বঙ্গবন্ধু, বাকশাল ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

বঙ্গবন্ধু, বাকশাল ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

মুহম্মদ জে এ সিদ্দিকী: গত কিছুদিন ধরে একটি বই পড়ছিলাম—‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ’। বইটির প্রতি দুটি কারণে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। প্রথম কারণটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ অর্জন নিয়ে বিস্তর লেখালেখি থাকলেও তাঁর স্বদেশ নির্মাণ নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। বরং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির মদদপুষ্ট সামরিক শাসক ও একাত্তরের পরাজিত শক্তি তাঁর স্বদেশ নির্মাণের সাড়ে তিন বছর সময়কে নানান মিথ্যে ও বানোয়াট তথ্যে সাজিয়ে দেশবাসীর কাছে প্রচার করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পর্বটি নিয়ে আমার অসীম আগ্রহ আছে। আর সে আগ্রহ থেকেই গত কয়েক বছরে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েছি কিছু সঠিক তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করতে। আমার এই লব্ধ তথ্য উপাত্তের সঙ্গে লেখকের তথ্য উপাত্তগুলো তুলনা করাটিই ছিল প্রধান কারণ। আর দ্বিতীয় কারণটি ছিল আমাদের ভাটি অঞ্চলের অত্যন্ত মেধাবী একজন গবেষক ও লেখক হাসান মোরশেদ বইটি লিখেছেন। গত কয়েক বছরে তিনি যত লেখালেখি করেছেন তার বেশি ভাগই গবেষণা লব্ধ তথ্যে-উপাত্তে সমৃদ্ধ ও অনন্য। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছর স্বদেশ নির্মাণের সময়টুকু নিয়ে মিথ্যে তথ্যের ধূম্রজালে নির্ঝঞ্ঝাট সত্যগুলো অকপটে বলার জন্য তাঁর থেকে যোগ্য দ্বিতীয় কেউ আছে বলে আমার জানা নেই।

আগেই বলেছি বইটি পড়ার আগেই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ পর্ব নিয়ে আমার কিছু জানাশোনা ছিল। হাসান মোরশেদের এই বইটি আমার জানার পরিধিকে আরেকটু বাড়িয়ে দিল। যে লোকটি সারাটি জীবন ‘sincerity of purpose and honesty of purpose’ ভিত্তি করে চলেছেন। ৫৫ বছরের জীবনে কোনো অপরাধ না করেও শুধু জনগণের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে ১৩ বছরের অধিক সময় জেল খেটেছেন। একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার জন্য আস্তে আস্তে তৈরি করেছেন। আর ১৯৭১ সালে তিনি জনপ্রিয়তার এমন একপর্যায়ে ছিলেন যে তিনি যা বলতেন বাঙালি তাই শুনত। তাঁর নিজের কণ্ঠ তখন বাঙালির কণ্ঠ হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। বাঙালির সেই অবিসংবাদিত নেতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নির্মাণে যে খুব সুদূরপ্রসারী হবেন তা মোটামুটি ধারণার মধ্যেই ছিল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি সেই কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে তিনি যে দূরদর্শী কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার ফলাফল আমরা কয়েক মাসের মধ্যেই দেখেছিলাম। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই যুক্তরাজ্য ও মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতির ফলে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোও একে একে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে বিশ্বের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক এই মোড়লদের স্বীকৃতি আদায় করা এবং জোট নিরপেক্ষ থাকাটা ছিল নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। কারাগারে মানসিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার একদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু এই কাজটি শুরু করেছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে। অথচ পাকিস্তানের কারাগারে কী ভয়ানক মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই না তিনি বেঁচে ছিলেন! চিন্তা করলে শিউরে উঠতে হয়। কারাগারের অন্ধকার সেলের একটি বিছানা ও একটি জানালা ছিল তার পৃথিবী | অন্ধকার সেলে থাকতে থাকতে তিনি দিন-রাতের হিসাব ভুলে গিয়েছিলেন | তাঁকে নিয়ে বিচারের নামে প্রহসন শুরু হয়েছিল। সেই সেলের দরজার সামনে তিনি কবর খোঁড়া দেখেছিলেন। তাঁর লাশ এখানে দাফন করা হবে। তাঁর কাছে সে সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড ছিল জীবনের কিছুটা সম্প্রসারণ অথবা মৃত্যুর সাময়িক পশ্চাদপসরণ। এই রকম ভয়াবহ মানসিক পীড়নের মধ্য থেকে মুক্তি পেয়েই প্রথম দুই-এক দিনে নেওয়া এমন কূটনৈতিক উদ্যোগের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭ মার্চ ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭ মার্চ ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তি পাওয়ার একদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু আরও কয়েকটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অসুস্থ শরীর, চরম বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থার মধ্যে মোটেও বাধা হতে পারেনি। অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এই সিদ্ধান্তগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য খুব দারকারী পদক্ষেপ ছিল। তিনি লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নিলেন—স্বাধীন বাংলাদেশে আসার আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে চান। এই ইচ্ছার কথা শোনামাত্র লন্ডন থেকে তাঁর দিল্লি যাত্রার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে এয়ার ইন্ডিয়ান একটি বিশেষ বিমান প্রস্তুত ছিল। খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে মিসেস গান্ধীর এই সহযোগিতা বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর পরিবর্তে ব্রিটিশ বিমানবহরের একটি বিমানে তিনি দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কয়েকটি বিষয় এখানে খেয়াল করতে হবে। এয়ার ইন্ডিয়ান বিমানে না গিলে তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে খুব কৌশলে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা নিজে নেবেন। কারও দয়ায় তিনি দেশ চালাবেন না। দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই ভারতীয় সেনাদের কবে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হবে তা সরাসরি জনতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি তাঁর স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষদের কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন এই নিশ্চয়তা নিয়ে যে, ভারতীয় বাহিনীর তাদের দেশে ফিরে যাবে, বাংলাদেশ ভারতীয় বাহিনীর দখল ভূমিতে পরিণত হবে না। তার বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর এইরকম অসংখ্য পদক্ষেপের কথা হাসান মোরশেদ তাঁর বইয়ে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। যদিও এই বইটির আলোচনা লেখা আমার মূল উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু লিখতে বসেছি তাই এই বইয়ের প্রসঙ্গ এসে গেছে। কারণ এটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ পর্বের একটি অকাট্য দলিল।

২.

খুব ছোটবেলা থেকেই একটি কথা শুনে আসছি যে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল বাকশাল গঠন। আর স্বভাবতই বাকশাল নিয়ে আমার আগ্রহ তখন থেকেই শুরু। আমার মনে আছে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাকশাল নিয়ে আমার গণ্ডির মাঝে একটি বইও পাইনি। পত্রপত্রিকায় যা পড়েছি তার সারকথা ছিল বাকশাল হলো শেখ মুজিবের একনায়কতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার নাম। আর এই কারণে সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যা করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছে। মাঝে দীর্ঘদিন এই বিষয় নিয়ে কোনো পড়াশোনা করা হয়নি। কয়েক বছর আগে আমার কাছে একটি ভিডিও আসল। ভিডিওটি দেখে আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন এটি ছিল সেই ভাষণ। ওই দিন ভাষণটি কমপক্ষে আমি ১০ বার শুনেছি। আমার সারা শরীর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমন একটি মানুষ, এমন দরদি, এমন কান্নাভরা কিন্তু দৃপ্ত কণ্ঠের শেখ মুজিব কখনো একনায়ক হতে পারেন না! এমন ভালোবাসা যার বুকে তিনি কখনই এমন কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা করবেন না যেখানে তার প্রিয় দেশবাসী অশান্তিতে থাকবে। তিনি সেদিন খুব দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন—কবিগুরুর “রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি” মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। সাত কোটি বাঙালি প্রমাণ করেছে তারা মানুষ। সেদিনের ক্লান্ত, আবেগে আক্রান্ত শেখ মুজিব যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর হুঁশিয়ারি জানাতে ভুল করেননি। তিনি দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন যে, ‘তবে যারা দালালি করেছে যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাঙলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দিন। একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের মতো স্বাধীন আদালতে বিচার হবে, এদের শাস্তি হবে।’

এই ভিডিওটি আমার চোখ খুলে দেয় | এরপর একে একে অনেক অডিও ভিডিও ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে থাকি। এখনতো ইউটিউবে খুঁজলেই অনেক ভিডিও চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের অনেক তথ্যই বের হয়ে আসে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে নানান কিচ্ছা কাহিনি প্রচলিত থাকলেও কেউ ভুলেও বলে না যে, ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলাফলেই ছিল এই দুর্ভিক্ষ। বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষের দায়ভার নিয়ে কোনো ভণিতা করেননি। সকল ব্যর্থতার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে দুর্ভিক্ষে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন।

একাত্তরে পথেঘাটে এমন হত্যাদৃশ্য ছিল নিয়মিত। ছবিটি যশোর শহরের l সংগৃহীত

একাত্তরে পথেঘাটে এমন হত্যাদৃশ্য ছিল নিয়মিত। ছবিটি যশোর শহরের l সংগৃহীত

একদিকে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বঙ্গবন্ধুকে যেমন খুব মর্মাহত করেছিল, অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল বামপন্থীদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। সারা দেশ যখন দুর্ভিক্ষের ছোবলে একদম মৃতপ্রায় তখন কর্নেল তাহের গড়ে তোলেন তাঁর গোপন সশস্ত্র বিপ্লবী গণবাহিনী। জাসদও বসে নেই। দেশের এই চরম দুর্দিনে জাসদ প্রতিটি সেনানিবাসে গড়ে তোলে তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা | জাসদতো ১৯৭৩ সালের তাদের প্রথম জাতীয় অধিবেশনেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও-এর চিন্তা ধারাকে তাদের আদর্শ এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্যে স্থির করে শেখ মুজিব সরকারকে বুর্জোয়া শোষক শ্রেণির সরকার আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। এই বামপন্থীদের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের শুরু কিন্তু স্বাধীনতার ঠিক পর থেকেই | আর এদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণিমুক্ত ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ গঠন করার লক্ষ্যে আরেক স্লোগানধারী সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির ক্যাডাররা ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ৪৯২৫টি গুপ্তহত্যা করেছিল | ৬০টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে জনজীবনকে অস্থির করে তুলছিল। ১৯৭২-৭৩ সালের এই সময়টাতে পাকিস্তানপন্থী জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপিসহ বেশির ভাগ মুসলিম ভাবাপন্ন রাজনৈতিক দল গোপনে জুলফিকার আলীর প্রেসক্রিপশনে ‘মুসলিম বাংলা’ কায়েমের তাদের সকল শক্তি নিয়ে তৎপরতা চালিয়েছিল। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মাওলানা ভাসানী এদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করব।’ সেই সময়টিতে তিনি খুব দায়িত্বহীনের মতো অনেক আচরণ করেছিলেন। তিনি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলে বসলেন, ‘জয় বাংলা এবং আওয়ামী লীগ তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। তোমাদের ভাগ্য বিহারিদের মতোই হবে।’ দুর্ভিক্ষের চরম সংকটকালে এই উগ্র বামপন্থী ও মুসলিম বাংলা কায়েমকারীরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও গোপন তৎপরতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রচুর রাজনৈতিক কর্মী হত্যা, খাদ্য ও পাটের গুদামে আগুন, খাদ্য বহনকারী ট্রেন-ট্রাক ধ্বংস, থানা লুট, সার কারখানায় নাশকতা, সন্দ্বীপ চ্যানেলে গমভর্তি জাহাজ ডুবানো, ভাসানীসহ প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতার দায়িত্বহীন আচরণ, বারবার অস্ত্রের জোরে সরকার উৎখাতের হুমকি, চারজন সংসদ সদস্যকে হত্যা, সবশেষে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঈদের জামাতে সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধু আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেন না। এগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার নিজ দলের নেতাদের লুটপাট, চোরাচালান ও ক্ষমতার অপব্যবহার। যা তার ভিশনের সঙ্গে কোনো ভাবেই যাচ্ছিল না। তিনি দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর নিজ দলের অনেক গণপরিষদ সদস্য ও এমসিএকে বহিষ্কার করেছিলেন। প্রায় সাড়ে তিন বছরের প্রতিটি দিন এমন বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে করতে তিনি একেবারে শেষে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে | কাউকেই তিনি আর ভরসা করতে পারছিলেন না। দুর্ভিক্ষে এত মানুষের মৃত্যু তাকে বিমর্ষ ও ডেসপারেট করে তুলেছিল। এত নাশকতা, এত বৈরিতা, এত দুর্নীতি একসময় তাকে বাধ্য করেছে নিজের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নিতে, বাকশাল গঠন করতে।

বাকশালকে তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলেছিলেন | ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর এটি ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লব | তবে বাকশালের মতো বিপ্লবী উদ্যোগ পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয় | এর আগেও অনেক দেশে হয়েছে | কিন্তু এর আগে যেটি কখনোই হয়নি সেটিই করে দেখালেন বঙ্গবন্ধু | তিনি সেটি করলেন দেশের বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের বিধি মেনে | বাকশালের মূল কার্যক্রম বুঝতে এখানে কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি—১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের বেশ কিছু স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি ও কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। তিনি বলেন, ‘একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলার কোনো জমি থাকবে না চাষের জন্য। বাংলার মানুষের বাংলার মানুষের মাংস খাবে, সে জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে। এটা হলো তিন নম্বর কাজ। এক নম্বর হলো দুর্নীতিবাজ খতম করুন। দুই নম্বর হলো কারখানায়-খেতে খামারে প্রোডাকশন বাড়ান, তিন নম্বর পপুলেশন প্ল্যানিং আর চার নম্বর হলো জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য এক দল করা হয়েছে। যারা দেশকে ভালোবাসে, যারা এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মেনে সৎ পথে চলে তারা সকলেই এই দলের সদস্য হতে পারবেন। যারা বিদেশি এজেন্ট, যারা বহিঃশত্রুর কাছ থেকে পয়সা নেয় এতে তাদের স্থান নেই। সরকারি কর্মচারীরাও এই দলের সদস্য হতে পারবে। কারণ তারাও এই জাতির একটা অংশ। তাদেরও অধিকার থাকবে এই দলের সদস্য হওয়ার। এই জন্য সকলে যে যেখানে আছি একতাবদ্ধ হয়ে দেশের কাজে লাগাতে হবে।’

১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বাকশালের নবনিযুক্ত গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু কর্মপদ্ধতির বিশদ নির্দেশনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক, ফ্যামিলি প্ল্যানিং আর আমার দ্বিতীয় বিপ্লবের যে চারটি প্রোগ্রাম আছে সেগুলো আপনারা করুন। ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কের জন্য জন্য পাম্প পেলামনা, এটা পেলাম না—এসব বলে বসে না থেকে জনগণকে মবিলাইজ করুন। যেখানে খাল কাটলে পানি হবে, সেখানে সেচের পানি দিন। সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। মবিলাইজ দ্য পিপল। পাম্প যদি পাওয়া যায় ভালো। যদি পাওয়া না যায় তবে স্বনির্ভর হন। বাঁধ বেঁধে পানি আটকান, সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। আমাদের দেশে আগে কি পাম্প ছিল? দরকার হয়, কুয়া কেটে পানি আনুন। আমাদের দেশে পাঁচ হাত, সাত হাত, আট হাত কুয়া কাটলেই পানি উঠে। সেখানে অসুবিধা কি আছে? যে দেশে পানি আটকে রাখলে পানি থাকে, সেখানে ফসল করবার জন্য চিন্তার কি আছে? আর এখন থেকে যে সমস্ত সার থানায় যাবে, তা যেন রেগুলারলি গরিব-দুঃখীরা পায়।’

মুক্তির গান চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য: একাত্তরে সাংস্কৃতিক দলের কর্মীরা সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন শরণার্থী শিবির আর মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে গান করেন l ছবি: সংগৃহীত

মুক্তির গান চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য: একাত্তরে সাংস্কৃতিক দলের কর্মীরা সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন শরণার্থী শিবির আর মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে গান করেন l ছবি: সংগৃহীত

স্বনির্ভর কর্মোদ্যমের একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেছিলেন—‘আমি খবর পেলাম, ঠাকুরগাঁওয়ে একটা কোল্ড স্টোরেজ করা হয়েছে। এক বছর আগে সেটা হয়ে গেছে। কিন্তু পাওয়ার নাই। খবর নিয়ে জানলাম, পাওয়ার সেখানে যেতে এক বছর লাগবে। কারণ খাম্বা নাই। খাম্বা নাকি বিদেশ থেকে আনতে হবে। মিনিস্টার সাহেবকে বললাম খাম্বা টাম্বা আমি বুঝি না। বাঁশ তো আছে। এখানে দাঁড়াও, খাম্বা কাটো, দা লাগাও। দেড় মাস, দুই মাসের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে। এটা লাগাও। কি করে লাগবে, সেটা আমি বুঝি টুঝি না। দিল, লেগে গেল। কিন্তু ও আমার কাছে যদি না আসত, এক বছরের আগে খাম্বা পেত না, ওটা হতো না। এভাবে পাওয়ার গেল, আলু রাখল। এই মেন্টালিটি কেন হয়? খাম্বা বাংলাদেশের গাছে গাছে হয়। আমি বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় পাওয়ার দিতে চাই। কো-অপারেটিভও আমি প্রতিটি গ্রামে করতে চাই। এটা সোজাসুজি বাঙালি কো-অপারেটিভ যাকে বলা যায় মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ। আমি নিজে ঠিক করেছি আমার পদ্ধতি। প্রথমে এরিয়া ভাগ করে নেবেন। এমন জায়গায় নেবেন, যেখানে আমি ইমিডিয়েটলি পাওয়ার দিতে পারি। ধরুন যদি রাজশাহীতে যদি করি তাহলে এমন জায়গায় করতে হবে যেখানে পাওয়ার নিতে পারি। এভাবে একটা দুটা তিনটা গ্রাম নিয়ে কো-অপারেটিভ করতে হবে এবং এটা হবে কমপালসারি কো-অপারেটিভ। এতে কোনো কিন্তু-টিন্ত নেই।’

এই বিশাল কর্মোদ্যোগকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থামিয়ে দেওয়া হয়েছে | একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে এর পেছনের কারণ গুলো কি? বঙ্গবন্ধু কোনো সাম্রাজ্যবাদী দেশের প্রেসক্রিপশনে চলার মানুষ ছিলেন না | অর্থনৈতিক এই বিপ্লবটি সফল হলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে যাবে | সুতরাং শেখ মুজিবকে খতম করে বিশ্বব্যাংকের কথামত যারা চলে তাদের নিয়ে আসো। হলোও তাই। জাতি হারাল তার সবচেয়ে সুদৃঢ় নেতাকে।

৩.

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তীতে রাতারাতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেকগুলো বড় বড় পরিবর্তন আসল | প্রথমেই সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার মতো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মূল দুটি স্তম্ভকেও মুছে ফেলা হলো | একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রাপ্তির যে অবিনাশী চেতনা বুকে নিয়ে মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান আদিবাসী সবাই মিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, অর্জন করেছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ | সেই বাংলাদেশ রাতারাতি হলে গেল ‘ধর্মীয় বাংলাদেশ’ | পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়ে দেওয়া হলো | তাই ১৫ আগস্ট আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হারাইনি, আমরা হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকেও | দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার যাতে কোনো বিচার না হয় সে জন্য কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এর ভবিষ্যৎ বিচার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেওয়া হলো | পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রনায়ককে ঘাতকদের কাছে প্রাণ দিতে হয়েছে | কিন্তু কোনো রাষ্ট্রনায়ককে বঙ্গবন্ধুর মতো এমন করে সপরিবারে হত্যা করা হয়নি | এর পরে আবার আইন করে হত্যার ভবিষ্যৎ বিচার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেওয়ার নজির সারা পৃথিবীতে আর একটিও নেই | অবৈধ সামরিক শাসকের দল তৃতীয় যে কাজটি করল তা হলো বাঙলার মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে, বঙ্গবন্ধুর সকল কীর্তিকে চিরতরে মুছে ফেলার কিছু চতুর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা | রাষ্ট্রের সকল গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে দেখানো, বঙ্গবন্ধুর কথা বলা একদম বন্ধ করে দেওয়া হলো | ২০ বছর রেডিও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে দেখানো হয়নি | যেই মানুষটির কণ্ঠ বাংলার নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল, যিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করেছিলেন, দিয়ে গিয়েছিলেন একটি পতাকা, একটি মানচিত্র | বাংলার প্রতিটি মানুষের প্রতি যাঁর ছিল নিরন্তর ভালোবাসা | জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শুধুমাত্র মানুষকে ভালোবাসতে পারার অসম্ভব এই ক্ষমতাটিই যাঁকে বাংলার গণমানুষের নেতায় পরিণত করেছিল, সেই মানুষটিকে এক নিমেষে দেশের সব মিডিয়া, সব প্রকাশনা ভুলে গেল? সামরিক শাসকের দল সেখানেই থেমে থাকেনি, তারা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নামে নানান মিথ্যে ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে ভরা গল্প চারদিকে ছড়িয়ে দিল | সামরিক শাসকদের পালিত কিছু বুদ্ধিজীবী এই প্রচারের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন খুব নিষ্ঠার সাথে | আর সেসব মিথ্যা ও বিভ্রান্তি দেশের আনাচকানাচে ঘুরতে থাকে বছরের পর বছর | ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল—সুদীর্ঘ ২০ বছর একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এই সব মিথ্যা এবং বিভ্রান্তির গল্প শুনে | এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সকল কীর্তিকে মুছে ফেলতে যত চেষ্টা করা দরকার তারা সব চেষ্টাই চালিয়েছে।
সকল কীর্তিতে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পাশাপাশি ওরা সুকৌশলে আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছিল তা হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মধ্যেও কিছু বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে দেওয়া | তারা খুব মুনশিয়ানার সঙ্গেই এই কাজটি করেছে | আমি নিশ্চিত আজ যদি ইন্টারনেটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা হয় তবে অনেকগুলো ওয়েবসাইট পাওয়া যাবে যেখানে বলা আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ মরেনি, শেখ মুজিবুর রহমান তিন লাখের জায়গায় বাড়িয়ে তিন মিলিয়ন বলেছিলেন | এইগুলো নিছক বিভ্রান্তি | খুব কৌশলে এই সব বিভ্রান্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে | এই বিভ্রান্তিগুলো কিন্তু আবার রীতিমতো নামকরা গবেষকদের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়ে, দলিল হয়ে চারদিকে চড়িয়ে পড়েছে | এই সম্বন্ধে চমৎকার একটি ব্যাখ্যা পড়েছিলাম হাসান মোরশেদের ফেসবুক লেখায় | তিনি লিখেছিলেন—‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, পৃথিবীর ভয়াবহতম এক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল মূলত দুই পরাশক্তির প্রচ্ছন্ন ভরসায়। সমাজতান্ত্রিক চীন এবং পুঁজিবাদী আমেরিকা। এই দুই শক্তির ভরসা ছাড়া পাকিস্তান কিছুই ছিল না। চীন তার বুদ্ধিবৃত্তির জায়গায় এখনো এতটা এগিয়ে নেই। কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধি রাখে, জ্ঞানের ও ইতিহাসের গুরুত্ব তারা বোঝে। তাই তাদের একটা উদ্যোগ আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ আরও যে সব মানবতাবিরোধী ইতিহাসের তাদের অংশগ্রহণ আছে, সেগুলোর বিকল্প পাঠ তৈরি করানো | ইতিহাসের পাতা থেকে তাদের নামে চিহ্নিত রক্তের দাগগুলো পুরোপুরি মুছে ফেলতে না পারলেও অন্তত বিভ্রান্তি তৈরি করে রাখা |’ উদাহরণ হিসেবে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের একটি বিকল্প ইতিহাস তুলে ধরেছেন যা কিনা আমেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও পাকিস্তানের আইএসআই অর্থায়নে করেছেন নেতাজি সুভাষ বসুর পরিবারের এক সদস্য, শর্মিলা বসু | সেখানে বলে হয়েছে—‘এখানে আসলে বিহারি ও বাঙালিদের জাতিগত দাঙ্গা চলছিল একাত্তরের শুরু থেকে। যেহেতু বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর বাঙালিদের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ মূলত গুন্ডাপান্ডার দল সেহেতু বিহারিরা ভয়ংকরভাবে কচুকাটা হচ্ছিল। এই অরাজকতা থামাতে বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অ্যাকশনে নামতে হয়েছিল। সেই অ্যাকশনে কিছু বাঙালি অস্ত্রধারী যাদের ভারত প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল—তারা মারা গেছে। সংখ্যাটা খুব বেশি হলে ২৬ হাজার। বিহারিও কিন্তু মরেছে বাঙ্গালির হাতে হাজার হাজার। আর ধর্ষণ! দু-চারটা ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। তবে বাঙালিদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবের বাড়িয়ে বলার একটা বদভ্যাস ছিল।’

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি (ডানে)। তাঁর পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। অরোরার ঠিক পেছনে নৌবাহিনীর সাদা ইউনিফর্ম পরা ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান l ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি (ডানে)। তাঁর পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। অরোরার ঠিক পেছনে নৌবাহিনীর সাদা ইউনিফর্ম পরা ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান l ছবি: সংগৃহীত

তবে আশার কথা হলো আমাদের তরুণ প্রজন্ম এই সব গাঁজাখুরি গল্প খায়নি | এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যুক্তি তর্কে বিশ্বাস করে, ইতিহাস তাদের হাতের নাগালে | তারা যে মিথ্যা ইতিহাস খায়নি তার বাস্তব প্রমাণ ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চে লাখ লাখ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ | ঢাকাসহ দেশের সকল শহরে সেসময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে সোচ্চার আন্দোলন হয়েছিল তাদের নেতৃত্বে ছিল এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা | এই গণজাগরণ থেকে আরও কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল | আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রশ্নে কোনো আপস করা হবে না | আর তাই স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এত সহজে বিশ্বাস করবে না | এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের সাদাসিধে কলামে একটি লেখার কথা এখানে বলাটা যুক্তিযুক্ত মনে করছি | তিনি মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল অলি আহমেদের সঙ্গে এই প্রজন্মের একটি তরুণীর টেলিভিশনের একটি কথোপকথনের কথা নিয়ে সেখানে লেখেন | মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন—অলি আহমেদের এমন দাবির বিপরীতে তরুণীটি কর্নেল অলি আহমেদের প্রতি পুরো সম্মান রেখে খুব ঠান্ডা মাথায় তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে নির্জলা মিথ্যা তথ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত না করার জন্য অনুরোধ করেন | বঙ্গবন্ধু কবে, কীভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি কীভাবে প্রচারিত হয়েছে, নিউইয়র্ক টাইমসের কোনো সংখ্যায় সেই ঘোষণার কথা ছাপা হয়েছে, তরুণীটি অলি আহমেদকে তা জানিয়েছেন | শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটিতে কি বলেছিলেন তাও অলি আহমেদকে শুনিয়েছেন | তরুণীটি এটিও বলেছেন যে স্বাধীনতা ঘোষণা করা আর পাঠ করার মধ্যে দিনরাত পার্থক্য—এটাতো অলি আহমেদের ভালো করেই বোঝা উচিত | কথোপকথনের এই পর্যায়ে তরুণীটি অলি আহমেদকে প্রশ্ন করেন—জিয়াউর রহমান যদি স্বাধীনতার ঘোষক হোন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে সেই ইতিহাস নেই কেন? কেন সেটি ১৯৯১ সালের পর থেকে শুরু হলো? তরুণীটির অলি আহমেদকে বলেছিলেন আপনারা রাজনীতি করতে চান করুন, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে রাজনীতি করুন, কেন আপনারা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে চান?

আমার ধারণা আমাদের প্রজন্মের অনেকেই মনের কথা এটি | মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়িয়ে বরং যা সঠিক যা সত্য তাই বলে বলতে হবে | আর বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রাম মানেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন | তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন—‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি | একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায় | এই নিরন্ত সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ সুতরাং সুখী সমৃদ্ধ, আত্মনির্ভর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে গভীর গবেষণা, নিবিড় অধ্যয়ন ও তা থেকে অর্জিত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই |

Muhammad J. A. Shiddiky

Muhammad J. A. Shiddiky

বিজ্ঞানী ও শিক্ষক, গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া |


Place your ads here!

Related Articles

Cake cutting for Birthday

জম্মদিনের কেক কাটা -ড. ফরিদ আহমেদবিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবার ৬৬ পাঊন্ড ওজনের কেক কেটে ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক

লেখক নাসরীন জাহান এর সাথে একটি সাহিত্য সন্ধা

আধুনিক লেখক নাসরীন জাহান এর সাথে একটি মনোরম সাহিত্য সন্ধা Vanue: Glen Waverley Community Centre (Glen Waverley Community Centre, 700

Clean Up Australia Day: An Opportunity Day for Me

As a part of my Australian Science Challenge Awards, I had to partake in a social event. Seeing that BEN

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment