সিডনিবাসীর প্রাণের মেলা রেকর্ড গড়ল

সিডনিবাসীর প্রাণের মেলা রেকর্ড গড়ল

ফজলুল বারী, সিডনি: একটা প্রশ্নের জবাব দেই আগে। সিডনির বৈশাখী মেলা এবার এত দেরিতে করার কারন কী? এই মেলাটি হয় সিডনির সবচেয়ে বড় ভেন্যু অলিম্পিক ভিলেজের এএনজেড স্টেডিয়ামে। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে কয়েক কিঃমিঃ এলাকাজুড়ে নির্মান করা হয় এখানকার অলিম্পিক ভিলেজ। এখানে অনেকগুলো স্টেডিয়াম। সবচেয়ে বড় স্টেডিয়ামটি এএনজেড স্টেডিয়াম। খুব ব্যস্ত শিডিউল এই ভেন্যুর। দুনিয়ার নামকরা শিল্পীরা সিডনি এলে তাদের কনসার্টও এখানে হয়। এবার ১৪ এপ্রিল তথা পহেলা বৈশাখের সময়টায় এই ভেন্যুতে চলছিল ইস্টার শো’র নানা আয়োজন। প্রতবছর ইস্টারের সময়টায় অলিম্পিক ভিলেজের স্টেডিয়ামগুলোয় জমজমাট ইস্টার শো চলে। ওই সময়ে ভেন্যু ভাড়া পাওয়া না যাওয়াতে এবার মেলার আয়োজনে এই ১৩ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়েছে।

প্রশান্ত পাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালির সংখ্যা ৫০-৬০ হাজারের বেশি হবেনা। বলাবাহুল্য এর নব্বুইভাগ অথবা এরও বেশি বাংলাদেশি বাঙালি। পৃথিবীর বহু জাতি-ভাষার মানুষের বহুজাতিক সংস্কৃতির দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও ভারতীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা-অবস্থান গুরুত্বপূর্ন। কিন্তু এখানে ভারতীয়দের মধ্যেও বাঙালিরা সংখ্যালঘু। ভারতীয় সুখি বাঙালিরা হয়তো নিজের দেশের অন্য ভাষাভাষিদের তুলনায় দেশ থেকে বেরিয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত সেভাবে আসতে চাননি, হয়তো ঝামেলা মনে করেছেন, নয়তো দেরি করে বেরিয়েছেন। সে যাই হোক এখানেও বাংলাদেশি বাঙালি-ভারতীয় বাঙালিরা হরিহর আত্মা। পুজো, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এরা একসঙ্গে পালন করেন। আরেকটা দিনের অপেক্ষায় সবাই থাকেন সারাটি বছর। অলিম্পিক পার্কের বৈশাখী মেলার। বিদেশ বিভুঁইয়ে পুজোর মতো সবার বাহারি শাড়ি-পাঞ্জাবি পরার এ এক মস্ত সুযোগ।

এই মেলার বয়স এবার পঁচিশে পড়েছে।প্রথম প্রথম এখানে সেখানে নানা  ভেন্যুতে চললেও গত টানা ১২ বছর ধরে মেলাটি হচ্ছে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। যার শুধু একদিনের ভেন্যু ভাড়াই এক লাখ ডলার। এখানকার আরও যত আয়োজন টিকেট বিক্রি, লাইট-সাউন্ড সহ সব ব্যবস্থাপনা অলিম্পিক ভেন্যুর ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানির মাধ্যমে করাতে হয়। জনেজনে গাড়ি পার্কিং’এর জন্যেও আলাদা গুনতে হয় তিরিশ-চল্লিশ ডলার। মোট কথা কোন একটি পরিবার মেলায় রওয়ানা হলে তাদের দেড়-দু’শো ডলার খরচ হয়ে যায়। টাকাটা বড় নয়, এ মেলা নিয়ে সবার বার্ষিক আবেগটা অনেক বড়। পৃথিবীর দু’শোর বেশি দেশ-জাতি-ভাষাভাষি মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। ভেন্যুর ব্যয় চিন্তা করে এখানকার আর কোন জাতি-সম্প্রদায় অলিম্পিক পার্কে তাদের কোন কর্মসূচি পালনের সাহস করেনি। আর বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখী মেলা টানা ১২ বছর ধরে অলিম্পিক স্টেডিয়ামেই চলছে! অলিম্পিক ভিলেজের সিইও চার্লস মোরে বললেন কোন সম্প্রদায় তাদের কোন একটি উৎসব ১২ বছর ধরে অলিম্পিক পার্কে করে আসছে এটি তাদের কাছেও একটি রেকর্ড।

এবং এই মেলাকে কেন্দ্র করে তিন মাস আগে থেকে মহড়া করেন অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মীরা। মা-বাবা তাদের বাচ্চাদের কোন একটি নতুন গান গাইতে বা নাচ নাচতে শেখান। প্রতি বছর একজন অতিথি শিল্পীকেও আমন্ত্রন করে নিয়ে আসা হয়। গতবছর এসেছিলেন নচিকেতা। এবার বাংলাদেশ থেকে এসে গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর কুমার। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় বিশেষ করে কত বাঙালি ছেলেমেয়ে যে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত, যাদের বেশ ক’টি ব্যান্ড দল আছে, ফ্যাশন শো’র সঙ্গে জড়িত কত ছেলেমেয়ে তা এ মেলায় যারা আসেননি তারা ধারনা করতে পারবেননা।

সিডনির অলিম্পিক পার্কের বৈশাখী মেলাকে বলা হয় বাংলাদেশের বাইরে উন্মুক্ত স্থানে সবচেয়ে বড় বাঙালি সমাবেশ! বিদেশের পুজো থেকে শুরু করে বেশিরভাগ অনুষ্ঠান হয় মিলনায়তনের ভিতরে। আর এই বৈশাখী মেলার অনুষ্ঠান-সমাবেশটি হয় স্টেডিয়ামের উন্মুক্ত স্থানে। আরও গুরুত্বপূর্ন হলো এখানে যারা আসেন তাদের কেউ ফ্রি মেলায় ঢোকেননা। লাইনে দাঁড়িয়ে বা আগেভাগে অনলাইনে টিকেট কেটে ঢোকেন। এরজন্য মেলায় কত লোক এসেছেন সে হিসাবটিও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদ অস্ট্রেলিয়া সিডনির এই আলোড়ন তোলা আয়োজন বৈশাখী মেলার আয়োজক। এ সংগঠনের সভাপতি শেখ শামীমুল হক আমাদের বলেছেন এবারের মেলায় কুড়ি হাজারের বেশি মানুষ এসেছেন। বাঙালি ছাড়াও প্রতিবারের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য অস্ট্রেলিয়ানও যোগ দিয়েছেন মেলায়।

বৈশাখী মেলা উপলক্ষে প্রতিবছর কোন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু পদক। এবার এই পদক দেয়া হয়েছে সিডনির বিখ্যাত চিলড্রেন হসপিটালকে। শিশু চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার এই হাসপাতালকে সম্মাননাট দিয়েছে সিডনির বাঙালিরা। এর থেকেও প্রমান মিলে প্রশান্তপাড়ের দেশটায় বাঙালির উজ্জ্বল অবদান চিন্তার। চিলড্রেন হসপিটালের আধিকারিক মহিলা পদক গ্রহনের পর তার বিস্ময় আবেগ লুকোচাপা রাখেননি। আরেকটি মজার ঘটনা ঘটে এ মেলাকে ঘিরে। অস্ট্রেলিয়ার সাধারনত উন্মুক্ত স্থানে রাজনৈতিক সভা মিছিল হয়না বা এসবে যোগ দেবার মতো মানুষের সময়ও নেই। কিন্তু এই মেলাকে কেন্দ্র করে এক জায়গায় এত মানুষ পেয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান রাজনীতিকরা এখানে আসার-বক্তৃতা দেবার সুযোগটি হাতছাড়া করেননা। এবারও মেলার সুভেন্যুরে শুভেচ্ছা বানী দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল ও বিরোধীদলের নেতা বিল শর্টন। স্থানীয় ফেডারেল সহ প্রাদেশিক এমপি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এখানে বক্তৃতা দিতে এসে বাঙালিদের ভাঙ্গা বাঙলা উচ্চারনে বলেছেন, ‘শুভা নববর্ষা’!

এবারের মেলায় নতুন সংযোজন ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ উপলক্ষে ঢাকার চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশ সহ নানাকিছু আনানো হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মেলার মঞ্চে একটি পথ নাটক মানুষের মন ছুঁয়েছে। অন্যবার মেলার শেষে আতশবাজির আয়োজন করা হতো। এবার করা হয় লেসার শো। সব মেলার মতো এখানকার মেলাতেও খাবারের স্টলের এলাকাটি বড়সড় জমজমাট থাকে। বাঙালির যা খাওয়াদাওয়া সব পাওয়া যায় এ মেলায়। এমন কী ফুচকা-চটপটি পর্যন্ত। মেলা শেষে পার্কিং এর লিফটে চড়ে আটতলায় যেতে যেতে এক দম্পতির কথা কানে আসে। স্ত্রী তার স্বামীকে বলছিলেন লুচি-লাবড়াটা এমন স্বাদ হয়েছে না একবারে কলকাতার পুজোর কথা মনে পড়ে গিয়েছে। এই হচ্ছে সিডনির বাঙালিদের প্রাণের মেলা।


Place your ads here!

Related Articles

সংসদ নির্বাচনের বিজয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অস্ট্রেলিয়া এক বিশাল বিজয় উৎসবের আয়োজন করে সিডনীতে

প্রেস রিলিজ : তারিখ: ০২/০১/২০০৯ আওয়ামীলীগের যুগান্তকারী বিজয় একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে প্রবাসী বাঙালীদের। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনের বিজয়ে

সিডনি একুশে বই মেলা ২০১৮

১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮; সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৬.৩০ Ashfield Park, Ashfield, Sydney.

Press release on the special community meeting organised by Bangla Proshar Committee

Press release on the special community meeting organised by Bangla Proshar Committee. The meeting was held on 11 May 2013

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment