বৈচিত্রতার সৌন্দর্য: পাহাড়িদের জন্য ভাবনা
১৯৪৭ সালে যখন দ্বিতীয়বারের মতন বাংলা যখন ভাগ হল তখন অনেকেই আজকের বাংলাদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। বিশেষ করে শিক্ষিত, উচ্চবর্ণ এবং মধ্যবিত্ত হিন্দুদের অনেকেই চলে যান। আর পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার থেকেও অনেক মুসলিম আজকের বাংলাদেশে চলে আসেন। মুসলিমদের ক্ষেত্রেও শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্তরাই এই দেশ ছাড়ার বিষয়ে এগিয়ে ছিল। এই দুইদিকেই দেশ ছাড়া শরনার্থীদের সরকারের খুব একটা সাহায্য ছাড়াই সেটেল হতে হয়েছিল। এই বাংলা ভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০ জুন ১৯৪৭ সালে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলি তে। তৎকালিন বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের মেধার কথা চিন্তার করলে আমার আসলে কষ্ট হয়। বর্তমানেও আসলে এর খুব একটা উন্নতি চোখে পড়েনা দুই দিকেই।
আর আমার মত যারা সিলেট অঞ্চলের মানুষ, তাদের ভাগ্য গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল জুলাই মাসের সাত তারিখ সাল ১৯৪৭। আমার দাদা এবং অন্যান্য মুরুব্বিদের কাছে শুনেছি ভরা বর্ষায় তাঁরা ভোট দিয়েছিলেন। এই গণভোট ভরা বর্ষায়ই কেন আয়োজন করা হয়েছিল সেটা আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার না। সময় সল্পতার কারণে হতে পারে। এই গণভোটের পরেও সিলেটের কিছু জায়গা ভারতকে দিয়ে দেয়া হয়। যদিও সেই জায়গাগুলোতে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তখন।
তবে আমার আজকের এই লেখার উদ্দেশ্য তিনটা ভিন্য ভাবনার প্রকাশ। প্রথম উদ্দেশ্যটা আসলে হাইপোথিটিকেল, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টা একদম বাস্তব।
প্রথম ভাবনা:
এই ভারত ভাগের ফলে যেসকল মুসলমান তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিল তাদের সাথে স্থানীয়দের খাবারদাবার, আচার-আচরণ,পোষাক, ভাষা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক বন্ধনে খুব একটা দূরত্ব ছিল না। কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া মুসলমানদের সংখ্যার কারণে স্থানীয়রা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েনি। অন্তত এ বিষয়ে আমার জানা নাই।
এইবার বাংলাদেশের কথা ভাবুন। যদি বিহারী মুসলিমদের সংখ্যাটা স্থানীয় বাঙ্গালী মুসলিমদের থেকে বেশী হত তাহলে কি কি হতে পারত আজকের এই বাংলাদেশে! আমাদের ভাষা, আমাদের খাবারদাবার, আমাদের পোষাক, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আজকে কি হত! কোথায় থাকত! আদৌ বেঁচে থাকত কিনা! আমাদের বাঙ্গালী বৈশিষ্টগুলো একটা প্রচন্ড একটা ধাক্কার ভিতর দিয়ে যেত এতে আমার কোন সন্দেহ নাই। যাই হোক আমারা বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা হয়ত বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছি! পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা ভারতের সাথে গিয়ে কতটুকু বাঙ্গালী রয়েছে কে জানে। কোনদিন ভারত গেলে নিজ চোখে দেখে আসব।
দ্বিতীয় ভাবনা:
এইবার একটু ত্রিপুরার দিকে নজর দিন। বাঙ্গালী হিন্দুরা শুধু পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামেই যায় নাই, তারা ত্রিপুরায়ও গিয়েছিল। অবশ্য এই যাওয়াটা দেশ ভাগ হওয়ার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল বিবিধ কারণে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই বাঙ্গালীদের ত্রিপুরা যাওয়ার ফলে সেখানকার স্থানীয় নৃগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। এত বাঙ্গালী হিন্দুর ত্রিপুরায় মাইগ্রেশানের ফলে সেখানকার ডেমোগ্রাফিই পরিবর্তিত হয়ে যায়। এর ফলে আশির দশকে ট্রাইবাল ইনসারজেন্সির শুরু হয় এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়। আজকাল মাঝে মাঝে এইসব খবর আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
এইসবে বুঝা যায় আধুনিক সমাজ আসলে বিভিন্ন কালচারাল কমিউনিগুলোকে ডি-এথনিসাইজ করতে পারে না। বরং এথনিক কনসাসকে আরো শক্ত করে তোলে। কেন? অনেক কারণ থাকতে পারে। উদাহরণ চেয়ে লজ্জা দিবেন না। তবে নিজেকে একটা প্রশ্ন করুন ত্রিপুরা কি ভারতের বাঙ্গালী প্রদেশ?
তৃতীয় ভাবনা:
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক কিছু হয়ে গেল। বিভিন্ন গণমাধ্যম মারফত জানলাম। এইসব খবর আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। একসময় এই সমস্যাটা রাজনৈতিক এবং ইনসারজেন্সির ছিল। বর্তমানে শুধু রাজনৈতিক। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ এইসব কমিউনাল ভায়োলেন্সগুলো বন্ধ করা এবং দোষীদের বিচার করা। ওই এলাকার নৃগোষ্ঠীগুলোর কথা শুনা। আমি মনে করি এই নৃগোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশকে সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। একটা বৈচিত্রতা দিয়েছে। তাদেরকে আমাদের অনেক আপন করে নিতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যত দ্রুত এটা বুঝবে ততই দেশের মঙ্গল। একটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা বাঙ্গালীরা যেভাবে একটা বিষয় চিন্তা করি সেভাবে এই নৃগোষ্ঠীগুলো চিন্তা নাও করতে পারে। চিন্তার এই বৈচিত্রতাকে সম্মান করতে হবে। আপনার কাছে দেশের সংজ্ঞা যেমন তাদের কাছে তেমনটা নাও হতে পারে। আপনার কাছে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সহায়-সম্পদের সংজ্ঞা যেমন তাদের কাছে তেমনটা নাও হতে পারে। এগুলোকে সম্মান করতে হবে বাঙ্গালীদের।
উপরের তিনটা ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ বিজ্ঞাণীদের একটা কথা দিয়ে শেষ করতে চাই, এথনিসিটি কোন স্থায়ী বিষয় নয়, এটা আগে থেকে নির্ধারিত কোন বিষয়ও নয়। এথনিসিটি একটা সিচুয়েশন্যাল কন্সট্রাক্ট ( Situational Construct)। এথনিক আইডেন্টিটি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রসেসের মাঝ দিয়ে তৈরী হয়, ভাঙ্গে আবার তৈরী হয়। তাই এথনিসিটি বেজড এইসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা মোটেই কাম্য না। পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীদের এবং সেই সাথে বাংলাদেশের সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
জুবায়দুল জেকব
মেলবোর্ন
Related Articles
Bangla Article by Dr Farid Ahmed
পদত্যাগ অন্যায়ের দ্বার উম্মোচন করেঅধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ, দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সোহেল তাজ পদত্যাগ করেছেন। জাতির উদ্দেশ্যে এই বরেণ্য
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে ড. আবেদ চৌধুরী’র আবিষ্কার
ড. আবেদ চৌধুরী। বর্তমান সময়ে তার যুগান্তকারী একটি উদ্ভাবন হলো সোনালী মিনিকেট চাল। যে চাল খেলে রক্তে শর্করা এবং সুগার
জীবন থেকে জীবনে
আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা। ৫ই নভেম্বর আমি জানতে পারলাম আমার আর শুভর জীবনে নতুন কেউ আসছে, ঐ দিন ছিল