নাকফুল কেড়ে নিওনা বিপন্ন রোহিঙ্গা নারীর

নাকফুল কেড়ে নিওনা বিপন্ন রোহিঙ্গা নারীর

ফজলুল বারী: বাংলাদেশের কিছু অসভ্য লোকের একটি বদভ্যাস হলো তার হিন্দু প্রতিবেশীকে মালাউন বলে গালি দেয়া! এর পিছনে ধর্মীয় আক্রোশ মূল। এই আক্রোশটি সৃষ্টির পিছনে আমাদের সমাজের কিছু ওয়াজি মাওলানার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন গত পহেলা বৈশাখের পর একটি মসজিদের ভিতর এক ওয়াজি মাওলানার একটি ওয়াজের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। যেখানে বলা হচ্ছিল পহেলা বৈশাখে মুসলমান যারা পান্তা ইলিশ খেয়েছে তার হাশর হিন্দুদের সঙ্গে হবে! কাগজে কলমে ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশে এমন ধর্মীয় বিদ্বেষ যারা ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার সাহস রাষ্ট্রের নেই! বাংলাদেশের হাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিরা কতোকিছুতে সুয়োমোটো রুল জারী করেন! কিন্তু এমন ঘটনায় কাউকে সুয়োমোটো রুল জারী করে কোর্টে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করার সতর্ক করার নজির নেই! এবার রোহিঙ্গা শরণার্থী ঢলের শুরুতে আমরা অবাক হয়ে দেখলাম স্বনামখ্যাত অনেকের পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের একদল অসভ্য লোকও বিপন্ন রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানান অমানবিক-নিষ্ঠুর বক্তব্য দিচ্ছেন! এদের কাছে হয়তো মনে হয়েছে রোহিঙ্গারা মুসলিম। দেশের মুসলিম যারা তাদের গালি দেয় তাদের কিছু বলতে করতে পারিনা, ভিনদেশী মুসলিম বলে তাদের এক পশলা গালি দিয়ে দিলাম আর কী! কিন্তু সত্য হচ্ছে সংখ্যাগরিশষ্ট রোহিঙ্গারা শুধু মুসলিম হবার অপরাধে বার্মা থেকে বিতাড়িত নয়। তারা বাঙালি হবার কারনেও বিতাড়িত। বার্মিজরা মনে করে তারা বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে যাওয়া সেটেলার! সে কারনে আরাকান রাজ্যে জন্ম হওয়া স্বত্ত্বেও বার্মায় তাদের নাগরিকত্ব নেই! বার্মায় রোহিঙ্গাদের বর্নবাদী ‘কালা’ নামে গালি দেয়া হয়।

এবার রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশের সাড়া বিলম্বিত হলেও তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এরমাঝে বিপুল প্রশংসিত হয়েছে। একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করতে বার্মিজ সরকারের শয়তানির বিপক্ষে বাংলাদেশের মানবিক প্রশংসা এখন সব আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। বাংলাদেশ এ পরিস্থিতিকে ইতিবাচক কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু অর্জন করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু খারাপ লোকজনের কারনে এ অর্জন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ একটি শরণার্থী জাতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়েছিলেন। পচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বিদেশে শরণার্থী জীবন কাটিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন রেহানা। শরণার্থী শিশু হিসাবেই ভারতে শিক্ষা জীবন শুরু হয় শেখ হাসিনার দুই সন্তান জয়-পুতুলের। এর কারনে এবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশা দেখতে গিয়ে কান্না থামাতে পারেননি শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা। বিবিসির সাংবাদিককে শেখ হাসিনা বলেছেন শরণার্থী হবার কষ্ট আমরা বুঝি। বার্মার পরিস্থিতি যতোক্ষন স্বাভাবিক না হবে ততোক্ষন আমরা তাদেরকে সেখানে ঠেলে দিতে পারিনা। কারন আমরা মানুষ। জাতীয় সংসদের সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যেন কেউ কিছুতে কষ্ট না দেয়! প্রয়োজনে আমরা আমাদের খাবার তাদের সঙ্গে ভাগ করে খাবো।

কিন্তু শুরুতে এবারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশের ভিতর ঢুকতে দিতে সরকারি সিদ্ধান্তহীনতায় রাষ্ট্রীয় কিছু অমানবিক আচরনও হয়েছে। যেহেতু আগে থেকেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এখানে আছেন তাই নতুন শরণার্থী গ্রহনের অপারগতা বাংলাদেশের ছিল। সে হিসাবে শুরুতে বাংলাদেশের বিজিবি, কোষ্টগার্ড শরণার্থী প্রবেশে বাধা দিয়েছে। কিন্তু বিপন্ন মানুষজনের ঢলটি এমন মাত্রার ছিল যে অফিসিয়েল ঘোষনা না থাকলেও পরবর্তিতে তাদের আর বাধা দেয়া যায়নি। এই সুযোগে শরণার্থীদের জিম্মি করে টু-পাইস কামিয়েছে একদল নৌকার মাঝি! জনপ্রতি শরণার্থীদের কাছ থেকে দুই হাজার বা এরও বেশি টাকা আদায় ছাড়াও বিপন্ন রোহিঙ্গা নারীদের নাকফুল সহ নানান স্বর্নালংকারও এরা ছিনিয়ে নিয়েছে!

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

বিজিবি-কোষ্টগার্ডের কিছু অসৎ সদস্যের বিরুদ্ধেও শরণার্থীদের দুর্ভোগ নিয়ে বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে! বিপন্ন শরণার্থীদের অনেকে তাদের গবাদিপশু সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এপারে সেগুলো কমদামে কেনাবেচারও একটি হাট গড়ে উঠে। শরণার্থীদের প্রথম গ্রুপটি পৌঁছবার পরও তাদের নিয়ে বিষোদগার চলছিল! কারন তখনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের খবর আসেনি। বলা হচ্ছিলো শরণার্থীরা পাহাড় কেটে বনজঙ্গল সাফ করে ঘরবাড়ি বানাচ্ছে! গাছকাটা নিয়ে যে সব সুশীল বক্তব্য দেয় তারা কোথায়, সুন্দরবন নিয়ে আর একটি প্রশ্ন তুললে তাদের বংশ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে ইত্যাদি! কিন্তু এরপর জানা গেলো শরণার্থীদের ঘরবাড়ি-ছাউনি বানিয়ে সে সব তাদের কাছে ভাড়া দিয়েছে শাসকদলের স্থানীয় কিছু নেতাকর্মী! লোকজন কত অসাধু বর্বর হয়ে উঠলে বিপন্ন মানুষজনের দুর্ভোগ নিয়ে এমন অসাধু বানিজ্য করতে পারে! অথচ বাংলাদেশের লোকজন এখনও যে নানাদেশে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিতে যায় তাদের প্রথম আশ্রয় জেলখানা হলেও সেগুলোর সুযোগ সুবিধা ঢাকার অনেক হোটেলের চাইতে ভালো। জেলখানায় প্রতি সপ্তাহে তাদের হাতখরচও দেয়া হয়। অন্তত উন্নত সভ্য দেশগুলোয় পদেপদে শরণার্থীদের নিয়ে এমন অসাধু বানিজ্যের সুযোগ নেই। বাংলাদেশ থেকে অনেক দেশে এখন যত লোক শরণার্থী হতে যান তাদের সিংহভাগ মূলত অর্থনৈতিক শরণার্থী। অর্থনৈতিক শরণার্থীদের বৈধ হবার সুযোগ কম। তা লুকোতে দেশ সম্পর্কে যত খারাপ কথা বলা সম্ভব তাই তারা বলেন। রোহিঙ্গারা প্রকৃত শরণার্থী। তাদের কোন দেশ নেই, নাগরিকত্ব নেই। জন্মভূমি বার্মা তাদের স্বীকার করেনা। মূলত শেখ হাসিনার শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পর বিপন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কদর্য নিষ্ঠুর মন্তব্যের প্রকোপ কিছুটা হলেও কমেছে।

কিন্তু শেখ হাসিনার পরিদর্শনের আগে হঠাৎ করে একদল বলা শুরু করলো রোহিঙ্গা শরণার্থী নারীদের অনেকে বিয়ে করে ফেলছে! আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলে দিলেন রোহিঙ্গা নারী কেউ বিয়ে করলে সেটি হবে অবৈধ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন আগত রোহিঙ্গা শরণার্থী নারীদের নব্বুইভাগ ধর্ষিতা! এরা ধর্ষিত হয়ে থাকলেতো সবার আগে তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর কথা! অথচ এদের ডাক্তারি পরীক্ষার কোন উদ্যোগের কথাও কেউ শুনলোনা-জানলোনা! না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের মতলবী নাগরিকদের সতর্ক করে বলছেন খবরদার কেউ ধর্ষিতা নারীদের বিয়ে করোনা। এমন বক্তব্যের মাধ্যমে মন্ত্রী দেশের ধর্ষকদের তাতিয়ে দিলেন কিনা জানিনা। যেন এদের ভোগ করতে পারো কিন্তু বিয়ে নয়। বিয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশের আমজনতা পুরুষরা অবশ্য যথেষ্ট বর্নবাদী হয়। ফর্ষা মেয়ে তাদের বেশিরভাগের পয়লা পছন্দ। রোহিঙ্গা নারীদের গড়পরতা যে গায়ের রঙ তাদের পাত্রী হিসাবে রোহিঙ্গা নারী তাদের পছন্দ করার কথা না। মানবিক কারনে যদি কেউ বিয়ে করে সে কথা ভিন্ন। বাংলাদেশের লোকজন বিদেশে গিয়ে যে সব বিয়ে করে এর বেশিরভাগ মানবিক কারনে না। অভিবাসনের আশায়। বাংলাদেশের কোন মাওলানা বা কোন মন্ত্রী কখনও ফতোয়া দেননা বা বলেননা যে খবরদার বিদেশে গিয়ে কোন বিদেশী মেয়ে কেউ বিয়ে করবেনা। এটা আবার অনেকে মেম সাহেব বিয়ে করার মতো গৌরবের মতো দেখেন! বিপন্ন রোহিঙ্গা নারীদের নিয়ে এখন পর্যন্ত অমানবিক আপত্তিকর মন্তব্যগুলো আমাদের দেশের বর্নবাদীর পুরুষতন্ত্রের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে। একজন নারী প্রধানমন্ত্রীর পিছনে তারা কাজ করলেও আড়ালে আবডালে তারা ভিতরের কদর্য পুরুষতান্ত্রিক মন নিয়ে নারী প্রধানমন্ত্রী বা সহকর্মীদের নিয়ে তারা কী সব কথাবার্তা বলেন তা সহজে অনুমানযোগ্য।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

আমার ধারনা প্রাথমিক কিছু সিদ্ধান্তহীনতা ছাড়া এখন পর্যন্ত চলতি রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের নানা ভূমিকা সঠিক আছে। সেনাবাহিনীকে ত্রাণ বিতরনের নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে এটি আরেকটি ভালো সিদ্ধান্ত। এক অধ্যাপক দেখলাম বলেছেন বার্মিজ হেলিকপ্টার এতবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লংঘন করেছে কিন্তু বাংলাদেশের কী কোন হেলিকপ্টার নেই নাকি! এসব উস্কানি গায়ে না মাখলেও চলবে। বার্মার সঙ্গে যুদ্ধ করা বাংলাদেশের কাজ না । কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কিন্তু মানুষ বাংলাদেশের কুকুরের পায়ে কামড়াতে যাবার দরকার নেই। খেয়াল রাখতে হবে খাবার-চিকিৎসার অভাবে যাতে একজন শরণার্থীরও মৃত্যু হতে না পারে। যত শরণার্থী জীবন বাঁচাতে আমাদের কাছে আশ্রয়ের আশায় এসেছে দেশে তাদের বাড়িঘর, জমিজমা-সহায় সম্পদ ছিলো। সখ করে কেউ সব ফেলে এখানে মানবেতর ক্যাম্প জীবনে থাকতে আসেনি। কাজেই বিপন্ন মানুষগুলোকে নিয়ে কোন রকম নিষ্ঠুর মন্তব্য আর নয়। বিশ্ব জনমতকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ফেরার ব্যবস্থার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সবার আগে। সেটি সম্ভব না হলে জাতিসংঘ উদ্ধাস্তু হাইকমিশনের মাধ্যমে তাদের ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট বানিয়ে তাদের নিরাপদ দেশগুলোয় নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। মোটকথা বাংলাদেশের মানবিক উদ্যোগ-সহায়তা যাতে কোথাও প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবে হবে সবপক্ষকে। আর কেউ যাতে একটা নাকফুলও কেড়ে নিতে না পারে কোন একজন অসহায় রোহিঙ্গা নারীর। তাদের কেউ সম্ভ্রমহানির চিন্তা-চেষ্টা করলেও কঠোরভাবে দমন করতে হবে যে কোন লোভী পুরুষপশুকে। বিদেশের কাছে ভিন্ন এক মানবিক বাংলাদেশকে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে যাবার সুযোগ এখন এই রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার করে শরণার্থী ক্যাম্পগুলো পরিদর্শনে গেলে ভালো হয়। মোটকথা বাংলাদেশের মানবিক উদ্যোগ-অবদানটি যেন কোনভাবে ক্ষুন্ন-পন্ড না হয়। কান্ডারি হুশিয়ার!!

Photo courtesy : bdnews24.com


Place your ads here!

Related Articles

১৫ই আগস্ট ২০১৭: বাংলাদেশ হাইকমিশন ক্যানবেরা

এই পৃথিবীতে- সে ধর্মীয় হোক আর সাম্রাজ্য বিস্তার- রাজনীতি ছাড়া কোনো যুদ্ধ হয় নাই। অর্থাৎ যুদ্ধের পেছনে রাজনীতি থাকে, রাজনীতির

On departure of Pamela Bone by Dilruba Shahana

This is sad to know that Pamela Bone is no more there to write her column. She is the one

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরাট বিজয়

ফজলুল বারী: আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে দেয়া প্রাথমিক আদেশে বাংলাদেশের অবস্থানের বিজয় সূচিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক আদালত তাদের অন্তর্বর্তী

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment