অনুমতি দেয়, যা পরে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াও মেনে নেয়।।CC খুব লজ্জায় পড়ে কারণ they (ICC) have been sold so cheaply. ক্যারি পেকার ধীরে ধীরে পুরো ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এবং সম্প্রচার সত্ব নিজের অধীনে নিয়ে নেয়, যা এখনো অব্যাহত আছে। সেই সাথে ক্রিকেট এবং ক্রিকেটাররা গভীর বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে গেলো। দেশের ক্রিকেট বোর্ড গুলোও হয়ে গেলো বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।।CCও।f you can’t beat them, join them এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে এখন ক্রিকেট জগতের মোড়ল হয়ে গেলো। এখন ক্রিকেট মানে বিনোদন, বাণিজ্য এবং তীব্র প্রতিযোগিতা- ব্যক্তিতে, দলে, দেশে। যত ভালো পারফর্মেন্স, ততো বেশি তারকা খ্যাতি ও বিজ্ঞাপন। আর এখন তো।PL BPL DBL আরো কত কিছু। ক্রিকেট খেলে না যত আয়, বিজ্ঞাপন থেকে তার চেয়ে বেশি আয়। এই আয় থেকে ক্রিকেট বোর্ডও ভাগ পায়।
আট
এইসব কিছু ক্রিকেটারদের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে নিজেদের পারফর্মেন্সের জন্য অনেকেই অন্যায্য সুবিধা নিতেও পিছ পা হয় না। ভালো পারফর্মেন্স মানেই আরো খ্যাতি, আরো অর্থ। কিন্তু অনেকেরই মনে থাকে না টঙ্কাই কেবলুম।

এই প্রবণতা শুধু ক্রিকেটেই নয়, সব খেলাধুলায়। তবে কি খেলাধুলার স্পিরিট হারিয়ে গেলো?

যারা রিভার্স সুইং এবং গতানুগতিক সুইং এর উপর বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়তে পারেন। http://www.espncricinfo.com/
ছবিঃ https://www.google.com.au/search?q=picture+of+cricket+ball+and+aerodynamics&safe

তারিক জামান


Place your ads here!

Related Articles

প্রথম সাফল্য মুস্তাফিজের হাত ধরে

ফজলুল বারী, ক্রাইস্টচার্চ থেকে: নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ দলের প্রথম সাফল্যও এলো মুস্তাফিজের হাত ধরে। নিজের ওভারে তার শিকার হন কিউই দলের

Amendment of the Bangladesh Constitution

Following the August 29, 2005 High Court verdict that declared the fifth constitutional amendment illegal, the Appellate Division of the

Let us usher in New Year 2010: A Year of Hope Expectation!

In ancient days, there was no New Year. They used to say ‘in the tenth year of the reign of

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment