পালান শ্যামল কান্তি স্যার : এই দেশ আপনার না
ফজলুল বারী: নারায়নগঞ্জের লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে ঘুষের মামলার বিচার শুরু করেছেন সেখানকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আখতারুজ্জামান ভূঁইয়া। এর আগে এই মামলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে লাঞ্ছিত শিক্ষককে গ্রেফতার, পরে জামিনে মুক্তি দিয়ে দয়াও দেখানো হয়। মোর্শেদা নামের একজন শিক্ষিকাকে দিয়ে ঘুষের মামলা করা হয়েছে শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে! আর সাজানো মামলা জেনেও আদালত দূর্বল পেয়ে একজন লাঞ্চিত নিরীহ হিন্দু শিক্ষকের বিরুদ্ধে একের পর নানা সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছে! কারন বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন না। এটা অফিসিয়েলি বলেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। নারায়নগঞ্জের দাপুটে এমপি ভ্রাতৃদ্বয়ের অন্যতম সেলিম ওসমান যখন এই শ্যামল কান্তি স্যারকে কান ধরে উঠবস করান তখন দেশেবিদেশে এর প্রতিবাদে ‘সরি স্যার’ শিরোনামের অভূতপূর্ব প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত অপেরা হাউসের সামনে আমরা এখানকার বাংলাদেশিরাও কান ধরে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের ক্রোধ প্রকাশ করেছিলাম। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তখন অনেক বড় বড় কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারাও ব্যর্থ। একজন গুন্ডার আক্রোশ থেকে দেশের একজন সংখ্যালঘু শিক্ষককে রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। এ যেন এই পুজায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের উপহার!
নারায়নগঞ্জের জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমানের গুন্ডামি থেকে আমরা শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে চিনি জানি। এমপির গুন্ডামি শব্দটা ব্যবহার করায় তার ভক্তরা কষ্ট পেতে পারেন। একটু ব্যাখ্যা দেই। কষ্টটা আর থাকবেনা। এমপিরা একটা দেশের আইন প্রণেতা। কোন একটা অপরাধের শাস্তি কিভাবে হবে সাজা কি হবে তা সংসদে বসে আইনে ঠিক করেন এমপিরা। কিন্তু এই এমপি একটি কথিত অপরাধের নামে একজন শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করিয়েছেন। এটি একজন এমপির গুন্ডামি ছাড়া আর কি? ওই গুন্ডা এমপি একজন শিক্ষককে শুধু কান ধরে ধৃষ্ট উঠবস করাননি। একজন নিরীহ হিন্দু শিক্ষক আল্লাহকে গালি দিয়েছেন, এমন একটি কল্পিত অভিযোগে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টিরও কাজ করেছেন! শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছে শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ অসত্য-ভূয়া। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সেলিম ওসমানের উদ্দেশে বলেছিলেন, লজ্জা থাকলে তিনি যাতে আর সংসদে না যান।
কিন্তু এতকিছু স্বত্ত্বেও কেউ বুড়িও ছুঁতে পারেনি সেলিম ওসমানের! কারন তার-তাদের ওপর ছাতাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার! এটি তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একথা বলেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর শরণার্থী হিসাবে শেখ হাসিনা যখন ভারতে দিল্লীতে থাকতেন তখন নিয়মিত যারা তাঁর খোঁজখবর রাখতেন তাদের একজন হলেন নারায়নগঞ্জের শামসুজ্জোহা খান। আজকের দিনে প্রয়াত এই নেতার ছেলেরা হলেন নারায়নগঞ্জের শামীম ওসমান, সেলিম ওসমান। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন এই পরিবারটিকে দেখাশুনার দায়িত্ব তার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীতো বলেননি ত্বকীর মতো একটি মাসুম বাচ্চাকে হত্যা করলেও তিনি প্রশ্রয় দেবেন! প্রধানমন্ত্রীতো বলেননি একজন হিন্দু শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করালে তিনি পিঠ চাপড়ে বলবেন খুব ভালো করেছিসরে সেলিম। একটা চড় মেরে ওই ব্যাটার মুখ বাঁকা করে দিলে আরও ভালো করতি! কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকেতো সব বলতে হয়না। তাঁর কৃতজ্ঞতার ওই কিছু কথাবার্তার পর যেন নারায়নগঞ্জের মিরাশদারি পেয়ে গেছেন ওই দুই ভাই! আর নারায়নগঞ্জের ডিসি-এসপি-ম্যাজিস্ট্রেট সবাই বুদ্ধিমান বলেইতো প্রধানমন্ত্রীর ম্যাসেজটি মাথায় রেখে সব নির্যাতনকে লাই দিয়ে যাচ্ছেন!
যেহেতু বাংলাদেশের প্রশাসন-বিচার বিভাগ স্বাধীন না, সে কারনে সন্তান হারা ত্বকীর বাবাকে এখানে বিচারে সহায়তার বদলে চরম নিষ্ঠুরতায় হয়রানি করা হয়! প্রধানমন্ত্রী যখন বোনের মমতায় তার ছোটভাই রাসেলের জন্যে কাঁদেন, তখন কী বিদ্রূপে হাসে ত্বকীর আত্মা! শিক্ষা মন্ত্রণালয় সহ সরকারের নানা কর্তৃপক্ষের রিপোর্টের পরও সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা হয়না। গ্রেফতারি পরোয়ানা হয়, গ্রেফতার হন, সাজানো মামলায় বিচার শুরু করা হয় একজন লাঞ্চিত শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে! আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশেও যে এখন এনালগ দিনের এসব জুলুমবাজি চলছে যা এক কথায় অবিশ্বাস্য। আদালতে দাঁড়িয়ে শ্যামল কান্তি ভক্ত বলেছেন ‘সেলিম ওসমান তার মামলা থেকে রেহাই পেতে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আমি শিক্ষক হওয়া আমাকে লাঞ্ছনার পর মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট তা শোনেননি! কি কারনে শোনেননি তা নারায়নগঞ্জবাসী জানেন-বোঝেন। এ নিয়ে হতাশা, ক্রোধ প্রকাশ ছাড়া কী করার আছে?
শ্যামল কান্তি স্যারের নিগ্রহ নিয়ে বেশি অসহায়্ত্ব হচ্ছে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগকে তাদের আশ্রয় মনে করে। কিন্তু দেশের বাস্তব অবস্থা হচ্ছে হিন্দু নিগ্রহ, তাদের জমিজমা গ্রাস থেকে শুরু করে নানান নির্যাতন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমেই বেশি হয়। অথবা প্রশ্রয়ে হয়। বিএনপি-জামায়াতের লোকজনের অত সাহস নেই অথবা এক-দুটি ঘটনা করে থাকলেও আওয়ামী লীগের প্রতিবাদের চোটে টিকতে পারেনা। বাংলাদেশের প্রভাবশালীরা জানে হিন্দুদের একটু ভালো করে ভয় দেখাতে পারলে তারা তাদের জমিজমা অল্পদামে বিক্রি করে ভারতে চলে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে ফরিদপুর শহরে এমন একটি বড়সড় হিন্দু সম্পত্তির মালিক বনেছেন প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের নিগ্রহের কারনও বেয়াই মন্ত্রীর ওই হিন্দু সম্পত্তি লোভ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের সদস্য কারো বিরুদ্ধে কারো বাড়ি সম্পত্তি দখলের অভিযোগ নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার বেয়াইর ওই লোভ থামাতে পারেননি। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন বেয়াই মন্ত্রীতো বাড়ি টাকা দিয়ে কিনেছেন! যে কেউ হিন্দু সম্পত্তি কিনতে পারলে তিনি কিনতে পারবেননা কেনো।
বেয়াই সাহেবের ফরিদপুর শহরেতো এমনিতেই বিশাল বাড়ি সম্পত্তি আছে। এখন টাকা রাখার জায়গা পাচ্ছেননা নতুন বাড়ি কিনতে চান তা হিন্দুরটা কেনো? আগে যাই থাকুননা কেনো তিনিতো এখন আওয়ামী লীগ নেতা। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী। দেশের প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই। আর ওই বাড়ি যার ছিল তিনি এখন কোথায়? ভারতে? টাকাগুলো কী করে গেছে? অর্থমন্ত্রীরতো তা জানার কথা নয়। কারন হুন্ডির হিসাব অর্থমন্ত্রী জানেননা-রাখেননা। শ্যামল কান্তি স্যারের বাড়ি-সম্পত্তির বিত্ত নেই। একটা স্কুলের হেডমাস্টারের চেয়ার ছিল তার। একজন হিন্দুর কাছে এখনও হেডমাস্টারের চেয়ার থাকবে কেনো! এতবড় সাহস! শ্যামল কান্তি স্যারের পুরো ঘটনা খুঁজলে এমন একটি স্টোরি বেরিয়ে আসে। এক সময় দেশের সিংহভাগ স্কুল-কলেজের শিক্ষক ছিলেন হিন্দু। প্রানেশ স্যার, করবী স্যার, আদিত্য স্যার, সীতেশ স্যার, ননী স্যার, চন্দন স্যার এদের ছায়ায় কেটেছে আমার স্কুল জীবন। যে স্কুল থেকে আমি এসএসসি পাশ করেছি সে স্কুলের নাম নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। যে কলেজ থেকে আমি এইএসসি পাশ করেছি সেটির নাম মুরারি চাঁদ কলেজ। ব্রাহ্মনবাড়িয়াকে এখন বি বাড়িয়া বলার মতো যদিও এখন সেগুলোকে বলা হয় এনসি হাইস্কুল, এমসি কলেজ!
এরপরও সত্য হচ্ছে দেশের এমন পুরনো স্কুল-কলেজের বেশিরভাগ হিন্দুদের প্রতিষ্ঠিত। সেই সব শিক্ষক-প্রতিষ্ঠাতাদের বেশিরভাগ হয় মারা গেছেন অথবা ভারতে চলে গেছেন। এখনও রয়ে গেছেন বোকা টাইপের কতিপয় শ্যামল কান্তি ভক্ত! তারা বোকা কারন পরিবর্তিত সময়, আজকের ভিতর থেকে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের হিসাব তারা বোঝেননা জানেননা। জন্মভূমির টান-বাংলাদেশ প্রেম মারান? চোখকান খোলা রেখে আশেপাশের মানুষজনের মনের কথা জানার বোঝার চেষ্টা করুন। এখনকার বেশিরভাগ সংখ্যাগুরুর মনের কথা হচ্ছে হিন্দুর আবার কিসের বাংলাদেশ প্রেম? তাদেরতো এক পা ভারতে। এটাই আজকের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত একাত্তর-বাহাত্তরের বাংলাদেশ না।
আওয়ামী লীগের লোকজনের মনের কথা হচ্ছে যত নির্যাতন-নিগ্রহ হোকনা কেনো ভোটটা হিন্দুরা শেষ পর্যন্ত নৌকায়ই দেবে। নৌকায় না দিয়ে দেবে কই। এ কথাটাও শতভাগ মিথ্যা না। দেশের অবশিষ্ট হিন্দুরা শেষ পর্যন্ত নৌকায়ই ভোট দেন। এই শ্যামল কান্তি ভক্ত আগামী নির্বাচনের সময় জেলের বাইরে থাকলে হয়তো ভোটটা শেষ পর্যন্ত নৌকাতেই দেবেন। কিন্তু এখানে জনপদে জনপদে নির্যাতিত সংখ্যালঘুর মনের কষ্ট, জমানো ক্রোধের বিস্ফোন্মুখ অবস্থা কী আওয়ামী লীগ টের পাচ্ছে? সেই ভোটের লোকজনও নানাকারনে শুধুই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার বন্ধু-অনুসারীদের বড় অংশ হিন্দু প্রিয় প্রজন্ম। তাদের আমি দেখি। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হয়। নতুন প্রজন্মের হিন্দু ছেলেমেয়েদের বড় অংশ কিন্তু এখন আর তাদের পূর্বপুরুষদের মতো চোখ বন্ধ করে আওয়ামী লীগ না। ‘সুবোধরা পালিয়ে যা, এই দেশ তোদের না’ জাতীয় একটি স্ক্রল কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি যেখানে ছিল, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের সংগঠন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে এ অবস্থার সৃষ্টি হবে কেনো? আজকের আওয়ামী লীগের কী তা খোঁজার সময় আছে?ভিতর থেকে কষ্টে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ। কষ্টটার কারন এই আওয়ামী লীগকে তারা চিনতে পারেননা।
শ্যামল কান্তি স্যার এখনও বোকার মতো এখানে পড়ে আছেন কেনো? দেশকে জন্মভূমিকে ভালোবেসে নির্যাতন-লাঞ্ছনা সয়েও জেলের ভাত খাওয়ার জন্যে? জেলখানায় যাবার পরও ‘মালাউন এসেছে আরেকটা’ সম্ভাষন শোনার জন্যে? এখনও পারলে পালান শ্যামল কান্তি স্যার। ‘সরি স্যার’ বলে দেশেবিদেশে কান ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও আপনাকে আমরা সুরক্ষা দিতে পারলামনা বলে দূঃখিত। এ দেশ আর সব ধর্মের মানুষের জন্যে সমান অধিকার-মর্যাদার না। পালান স্যার। এই দেশ আপনার না।
Related Articles
Dramatist, Novelist Journalist Anisul Huq visits Canberra
When many amongst us were longing for a qualitative change in our audio-visual entertainment arena almost clogged with low-quality, cheap
মানবাধিকার লংঘন এর সমাধান কী?
বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন এখন সাধারণ একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে! নিহত একরামুল এর পরিবার যে অভিযোগ করেছে এটা খুবই গুরুতর। সরকার
আমরাই তো বাংলাদেশ
জোসেফ ও স্টেলা দুই মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মী । পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আজাইরা মানুষজনকে কিভাবে দক্ষ মানবসম্পদে পরিনত করা যায়, তা