সতরঞ্জ কি খিলাড়ি

সতরঞ্জ কি খিলাড়ি

‘৭৯-‘৮০ সালের দিকে সত্যজিত রায়ের একটা ছবি দেখেছিলাম, ছবিটার নাম ‘সত্রাঞ্জ কি খিলাড়ি’। সহজ বাংলায় দাবা খেলুড়ে। উর্দু ডায়লগ, মাঝে কিছু ইংরেজি বাক্যালাপ ছিল দুই ব্রিটিশ মিলিটারি অফিসার এর মধ্যে। তখন অতটা বুঝি নাই, পরে আরেকবার দেখে বুঝেছিলাম সত্যজিত কি ‘message’ দিতে চেয়েছেন। মনে হচ্ছে এখন আবার দেখি। সত্যজিত সিনেমা বানাতে মুন্সী প্রেমচাদের এই গল্পটা বেছে নিয়েছিলেন কারণ মুন্সী প্রেমচাদ ক্ষমতার ব্যবহার এবং ধরে রাখাকে খুব সুন্দর ভাবে দাবা খেলার সাথে তুলনা করেছেন। মির্জা (সনজিভ কুমার) আর মীরের (সৈয়দ জাফরী)- লখনৌ এর দুই অলস এবং অকর্মণ্য জমিদারের সবকিছু ফেলে শুধুই দাবা খেলা, অযোধ্ধার রাজা নওয়াব ওয়াজিদ আলী শাহ (আমজাদ খান, তখনও গব্বর সিং হয়ে উঠেনি) রাজ্য চালানোর চাইতে নিজের কবিত্ব, গান বাজনা, নাচ আর করিওগ্রাফি নিয়ে বেশি সময় কাটাতো। আর নির্ভর করতেন ব্রিটিশ এবং অযোধ্ধার মধ্যকার শান্তি চুক্তির উপর। এইসব দেখে তার প্রধান মন্ত্রী আলী নকী খান (ভিক্টর ব্যানার্জি) শুধুই আফসোস করতেন, কিন্তু নাওয়াবকে এত বেশি ভালবাসতেন যে কিছুই বলতেন না। মির্জা আর মীর দাবা নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে ওরা ওদের স্ত্রীগণ (শাবানা আজমি আর ফরিদা জালাল) কে কোনো সময় দিতনা। যে কারণে ফরিদা জালাল তার এক তরুণ ভাগ্নের সাথে প্রেমে লিপ্ত হয়। মীর দাবা খেলায় মনোযোগ কমে যাবে ভেবে স্ত্রীর সাথে এ নিয়ে কোনো বাদানুবাদে যেতনা। দাবা এদের জীবনকে এমনি ঘিরে রেখেছিল।

আর অন্যদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কি ভাবে ভিন্ন দাবার ছক এটে স্বাধীন নাওয়াবকে সরিয়ে সরাসরি ব্রিটিশ শাসন চালু করবে, তাতেই ব্যস্ত ছিল। আর এটা ছিল পুরো ভারতবর্ষকে ধীরে ধীরে কব্জায় আনার চতুর কৌশল। অবশেষে একদিন লর্ড ডালহৌসির নির্দেশে জেনারেল অট্রাম আর ক্যাপ্টেন ঐস্টন লখনৌ আক্রমন করে। নওয়াব আলী শাহ’র কাছে দুইটা উপায় ছিল: যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া অথবা ক্ষমতা হস্তান্তর করা। জেনারেল অট্রাম লখনৌ দখল করতে আসছে শুনে মির্জা আর মীর ওদের দাবার বোর্ড নিয়ে পাশের গ্রামে পালিয়ে যায় যাতে নির্বিঘ্নে দাবা খেলতে পারে। কারণ ওরা ভেবেছিল নওয়াব আলী শাহ এদের দুইজনকে যুদ্ধ করতে পাঠাবে। আর এদিকে নওয়াব আলী শাহ তার নিজের রচিত ঠুমরী গাইতে গাইতে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করে। মির্জা আর মীর লুকিয়ে দাবা খেলেই যাচ্ছিল আর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী শহরের দিকে ধেয়ে আসছিল। ওদের খেলা হটাথ থেমে যায় খেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বাদানুবাদ হয়ে এবং মীর তার প্রিয় মির্জাকে গুলি করতে উদ্যত হয়েছিল। তারপর মীরের ভাবোদয় হয় এবং মির্জাকে বলে যে আমরা আমাদের বউদের সাথেই পেরে উঠিনা, ব্রিটিশ বাহিনীকে কি ভাবে প্রতিহত করব! এই ভেবে আত্ম স্বান্তনা পেতে থাকে। মাঝে ক্যাপ্টেন ঐস্টন তার জেনারেল অট্রাম এর কাছ থেকে নিজের প্রমোশনএর নিশ্চয়তা নিয়ে নেয়।

আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্যই সত্যজিত রায় এই সিনেমাটা তৈরী করেছিলেন মনে হয়। কয়েক দশকের পুরানো ছবি হলেও এর প্রাসঙ্গিকতা এখনো প্রযোজ্য। তখন এক ব্রিটিশই শুধু ছিল, কিন্তু বর্তমানের Geo politics এ শুধু ব্রিটিশ নয়, বহুত পদের Uncle Sam,তাদের তাবেদার সুশীল সমাজ, কিছু নিরপেক্ষ দৈনিক, ধর্মীয় মৌলবাদ, সামান্য কোনঠাসা আমাদের দেশ প্রেমিক _ _ _ _। জনগনকে বিজয়ের সাথে প্রকৃত অর্থে একাত্ত না করে যতই বিজয়ের গান পরিবেশন করেন আর শান্তি এবং ঠিকাদারী চুক্তি দিয়ে দেন না কেন, সময় আর সুযোগ মত সঙ্গিন উঠিয়ে তেড়ে আসতে দেরী করবে না।

জলের গভীরতা ফ্যাদম করা হয়ে গেছে, এখন একটা সুযোগ এসেছে জায়গা মতো ড্রেজিং করা এবং নদী পারের গাছের শেকড় এবং ডাল প্রুনিং করার। নিজের মতো করে যেন নৌকা বাইতে অসুবিধা না হয়। সময় এসেছে মীর আর মির্জার মতো অলস আর সুবিধাবাদী ব্যক্তিদের বের করে দেয়া; আলী নকি খানদের মতো লোকদের কাছে ডেকে প্রকৃত সত্য জেনে নেয়া। ইংরেজির কিছু শব্দের delicacy অতুলনীয়। যেমন consolidate – অনেক ভাবেই ব্যবহার করা যায়, তবে তার মধ্যে বেশি ব্যবরিত হয় যেমন, After winning, we need to consolidate. আমরা নেতৃত্বের মাঝে এই গুনাবলী দেখতে চাই। এবং এখনই।


Place your ads here!

Related Articles

পরিবহন মাফিয়া রাঙার কাছ থেকে শহীদ নূর হোসেনকে সার্টিফিকেট নিতে হবেনা

ফজলুল বারী: শহীদ নূর হোসেনকে মাদকাসক্ত হেরোইনখোর  ইয়াবাখোর দাবি করে বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে আলোচনায় আসার চেষ্টা করলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব

কাশেম বিন আবুবকরের ইসলামী ভাব-ধারার জনপ্রিয় উপন্যাস

ড.শাখাওয়াৎ নয়ন: লেখালেখি ছেড়ে দেওয়া একজন মানুষ কাশেম বিন আবুবকরকে নিয়ে প্রায় হঠাৎ করেই ইংল্যান্ডের ট্যাবলয়েড পত্রিকা ডেইলি মেইল, বার্তা সংস্থা

Holidays in Bangladesh

16 June, that was the date that my father (Shahadat Manik) had announced that we were going to Bangladesh on

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment