ডিসেম্বরের ২৪শে বাসে

ডিসেম্বরের ২৪শে বাসে

দিলরুবা শাহানা: আরমিন এমনি এক ২৪শে ডিসেম্বরে বাসে উঠলো। তিনদিন বেড়ানোর পর ঘরে ফেরা। সঙ্গে রয়েছে বন্ধুরা। আলেক্স, রিউবেন, অভি। বড়দিন আরমিন অভির জন্য বড় কোন বিষয় নয়। তবে চারপাশের সবাই এই উৎসব উদযাপনে এতো মাতোয়ারা হয়ে উঠে যে তার কিছুটা ওদেরও কোনও না কোনভাবে ছুঁয়ে যায়। চারজনের প্রত্যেকেই যার যার মত নিঃশব্দে কিছু ভাবছিল। রিউবেন ভাবছিল অভির কথা। মাছমাংশ ছাড়া এই ছেলের শরীর স^াস্থ্য এতো ভালভাবে টিকে আছে কিভাবে? বিস¥য় লাগে বিষয়টা। এই তিনদিনই সে ঘর থেকে আনা ছোলা ও চাপাতি রুটি খেয়ে কাটিয়ে দিল। এই খাবারটা ওর মা নাকি নিজহাতে বানিয়ে দিয়েছে। দোকান থেকে কেনা রুটি-মাখন, পনির, ফল সে খেয়েছে বাস আর কিছু নয়। রিউবেনেরও কিছু মানামান্তি আছে তবে ভেজেটেরিয়ানদের মত সারাজীবন খাবার বাছাবাছির মানতি তার নাই। আরমিনকেও খেয়াল করে দেখেছে সে। খেতে ভালবাসে ছেলেটা। তবে বড় কষ্টে শুয়োরের মাংস খাওয়া থেকে নিজেকে সংযত রেখেছে। রিউবেন মনে মনে খুশি হয়েছে ওরা না খাওয়াতে। আলেক্স ভাবছে অন্যকথা। এই তিনদিনে যা খরচ হবে চারজনে সমান ভাগে সে খরচ বহন করবে কথা এমনি। এরমাঝে একজন খায়না মাছ-মাংশ অন্যজন মদের ব্যাপারে সাবধানী। আলেক্স স্বাস্থ্যসচেতন হওয়াতে পোয়াবারো হয়েছে ভোজনরসিক কিপ্টা রিউবেনের। আরমিন লক্ষ্য করেছিল রিউবেন অভির ভেজেটেবল্ খাওয়া নিয়ে কিছু একটা কটাক্ষ করাতে আলেক্স কিভাবে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল
‘চুপ কর, ওর ধর্মে মাছ-মাংশ নিষেধ আর তোর ধর্মেতো সপ্তাহে একদিন কিছু কেনা যাবে না। সেটাই কি এমন ভাল? মনে আছে গত সামারে ইঊরোপে গিয়ে সপ্তাহের সেদিনগুলোতে আমার খাবার সাবাড় করেছিস তুই, বেটা ঘাগু।’
মিনমিন স^রে রিউবেন বলেছিল
‘কি করবো বল ধর্মের মানা।’
আরমিন দেখেছিল সেই মূহূর্ত্যে রিউবেনের দিকে চেয়ে কি রকম তাচ্ছিল্যের হাসি আলেক্স হেসেছিল।
হঠাৎ এক উচ্চকন্ঠী মহিলা বাসে সবার মনোযোগ কাড়লো।
বাসের দরজার কাছে সামনের আসনে বড়জোর বছর দশের একটি ছেলেকে বসিয়ে মহিলা তর্জনি নেড়ে কিছু বলছে। ছেলেটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে
‘না না মা আমি খ্রীস্টমাসে তোমার কাছে থাকবো বাবার কাছে যাবোনা’
গর্জে উঠে উচ্চকন্ঠী
‘না এবার খ্রীস্টমাসে তোমার বাবা তোমার দেখভাল করার কথা’
‘মা শোন প্লিজ মা আই মিস ইউ এ লট মম্!’
‘জানি কিন্তু কিছু করার নাই, গতবছর খ্রীস্টমাসে তুমিতো আমার কাছেই ছিলে সোনা, আর শোন ড্রাইভার তোমাকে স্টপেজে নামাবে ওখানেই বাবা তোমার জন্য থাকবে’
বলেই মহিলা যেই ড্রাইভারকে কিছু বলার জন্য ঘুরে দাড়িয়েছে অমনি ছেলেটি চট্ করে বাস থেকে পিছনের দরজা দিয়ে নেমে পড়লো। ব্যাপারটা নজরে আসতেই মহিলাও ছেলেকে ধরার জন্য বাস থেকে ঝট্পট নেমে গেলো।
অভি আরমিনের কানে ফিসফিস করে বললো
‘দেখ মহিলার কান্ড ওইটুকু বাচ্চাকে বাসে তুলে দিচ্ছে বাপের কাছে যাওয়ার জন্য!’
আরমিনও তেমনি ফিসফিস করে উত্তর দিল
‘আজকে বাসে বসে এই সমাজের অনেক কিছু জানা ও বোঝা হচ্ছে’
চোখের ইশারায় অভিকে সামনের আসনে বসা কিশোরকিশোরীকে দেখালো আরমিন।
সে এতক্ষণ সামনের আসনে বসা মেয়েটির টেলিফোনের আলাপ শুনছিলো। অভি তাকিয়ে দেখলো দুটি ছেলে-মেয়ে কখন যেন এসে বসেছে। বয়স পনেরো কি ষোল হবে হয়তো। কান পেতে শুনলো পুরো আলাপচারিতা। এখানেও মায়ের সাথেই কথা চলছিল। একেতো ওই ছোট ছেলেটির জন্য কি রকম এক অজানা মন খারাপ করা ঘনিয়ে উঠছিলো। এবার মায়ের কাছে কিশোরী মেয়েটির আঁকুতি শুনে আরও, আরও মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিজ নিজ মায়ের মুখটা মনে পড়লো দুজনের। মায়ের জন্য বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। আশ্চর্য আসার আগেরদিনই মায়ের সাথে খিটখিটে মেজাজে কথা বলেছে আরমিন। এই মেয়েটি বার বার ফোনে মাকে বলছে
‘মা আমি মেলবোর্ন সেণ্ট্রালে নামবো, বুঝেছো মা। এ্যান্ডিও আছে আমার সাথে। আমরা তোমার কাছে চারপাঁচ দিন থাকবো; কি? কি? হবে না কে…
‘——’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে সরি মা তোমাকে খুব দেখতে মন চাইছিল তাই না জানিয়ে এসে তোমাকে সারপ্রাইজ…
‘——’
‘ঠিক আছে দু’দিনই ঠিক, তোমার বন্ধুরা আসার আগেই আমরা তোমার বাড়ী ছেড়ে চলে আসবো। নাহ পয়সা নেই আমার। ফেরার গাড়ী ভাড়াটুকু আছে মাত্র।’
কথা শেষ করেই মেয়েটি এ্যান্ডির কাঁধ ধরে এক ঝাঁকুনি দিয়ে বললো
‘শোন এ্যান্ডি মা থাকতে দেবে দু’দিন ।’
আরমিন যতোটা না অবাক হল তারও চেয়ে বেশী দুঃখীত হল। কিশোরী মেয়েটিকে মা নিজ থেকে কাছেও ডাকেনি। অনাহুত মেয়েটি মাকে দেখবে বলে ৭/৮ঘণ্টা বাসে চড়ে মায়ের কাছে যাচ্ছে অথচ মা তাকে দু’দিনের বেশী থাকতে দিতেও রাজী নয়। আরমিনের মনে হল বাড়ী ফিরেই দেখবে তার কাপড়চোপড় ধোয়া, ঘর ঝকঝকে পরিস্কার আর তার অপেক্ষায় উৎন্ঠিত রাগদুঃখহীন মায়াময়ী মায়ের মুখ। বাসে বসেই ভাবলো মায়ের কাছে মাপ চাইবে, সরি বলবে। যদিও ইচ্ছে করছে বলতে ‘মা তোমাকে খুব ভালবাসি, খুউব!’ লজ্জা লাগছে। থাক কথাটা সে মনে মনেই বলবে।
এরমাঝে বাস চালকের ভয়ার্ত গলা একবারই শোনা গেল তারপর সব চুপচাপ। সামনের দৃশ্য দেখে বাসের যাত্রীরা সব ভয়ে আধমরা। মায়ে খেদানো সেই ছোট্ট ছেলেটি একহাতে জ্বলন্ত গ্যাস লাইটার অন্যহাতে গ্যাস স্প্রে কণ্টেইনার একটি নিয়ে ড্রাইভারকে ভয় দেখাচ্ছে।
আর ছেলেটির মা বাসের সিড়িতে দাড়িয়ে নম্র গলায় কিছু বলেই যাচ্ছে। কে শোনে কার কথা। এদিকে মাথায় পাগড়ি গালভর্তি দাড়ি নিয়ে ড্রাইভার ভয়ে আধমরা প্রায়।
এরমাঝে রেডিও-টিভিতে জোর খবর প্রচার হচ্ছে মেলবোর্নগামী একটি বাস টেরোরিস্টদের দখলে বা টেরোরিস্টরা কব্জা করেছে।
খবর প্রচার মাত্র পুলিশবাহিনী রওয়ানা দিল। চারদিক জুড়ে পুলিশ আর পুলিশ। তথ্য সংগ্রহ করা, ঘটনা বিশ্লেষণ করার আগেই দূর থেকে পুলিশের নজরে পড়লো দাড়ি-পাগড়ি সহ বাস ড্রাইভারকে। পুলিশের বদ্ধমূল ধারনা হল যতো নষ্টের গোড়া ওই দাড়িওয়ালা ড্রাইভার। বাসের দরজা দুটিই ছিল খোলা। আরমিন- অভিরা চুপিচুপি বাস থেকে পড়লো। ছোট্টছেলেটি এতো পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে হাতের লাইটার ও গ্যাস কণ্টেইনারটি ড্রাইভারের পায়ের দিকে ছুড়ে ফেলে বাস থেকে দৌড়ে নেমেই পালালো।
এদিকে গ্যাসের বিস্ফোরনে পুড়ে নীরিহ শিখ ড্রাইভারটি মারা গেল। নানা ধরনের খবর শোনা গেল। সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সবাই নিস্ফল ক্ষোভ ঝাড়লো। অভি, আরমিনরা প্রত্যক্ষ করেছিল আসল সত্য।
একবার খবর রটলো টেররিস্ট আক্রমণে ড্রাইভার নিহত।
আরেকবার খবর ছড়ালো জাতিবিদ্বেষের কারনে শিখ ড্রাইভারের মৃত্যু।


Place your ads here!

Related Articles

বাংলা ও বাংগালীর আত্মপরিচয়ে ১৬ই ডিসেম্বর

আত্মপরিচয় নিয়ে বর্তমান সময়ে মানুষ কিছুটা উদ্বিগ্ন। এই বিশ্বায়নের যুগে এমনটা হওয়ার কথা ছিল কি? বিশ্বায়নের যুগে মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য,

Rajon: I lose one more time…

A major challenge that children of migrants, at least of first generation, face growing up in a new country is

আমরা কি রাজাকার শব্দটাকে খুব হাল্কা আর খেলো করে ফেলছি?

উইচ হান্টিংয়ের মত “রাজাকার” শব্দটা যত্রতত্র ঢালাও ভাবে ব্যাবহার হচ্ছে? ইমরানকে রাজাকার বানানো হচ্ছে, আবার প্রজন্ম মঞ্চ থেকে কাদের সিদ্দিকির

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment