বিচার বিভাগ যে স্বাধীন নয় এর বড় ভিকটিম আপনি, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী

বিচার বিভাগ যে স্বাধীন নয় এর বড় ভিকটিম আপনি, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী

ফজলুল বারী: দেশে শাসন বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের অস্বাভাবিক সম্পর্ক চলছে। বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীন নানা বিষয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রনাথ সিনহা। এতদিন এর জবাব দিচ্ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আইনমন্ত্রী ক্ষান্ত হবার পর সংসদে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! এর পরদিনই আবার কোর্টে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে এটর্নি জেনারেলের। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলো অস্বাভাবিক এবং ভালো নয়। কারন বাংলাদেশের রাজনীতি, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন-বিচার বিভাগের নানাকিছু পাকিস্তানি ব্যবস্থার উত্তরসূরী। স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও নানাকিছুতে এখনও পাকিস্তানি গন্ধ এবং আছর। আবার প্রধান বিচারপতির কথাবার্তায় সত্যতা আছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ঝুলিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তি জীবনে এই বিচার বিভাগ আর আমলাতন্ত্রের বড় ভিকটিম। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এই বিচারালয়ের স্বাধীনতার কথা বলতে বলতে এতদূর এসেছেন। তার বাবা সিরাজুল হকও কথাগুলো বলতেন। প্রধানমন্ত্রী-আইনমন্ত্রী দু’জনেই এখন আমলাদের ব্রিফিং অনুসারে বক্তব্য দিচ্ছেন!

দেশের নানাকিছুতে এখনও পাকিস্তানের গন্ধের কথা বলছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে দেখুন পাকিস্তানের কথা মনে পড়ে যাবে। সেখানকার প্রশাসনিক পরিস্থিতি দেখলে পাকিস্তান পাকিস্তান লাগবে! স্বাধীনতার আগে সেনা পোশাক দেখলে বাঙালিদের মনের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হতো এখন সেখানে তা হয় পাহাড়িদের। সচিবালয়ের নানাকিছুতে এখনও পাকিস্তানি ছায়া। এমনকি সুপ্রীমকোর্টেও! সামরিক শাসক জিয়া-এরশাদের শাসনকালকে অবৈধ ঘোষনা করেছিল সুপ্রীমকোর্ট। আবার এই সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতিরাই অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জিয়া এরশাদকে শপথ পড়িয়েছেন!জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খুনি মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ পড়ান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন অবসর গ্রহনের পর বুদ্ধিজীবী হয়ে যান! অথচ কর্নেল তাহেরের ফাঁসি ঠেকাতে তার কাছে গিয়ে প্রধান বিচারপতি হিসাবে তার এক্তিয়ার প্রয়োগের কথা বললে তিনি তাতে রাজি হননি। অর্থাৎ বিচার বিভাগের লোকজন মানে ফেরেস্তা না।

সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিরা অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জিয়া এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, এমনকি উপজেলা চেয়ারম্যানও হন। জিয়া এরশাদের ক্ষমতা জায়েজ করতে ভোটারবিহীন নির্বাচন হয় বিচার বিভাগ থেকে আসা সেই সব জ্ঞানপাপী ব্যক্তিদের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সবার শুদ্ধতা চায়। দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলে। কিন্তু নিজেদের এসব অশুদ্ধ, দুষ্টগ্রহদের নিয়ে কিছু বলেনা। আবার বাংলাদেশের অনেক ভালো কিছুও এসেছে বিচার বিভাগের মাধ্যমে। বিচারালয়কে এখনও শেষ আশ্রয় ভাবেন বেশিরভাগ মানুষ। যদিও দরিদ্র মানুষজনের এই আশ্রয় পাবার সুযোগ খুবই কম।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রনাথ সিনহা এখন বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সমস্যা নিয়ে তার অসন্তোষের কথাগুলো বলছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সমস্যাটি বাংলাদেশের আজকের দিনের সমস্যা নয়। সব রাজনৈতিক দল বিরোধীদলে থাকতে এই স্বাধীনতার কথা বলে। ক্ষমতায় গেলে করে উল্টো আচরন। এটা এক সময় বিএনপি করেছে। এখন করছে আওয়ামী লীগ! দেশে থাকতে আমি সুপ্রীমকোর্টেও রিপোর্টের জন্যে যেতাম। রিপোর্টার-আইনজীবীদের সঙ্গে তখন চমৎকার একটি সম্পর্ক ছিল। পরিচিতরা কোর্টের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মজা করে দেখিয়ে বলতেন, এটা আওয়ামী লীগের কোর্ট, এটা বিএনপির কোর্ট! জামিন সহ নানাকিছুর জন্যে আইনজীবীরাও এভাবে কোর্ট বুঝে যেতেন! আজকের অবস্থায় নিশ্চয় সেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিভেদও নেই। মাসদার হোসেন মামলাকে কেন্দ্র করে সুপ্রীমকোর্ট শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়। কিন্তু সরকার যদি তা মানে প্রধান বিচারপতিতো সংশ্লিষ্টদের দড়ি বেঁধে কোর্টে নিয়ে আসতে পারেননা। সেই মামলার আইনজীবী ব্যারিষ্টার আমির উল ইসলাম যেহেতু আওয়ামী লীগ করেন বিষয়গুলো নিয়ে এখন আর সেভাবে কথা বলেননা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে নিশ্চয় বলতেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, এর আগে কোন বিচারপতি এভাবে প্রকাশ্যে কোন বলতেননা। দিন বদলেছে আনিসুল হক সাহেব। যৌবনে আপনি যখন আপনার পিতার চেম্বারে জুনিয়র হিসাবে যোগ দিয়ে আইন পেশায় নামেন, আপনার পিতা তখন এরশাদের জাতীয় পার্টি করতেন। তখন কী ভেবেছেন কোনদিন এভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়ে যাবেন? আগে শাসন বিভাগ-বিচার বিভাগ তুলনামূলক অনেক রক্ষনশীল ছিল। বিচারপতি মোস্তফা কামাল প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে যাবার পর এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা। তার কাছে গিয়ে বললাম, আপনাকে সব সময় এজলাসে অনেক দূর থেকে দেখেছি স্যার। কখনো এত কাছে থেকে দেখিনি। মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের ছেলে শিল্পী নাশিদ কামালের বাপ বিচারপতি মোস্তফা কামাল খুব রস করে কথা বলতেন। আমাকে তখন্ মজা করে বলেন, এখন মাটিতে নেমে এসেছি। গল্প করা যাবে। আর এখনতো অনেক রিপোর্টারও বিচারপতিদের খাস কামরায় গিয়ে গল্প করেন। পরিবর্তিত সময়ে সারা দুনিয়ার প্রধান বিচারপতিরাও নানা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেও আজকাল বিচার কার্যক্রম চলে। রায় লাইভ সম্প্রচারও হয়। ডিজিটাল যুগের মন্ত্রী আনিসুল হক এতে কেন ইতস্তত বোধ করেন? কথা বলার সব পিভিলেজ কী শুধুই তাদের?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সংসদে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে কথা বলছিলেন ভয় করছিল। কারন তারা একটা আইন পাশ করেছেন যে যেখানে নেই তার ব্যাপারে সেখানে কথা না বলা। প্রধান বিচারপতি সংসদে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব দিতে পারবেননা। এখন অন্যত্র দেবেন। এটা আরও অসুন্দর হবে। শেখ হাসিনা বলছেন খালেদা জিয়া কোর্টে ১৪০ বার সময় নিয়েছেন। কোর্ট সময় দিয়েছে। অতএব বিচার বিভাগ স্বাধীন! সত্যি কী তাই? না সরকার খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারে আগ্রহী নয়? খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এর আগে জারী হওয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা কোর্ট থেকে থানা পর্যন্ত পৌঁছেনা বা থানা শুধু পাইনি পাইনি বলে, এ ঘটনা কী সবাই ভুলে গেছে? খালেদা জিয়ার আইনজীবী দল কতোটা সংঘদ্ধ, সুশৃংখল আর সরকার পক্ষের দলটি কতটা মাজুল এবং বিশৃংখল? এসব কেনো? নিশ্চয় এসবের পিছনে কোন একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে।

বাংলাদেশে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা যে নেই শেখ হাসিনার চাইতে এর বড় ভিকটিম কে আছে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার বিচার শুরু করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আবার যখন ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে চলে গেলেন তখন এ বিচার প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়া হয়। ওয়ান ইলেভেনের সরকার আসার পর শেখ হাসিনাকে প্রথম গ্রেফতার করা হয়। ক্ষমতায় ছিলেন খালেদা জিয়া, কিন্তু আগে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে একের পর এক মামলা দেয়া কেনো? বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে কী এটা করতো। আর যে বিচার বিভাগ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শপথ পড়িয়েছে, সেই বিচার বিভাগই আবার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি দিয়েছে। বিচার বিভাগ কী সময় দেখে বিচার করে না আইন দেখে? এরশাদের বিরুদ্ধে একেরপর এক শাস্তি হলো, আর এখন এরশাদ বিচার বিভাগের মাধ্যমে খুবসুরত ফুলের মতো পবিত্র হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন! এসবকে স্বাধীনতা কী বলা চলে প্রিয় প্রধানমন্ত্রী? প্লিজ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসুন। বিষয়গুলোর সুরাহা করুন। প্রধান বিচারপতি সৎ মানুষ বলে এমন খোলাখুলি কথা বলছেন। দুর্নীতিবাজরা এভাবে কথা বলতে পারেনা। দ্রুত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টির ফয়সালা করুন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী। নতুবা আবার কোনদিন আপনি এর ভিকটিম হবেন। আরেকটা কথা প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, মিডিয়া খারাপ, অমুক খারাপ, তমুক খারাপ, শুধু আমরা ভালো এটি কী কোন আধুনিক সময়ের নেতার দৃষ্টিভঙ্গি? ভালোমন্দ নিয়েইতো আমরা সব মানুষেরা।


Place your ads here!

Related Articles

বহে যায় দিন – একবার যেতে দে না আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়

> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব > ।। চার ।। একবার যেতে দে না আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয় ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে

বড়ু ভড়ু নড়ু

অদ্ভুতুড়ে শিরোনাম। চমকে যাওয়ার কথা। সত্যি তো! ইংরেজী বাংলা অক্ষর সাজিয়ে বা মিলিয়ে কি কথা বলার বা ভাষণ দেওয়ার চেষ্টা

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment