বাংলাদেশের চিরায়ত ভারত বিরোধী রাজনীতি
ফজলুল বারী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন ৭ এপ্রিল। এটি এখনকার রাজনীতির মূল ফোকাস। বিএনপি প্রায় প্রতিদিন এই ভারত সফর নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি হবার কথা। কিন্তু বিএনপি প্রতিদিন বলছে এ চুক্তি তারা করতে দেবেনা। এটি গোলামির চুক্তি হবে। খালেদা জিয়াও শনিবার দলীয় সাংবাদিক সাক্ষাতে বলেছেন ভারতের সঙ্গে ওই চুক্তি তারা করতে দেবেননা। এমন রাজনৈতিক বক্তব্যকে আমি গুরুত্ব দিতে নারাজ। কারন খালেদা জিয়া বলেননি বা বলবেন না যে তারা ক্ষমতায় যেতে পারলে এমন চুক্তি হয়ে থাকলেও তারা তা বাতিল করবেন। ক্ষমতায় যেতে পারলে তেমন চুক্তি তারা বাতিল করবেনওনা। কেনো নয় তা খালেদা জিয়া জানেন। সবাই জানেন। পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিয়ে এর বড় একটি প্রমান সবার হাতে আছে। ওই চুক্তির বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া লং মার্চের নামে গাড়ি মার্চ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওই চুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে! ওই চুক্তির পরও খালেদা জিয়া তার ফেনী আসন থেকেও নির্বাচন করে এমপি হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। ফেনী পর্যন্ত ভারতও হয়নি। পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে তিনি এক রকম নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন। কিন্তু বাতিল করতে পারেননি।
বাংলাদেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে এখন এমন নানান রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতির সম্পর্ক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সহায়ক দেশ ভারত। একাত্তরে প্রাণ বাঁচাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে একাত্তরে এককোটির বেশি বাঙালি শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। উদার গণতান্ত্রিক দেশ ভারত তখন এসব বিপদ্গ্রস্ত প্রতিবেশীদের আশ্রয়-খাবার-চিকিৎসা দিয়েছে। প্রশিক্ষন-অস্ত্র দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। এসব করতে গিয়ে তার দেশে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল চরমপন্থীরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার এগারো হাজারের বেশি সৈনিকের প্রান গেছে।আখাউড়া থেকে পাকিস্তানি বোমা ছুঁড়লে আগরতলা শহরের মানুষজন হতাহত হতো। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে আজ গণভোট নিতে গেলে দেখা যাবে ভারত বিরোধীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ! এমনকি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পচাত্তরের তিন নবেম্বর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফকে ভারতপন্থী বদনাম দিয়ে এখানকার সামরিক বাহিনীর লোকজন হত্যা করেছে! মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা সহ এসব তথ্যের জবাবে এখনও এখানকার পাকিস্তানি পক্ষ বলে ভারততো তার স্বার্থ ছাড়া সহায়তা করেনি। তাতো বটে। কারন ভারত কোন রামকৃষ্ণ মিশন না। বাংলাদেশও আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম না। আমাদের স্বার্থে আমরা ভারতে গেছি তাদের সাহায্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। ভারতও সাহায্য করেছে তাদের স্বার্থে।
বাংলাদেশে ভারত বিরোধী রাজনীতি নিয়ে মজার কিছু অভিজ্ঞতা বলি। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন নৃপেন চক্রবর্তী। ওই নির্বাচনের আগে নৃপেন চক্রবর্তী ঢাকা আসেন। ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে বসে আমাদের কয়েকজন সাংবাদিককে বলেন বিএনপি ক্ষমতায় যাচ্ছে। নির্বাচনে যখন বিএনপি জিতলো তখন নৃপেন চক্রবর্তীর কথা খুব মনে পড়ে। পরে একবার আগরতলা গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি, দাদা বিএনপি যে ক্ষমতায় যাচ্ছে এটি এমন আগাম কী করে বলেছিলেন। নৃপেন বাবু কোন রাখঢাক ছাড়াই বলেন ঢাকা গিয়েই খবর পেলাম ইন্ডিয়ান মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা হাইকমিশনের মাধ্যমে বিএনপির ইলেকশন ফান্ডে টাকা দিচ্ছে। তখনই বুঝতে পারি ইন্ডিয়ান মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা বিএনপিকে ক্ষমতায় চাচ্ছে! এটা কেন?
এর উত্তর নৃপেন বাবু আমাকে দেননি বা দিতে পারেননি। এর উত্তর পর আমি বিভিন্ন সময়ে ভারতে রিপোর্ট করতে গিয়ে খুঁজে নিয়েছি। বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের বড় একটি বাজার। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ঠান্ডামাথায় ব্যবসা করতে ঢাকার ক্ষমতায় সব সময় বিএনপির মতো কোন ভারত বিরোধী দলকে চায়! ভারতপন্থী দল ক্ষমতায় থাকলে শক্তিশালী ভারতবিরোধী দল রাস্তায় থাকলে তাদের ব্যবসায় অসুবিধা হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এখানে ভারতীয়রা কী সুবিধা পায় তা আমরা গত বিএনপি আমলে দেখেছি। এখানে ভারতীয় গাড়ির একচেটিয়া সুবিধা দিতে তখন জাপানি রি-কন্ডিশনড গাড়ি আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তখন এখানে ভারতীয় গাড়ি সহ নানা ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করতেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আজকের প্রয়াত কোকো। এভাবে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা চাইতো বলে বিএনপি ক্ষমতায় আসতো এমন ঢালাও মন্তব্যও আমি করবোনা। তবে এটা ওয়াকিফহালরা জানেন বাংলাদেশে ক্ষমতায় যেতে-থাকতে ভারতীয় আশীর্বাদ লাগে।
বিএনপি গতবার ক্ষমতায় থাকতে ঢাকায় অনুপ চেটিয়াদের আশ্রয়দান, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান এই দুই ঘটনায় ভারতীয়দের আস্থা হারিয়েছে। এই আস্থা ফিরে পেতে তারা মরিয়া সব চেষ্টাই করে যাচ্ছে। যেহেতু কংগ্রেসের সঙ্গে শেখ হাসিনার পারিবারিক সম্পর্ক সে কারনে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর আশায় লাফিয়েছে বিএনপি। সেই আশা গুড়েবালি হবার কারন ভারতীয় চাণক্য কূটনীতির আস্থা ফিরে পায়নি বিএনপি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিরোধ আন্দোলনের সময় বিজেপির নেতা অমিত শাহ খালেদাকে ফোন করেছেন এমন একটি প্রচারও ছড়ানো হয়। কিন্তু অমিত নিজে বিষয়টিকে অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিলে সে বেলুনটিও ফুটো হয়ে যায়। কিন্তু ভারতীয়দের আস্থায় আসতে বিএনপির চেষ্টার শেষ নেই। পথ পাচ্ছেনা বলে পথহারা পথিকের মতো ছড়িয়ে চলেছে পুরনো ভারত বিরোধিতা।
এখন শেখ হাসিনার সফর প্রসঙ্গে আসি। এই সফরে বাংলাদেশের বড় চাহিদা তিস্তার পানিচুক্তি। এখনও সে আশার সলতের দেখা নেই। পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জির বাধায় তিস্তা চুক্তি হচ্ছেনা এটি প্রচারিত কথা। মমতা বাংলাদেশের কেউ নন। তিনি তার রাজ্যের স্বার্থ দেখবেন আগে এটিও খুব স্বাভাবিক। শুকনো মওসুমে তিস্তার ভারতীয় অংশেও এখন পর্যাপ্ত পানি থাকেনা। কারন তিস্তা সহ ভারত হয়ে বাংলাদেশে ঢোকা নদী সমগ্রের উৎস দেশ চীন। আর আমাদের এপাশে যেমন নদনদী শুকিয়ে ভরাট হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও তথবৈচ। কোনদিন তিস্তা চুক্তি হলে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাবে সে গ্যারান্টিও নেই। মিয়ানমার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেবেনা বুঝে ফেলে বাংলাদেশ যেমন তাদেরকে ঠ্যাঙ্গারচর নিয়ে যেতে চাইছে তেমন তিস্তা সহ অভ্যন্তরীন নদনদীর সংস্কার-বর্ষা মওসুমের পানি জমা রাখার জলাধার সৃষ্টির বিষয়ে বাংলাদেশের চিন্তাভাবনা করা উচিত। একদিন না একদিন এটি করতেই হবে। ভারতীয় সীমান্তে হত্যাকান্ড বাংলাদেশের আরেক স্পর্শকাতর ইস্যু। এ নিয়ে ভারতীয়দের ভূমিকা যেমন গ্রহনযোগ্য নয় আরেক সত্য আমাদের এখানে চেপে যাওয়া হয়। সীমান্তে যারা মারা পড়ছেন তারা মূলত গরু চোরাচালানী, তাদের লোকজন অথবা অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ ইচ্ছুক। আমাদের লোকজন কেন আরেক দেশের সীমান্ত দিকে এভাবে অনুপ্রবেশ করতে চাইবে এ দায়িত্ব আমাদেরও আছে। আমাদের দেশের সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় বা অন্য কারো অনুপ্রবেশ কি আমরা পছন্দ করি?
প্রতিরক্ষা অথবা সামরিক সহায়তা চুক্তি ভারত চায় চীনকে একটি বার্তা দেবার জন্যে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অস্ত্র-গোলা বারুদ সবচেয়ে বেশি কেনা হয় চীন থেকে। সর্বশেষ কেনা হয়েছে সাব মেরিন। রাশিয়া থেকে কেনা হচ্ছে যুদ্ধ বিমান। এর একটিও আমার পছন্দের না। কারন বাংলাদেশের দরকার মানব সম্পদের উন্নয়ন। এসব টাকা আমরা শিক্ষাখাত, কৃষিখাতে বিনিয়োগ করে আমরা অনেক বেশি ফল পেতে পারি। আর বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা এসব কেনাকাটার সঙ্গে দূর্নীতির প্রেম থাকে। সে জন্যে প্রতিটা সরকারের পরিবর্তনের পর প্রথম যে সব মামলা হয় তা সামরিক ক্রয় সংক্রান্ত। কিন্তু সব দেশের সরকারি লোকজনের বিশেষ কিছু ইগো ব্যারাম থাকে। বাংলাদেশে সরকারি নেতাদের আবার নানাকিছুতে সামরিক বাহিনীর লোকজনকে খুশি অথবা আস্থায় রেখে চলতে হয়। এখন নানা কিছুতে ভারতীয় আস্থা ধরে রেখে ভারত যদি বলে তোমরা চীন থেকে কিনতে পারো, রাশিয়া থেকে কিনতে পারো আমারটা কিনবেনা কেন বললে বাংলাদেশ সরকারের তাতে না করাটা সহজ নয়।
প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আরেক দফা থাকার কথা তাহলো ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রয়োজনে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সৈন্য-সামরিক সরঞ্জামাদি নিয়ে যেতে পারবে। বিএনপি বলা চেষ্টা করছে এতে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে বাংলাদেশের। আমি তাও মনে করিনা। কারন এর আগে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পচিশ বছরের মৈত্রী চুক্তি ছিল। সেটিতেও এমন একটি ধারা ছিল। সেই মৈত্রী চুক্তিকে কেন্দ্র করে একবার আমরা বিচিন্তায় ‘বাংলাদেশ অভিমুখে ভারতীয় সৈন্য’ শিরোনামের একটি প্রচ্ছদ কাহিনী করেছিলাম। ওই মৈত্রী চুক্তি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে এখানকার পাকিস্তানিরা। ভারতীয় সৈন্যরা কি তখন বাংলাদেশ অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছে? পঁচিশ বছরের মৈত্রী চুক্তিকে গোলামীর চুক্তি বলে বিএনপি এ নিয়ে অনেক রাজনীতি করেছে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে সে চুক্তি কি তারা বাতিল করেছে? এখন আবার তেমন একটি চুক্তি সরকার করলে বিএনপি কোনদিন সুযোগ পেলেও তা বাতিল করবেনা। কারন তাতে যে লাবন্যের বিরুদ্ধে ক্ষেপবে অমিত। লাবন্যতো অমিতকে ক্ষেপাতে চায় না। সুসম্পর্ক চায়।
ভারত যাবার আগ মূহুর্তে এক পশলা ভারত বিরোধী রাজনীতি শেখ হাসিনাও করে ফেলেছেন! প্রকাশ্য সভায় তিনি বলেছেন ২০০১ সালে ভারত তথা র’ তাকে ক্ষমতায় ফিরতে দেয়নি! ঢাকাস্থ র’র প্রধান হাওয়া ভবনে বসে থাকতো, ইত্যাদি! হঠাৎ শেখ হাসিনার মুখে এই সুর কোন টানাপোড়েন না দরকষাকষি তা শেখ হাসিনা এবং ভারত জানে। সাংবাদিক হিসাবে আমার পর্যবেক্ষন ভারত তথা র’ ঢাকায় তাকেই রাখতে-দেখতে চায় যে তাকে ব্যবসা দেবে। দুনিয়া এখন বদলে গেছে। এখন আর বুদ্ধিমান দেশ আরেক দেশ দখল করতে যায়না। বাজার দখল করে। বাংলাদেশের বাজারতো ভারতের দখলে আছেই। আর যত টানাপোড়েন চলুক ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্কটা আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গেই হবে। যেমন বিএনপি বা খালেদার সঙ্গে পাকিস্তানের যে সম্পর্ক তা কখনো আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার সঙ্গে হবেনা।
ফজলুল বারীঃ বাংলাদেশের একমাত্র পরিব্রাজক সাংবাদিক। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
Related Articles
Article on Bangladesh by Nirbodh 3rd part
বাংলাদেশ বার বার ঘুইরে মাগুড় চ্যাং – এর গভীর শিকড় কোথায়? (৩য় পর্ব) অনেকেরি সংশয় কাটে না যে বাংলদেশের কালা
আগে দর্শণধারী পরে গুণবিচারি
এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে আকার এবং বর্ণের এত বৈচিত্র যা পৃথিবীর অন্য কোথাও মনেহয় দেখা যায় না। এর জন্য অবশ্য
প্রবাস জীবনঃ সংস্কৃতির চর্চা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক
আমি ২০০৪ সালের মাঝামাঝিতে চাকরী নিয়ে ক্যানবেরা আসি। প্রবাস জীবনে বাংলাদেশীদের সাংস্কৃতিক হালচালের সাথে পরিচয় বলতে যা বুঝায় তার সবটাই