আগে দর্শণধারী পরে গুণবিচারি

আগে দর্শণধারী পরে গুণবিচারি

এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে আকার এবং বর্ণের এত বৈচিত্র যা পৃথিবীর অন্য কোথাও মনেহয় দেখা যায় না। এর জন্য অবশ্য এর উর্বর মাটিই দায়ি। সময়ের স্রোতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে তার টানে টেনে এনেছে। যার ফলশ্রুতিতে মানুষে মানুষে এত বৈচিত্র তৈরি হয়েছে সেই সাথে ভেদাভেদও দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেহেতু ইউরোপিয়ানরা প্রভুর জাত ছিলো এবং তাদের ছিলো সাদা চামড়া তাই যাদের সাদা চামড়া তাদের কদর অবধারিতভাবেই বেড়ে গেলো। আর অন্য রঙের মানুষগুলো তখন অবজ্ঞার পাত্র হতে শুরু করলো। যার ফলে মানুষের মধ্যে প্রভুর জাতে উঠার একটা অলিখিত প্রতিযোগীতা তৈরি হলো এবং বিভিন্ন উপায় তৈরি হলো। যার সর্বশেষ সংস্করণ বিভিন্ন ফেয়ারনেস ক্রীমের রমরমা ব্যাবসা। ইউনিলিভার শুধুমাত্র “ফেয়ার এন্ড লাভলী” বেচে যে পরিমান লাভ করে অন্য সব প্রোডাক্ট বেচেও না কি তত লাভ হয় না। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ? সে যাই হোক আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু মোটেও কিন্তু মানুষের গায়ের রঙ নয়। রঙ বিচারের এই অদ্ভুত অস্বাভিক মানসিক বিকার নিয়ে আজকের এই লেখা। ঢাকা শহরের প্রায় সব লোকই মফস্বলের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে এইখানে খুটি গেড়ে বসবাস শুরু করেছে কারণ এখানে পেটের পুজি সহজে জোটানো যায় এবং প্রত্যেকেরই পূর্বপুরুষ অবশ্যই কোন না কোন জন্মে কৃষক ছিলো। তাই ধান-চাল, গম-আটা, শাক-সব্জি, ফল-মুল নিয়ে প্রত্যেকেরই বেসিক ধারণাটা আছে অবশ্যই।


কিন্তু মজার ব্যাপারটা হচ্ছে এরা যখনই বাজারে কোন কিছু কিনতে যায় তখনই তারা তাদের বইয়ে দেখা রঙের জিনিসপত্র খোজা শুরু করে যদিও বইয়ের লেখাটা পড়ার ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহ দেখা যায় না। সে যাই হোক প্রাকৃতিক রঙ আর বইয়ের কৃত্রিম রঙতো কখনই এক হবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেহেতু মানুষ বেশি টাকা খরচ করে কৃত্রিম রঙের জিনিশটাই কিনছে তাই শুরু হয়ে গেলো ঐগুলোতে কৃত্রিম রঙের আর তরতাজা রাখার জন্য বিভিন্ন কেমিকেলের ব্যাবহার। বিশেষ করে আম-কলা-লিচু-তরমুজ এর ক্ষেত্রে রঙের ব্যবহার এমন এক শৈল্পিক মাত্রা পেয়েছে যে তাদের প্রকৃত রঙের কথা মানুষ বেমালুম ভুলে বসে আছে। প্রথমে আসি আমের কথায়। আম পাকলে কখনই সোনালি আকার ধারণ করে না। আমের রং সবুজই থেকে যায় তাতে লাগে একটু সোনালি আভা, পুরো আমের গায়ের রং কখনই হলুদ হয় না। কিন্তু যেহেতু মানুষ বেশি টাকা খরচ করে ঐ কার্বাইড দেয়া ক্ষতিকর সোনালি, হলুদ আমটাই কিনছে তাই রং মেশালে বরং বেশি লাভ। টিভিতে একটি অনুষ্ঠানে এক ফল ব্যবসায়ীকে আনা হয়েছিলো, ভদ্রলোক পর্দার আড়াল থেলে যে কথাগুলো বলেছিলেন সে কথাগুলো আজও আমার মনে বাজেঃ “ছেলের বিয়ে দিতে গেলে যেমন আপনারা যেমন উজ্জ্বল বর্ণের মেয়ে খুজেন তেমনি দোকানে এসে মানুষ ঐ হলুদ আমটায় বেশি টাকা দিয়ে কেনে, তাহলে কেনো আমি আমে রং মেশাবো না।”


কলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কলা অবশ্য পাকলে বেশিরভাগ সময়ি সোনালি রং ধারণ করে, কিন্তু সেই রঙটা অতটা ইউনিফর্ম না যেটা আমরা বাজার থেকে কিনি। কিছুদিন আগে আমি এক ছড়ি কলা কিনলাম পাকা রং দেখে বাসায় এসে দেখি একটাও পাকা না, বরং সবই কাঁচা। রং কলার বাহিরটা পাকাতে পেরেছে কিন্তু ভেতরটা পাকাবে কে? লিচুর ক্ষেত্রেও রঙের ব্যবহার প্রকট আকার ধারণ করেছে। লিচু পাকলে কিছুটা লালচে রং ধারণ করে কিন্তু কখনই ঐরকম লাল হয় না যেরকমটা আমরা বাজার থেকে কিনি। চাকুরীর সুবাদে উত্তরবঙ্গে যাতায়াত হওয়াতে আমি এই ব্যপারটা জানি। গতকাল মিরপুর-১০ এ লিচু কিনতে গেলাম। দেখি সবাই লাল লিচু খুজতেছে এবং বেশি দাম দিয়ে কিনতেছে কিন্তু লিচুগুলোর গায়ের কাটাগুলা বলে দিচ্ছে ঐগুলা পরিপক্ক হয় নাই। আমি অনেক খুজাখজি করে দেখি দুই তরুণ ও নবীন বিক্রেতা বিমর্ষ মুখে এক ঝুড়ি লিচু নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কাছে যাওয়া মাত্র বললো নেন স্যার নেন একদাম ৩৫০ (কিন্তু অন্য সবাই বেচতেছে ৪০০ করে) এবং ওদের লিচুগুলো সাইজেও বড়। আমি আরো একটু কমাতে চাইলাম তখন ওরা বললো স্যার যদি শুধু একটু রং কইরা আনতাম তাইলে আপনি এই লিচুই ৪০০ টাকা দিয়া নিতেন? বাসার সবাই লিচুগুলা খেয়ে বললো গায়ের রং সবুজ হলে কি হবে মিষ্টি আছে!


তরমুজের ব্যাপারটা এবারই প্রথম ভালোভাবে বুঝলাম। মানুষ দোকানে যেয়ে মিষ্টি তরমুজ খোজার চেয়ে লাল তরমুজ খুজে, গাঢ় লাল সেটা আবার কেটে দেখাতে হবে। তো বেশ কয়েকবার দোকানে যাওয়ার পর দেখি সব তরমুজই টকটকে লাল? কাহীনিটা পরে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম এবং এরপর আর তরমুজ কিনি নাই। একবার মেঘনা ব্রীজের সিগনাল থেকে শশা কিনলাম খেতে যেয়ে দেখি তিতা। তো শশা ভালোমত না কাটলে এবং কিছু টেকনিক অবলম্বন না করলে শশা কাটার পরও তিতাই থেকে যায় তাই খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষ হওয়ার পর খেয়াল করলাম যে পলিথিনটাতে শশাটা ছিলো সেটা পুরোপুরি সবুজ হয়ে আছে। তখন বুঝলাম আসল ঘটনা। পুরোপুরি সবুজ না হলে শসা বিক্রি হয় না তাই এই ব্যবস্থা।


আরো কিছু প্রশ্ন আমাকে খুবই আনন্দ দেয়-আঙ্গুর, মাল্টা, কমলালেবু মিষ্টি হবে তো? আহারে যেনো এই ফলগুলো পাকলেই মধুর মত মিষ্টি হয়। কিন্তু আসলেই কি তাই? এই ফলগুলোর বেশির ভাগই বিদেশি ফল এবং যখন এইগুলা আমাদের মাটিতে জন্মায় তখন আর তার ঐ দেশিয় বৈশিষ্ট বজায় থাকে না। একবার আমার সাথে কাজ করা এক ড্রাইভার সিলেটে এক হালি কমলা কিনে খেয়ে দেখে টক। ব্যাটা তখনই বিক্রেতাকে গেলো মারতে। আমি পরিস্থিতি দেখে নিজেই গেলাম থামাতে। বিক্রেতা বললো বলেন স্যার আমি কি কমলার ভিতরে যেয়ে দেখছি না কি যে এইডা মিষ্টি না টক। এই প্রশ্নের আমি কি উত্তর দিব? ঐটা ছিলো অরিজিনালি আমাদের দেশি সিলেটি কমলা। এমনকি মিষ্টি কুমড়া পর্যন্ত মানুষ জিজ্ঞেস করে মিষ্টি হবে তো, আরে ব্যাটা এটাতো সব্জি ফল না?


এই কথাগুলো লেখছি একটা ক্ষেদ থেকে সেটা হলো আমার মেয়েটা ফল খুবই পছন্দ করে যদিও ফল নিয়ে আমার নিজের কোন আগ্রহ নেই। আর এখন আর্থিক অবস্থাই এমন যে বেশি বা বেশিবার কিনতে পারি না। যাও দু-একবার কিনি তাতেও যদি এইসব বিষ মিশানো থাকে তাহলেতো টাকা দিয়ে বিষ কিনে খাওয়ার কোন মানে হয় না। কিন্তু মেয়েটাকে তো আর বোঝাতে পারি না যখন পাশের সবাই ফল খাচ্ছে সেও তখন আবদার করে বসে আর আমাকেও তখন টাকা খরচ করে মেয়ের জন্য এইসব বিষ কিনে আনতে হয়?

ঢাকা, ১ জুন ২০১৪ইং

Md Yaqub Ali

Md Yaqub Ali

আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment