আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পতাকা যে নায়িকা প্রথম উড়িয়েছিলেন তিনি ববিতা

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পতাকা যে নায়িকা প্রথম উড়িয়েছিলেন তিনি ববিতা

যে কোন ছুঁতোয় একটা সিনেমা দেখা ফেলার ফন্ধি আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। সুযোগ পেলেই ধুমাইয়া সিনেমা দেখি। তা ও বাংলা সিনেমা। আমি বাংলা সিনেমা দেখতে ভালবাসি এটা বলার মধ্যে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। বরং গর্ব করেই বলি। যারা বাংলা সিনেমা দেখেন না বা বাংলা গান শুনতে অপছন্দ করেন, তারা অবশ্যই আধুনিক স্মার্ট, তবে – শিকড়হীন! অনেকটা পরগাছা স্বর্নলতার মত। না স্বদেশী, না বিদেশী! এ দু’টানায় নিজেদের কালচার-সংস্কৃতির বারোটা বাজে কখনো কখনো!

শিল্প বেচে অনেকেই বড় ব্যবসায়ী হয়। ইদানীং এ প্রবনতা মহামারি আকার ধারন করেছে। রাতারাতি নাম-দাম কিনে অনেকেই প্রযোজক হয়ে উঠেন। দৈহিক সৌন্দর্য্য পুঁজি করে রাস্তার মেয়েগুলা নায়িকা কেতাব পাওয়ার যুদ্ধে নামছে। অশিক্ষিত মূর্খ গুটিকয়েক তরুণ কানে দুল, গলায় এক মন ওজনের চেইন ঝুলিয়ে, অঙ্গে উল্কি এঁকে, ভুল ইংরেজি ও অশুদ্ধ উচ্চারনে বাংলার সংমিশ্রনে কথা বলে নিজেকে নায়ক হিসেবে জাহির করছে। আজব ভঙ্গিমায় কথা বললেই নায়ক/নায়িকা হওয়া যায়না – আজকের তথাকথিত আধুনিক প্রজন্মকে কে বুঝাবে এসব। গুটি কয়েক মুদি দোকানদার বা ধূর্ত দস্যু ইভেন্ট কারবারির কারসাজিতে আমরা যে সিনেমা দেখি সেটি সৃষ্টিশীল কোন নির্মাণ নয়। পাইরেসি ধান্দাবাজদের রেকর্ডকৃত যে গান শুনি তা সৃজনশীল নয়! আমাদের রত্নভাণ্ডার অনেক গৌরবের। অনেক সম্মানের।

আমি সিনেমা বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কেউ নই। আমার পরিচয় আমি একজন বাংলাদেশী। মনে প্রানে আমি বাংলাদেশটাকেই লালন করি।
৮০’র দশক।

বিনোদন বলতে একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভি। সেই সময়ে আমাদের একটি ক্যাসেট প্লেয়ার ও ছিল,এটিতে রেডিও ও বাজানো যেতো। সদ্য বিদেশ ফেরত একজন বিদেশ থেকে এনেছিলেন, আব্বু সেটি কিনে দিয়েছিলেন আমাকে। যে বছর আমি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিলাম সে বছরই আব্বু কিনে দিয়েছিলেন। আমাদের স্কুল থেকে মেয়েদের মধ্যে তখন আমি একাই বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমি গান শুনতে ভালবাসি, তাই আব্বু ভীষণ খুশী হয়ে আমাকে নিয়মিত গান শুনার সুযোগ তৈরি করে দিলেন। তখন প্রতি সপ্তাহে সম্ভবত বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রচারিত হতো শ্রোতাদের অনুরোধের গানের অনুষ্ঠান -গানের ডালি। একটা গান তারপর কয়েকটা বিজ্ঞাপন বিরতি দিয়ে – আবারো অনুরোধের গান। সন্ধ্যা বেলায় দুর্বার অনুষ্ঠানটির অপেক্ষায় থাকতাম।

প্রতি শুক্রবার বিটিভিতেও নিয়মিত দেখানো হতো বাংলা সিনেমা। অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম, ঘোষক বা ঘোষিকা কখন বলবেন, বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে আপনাদের জন্য থাকছে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি।

কটিয়াদী বাজারে কথাচিত্র ও মকুল নামে আমার নানাদের দুটো সিনেমা হল আছে। মুকুল সিনেমা হলটি আমাদের বাসার লাগোয়া আর বাসা থেকে ৫০০ গজ দূরত্বে ছিল কথাচিত্র। স্কুল ছুটির দিনে ও উৎসব-পার্বণে সিনেমা দেখা ছিল আমাদের অন্যতম বিনোদন।

আমি অহংকার করেই বলি__ আমি সেই সত্যজিৎ রায়ের গাঁয়ে জন্মেছি, যিনি বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার । যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি চলচ্চিত্রকার আলোকচিত্রী, চিত্রকর, শিশুসাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও সুপরিচিত। কটিয়াদী উপজেলার মসুয়ায় সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ও ছড়াকার সুকুমার রায়ের বাড়ি। সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী। তিনি ছিলেন বিখ্যাত শিশু কিশোর পত্রিকা ‘সন্দেশের’ (১৯১৩) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। যৌক্তিক কারনেই শেকড়ের টানটা আমার প্রবল। শক্ত গাঁথুনির ভিত তৈরি হয়েছে আমার পরিবার থেকেই। আমার কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই আমার অস্তিত্ব নিয়ে! আমি বাংলা সিনেমা দেখি এবং বাংলা গান শুনতে ভালবাসি। আমার এই ভালবাসা-বাসিতেই আমি অন্ধ! লোকে আমাকে গেঁয়ো চাষা বলবে নাকি আলট্রা মর্ডান বলবে__ বলা না বলার এই দ্বন্দ্বে কথিত ‘আধুনিক সামাজিক খ্যাতি’ ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ছেনা জেনেও আমি বাঙাল!

‘এক টাকার বউ’ বাংলা চলচ্চিত্রখ্যাত ঋদ্ধি টকিজের কর্ণধার সুমন চৌধুরী তাঁর ফেসবুক ওয়ালে প্রিয় অভিনেত্রী ববিতার জন্মদিনে একটি ছবি পোস্ট করেছেন।ছবিটি – একটি চলচ্চিত্রের হাতে আঁকা পোস্টার।

সেযুগে সিনেমার পোস্টার মানেই রঙঢং-এ ঝকঝকে নিখুঁত পোস্টার।সুন্দর শৌখিন শিল্পসত্তার উঁকিঝুঁকি!রুচির ছাপ!যত্ন আর ভালবাসার সুস্পষ্টতা প্রকাশ পেতো পোস্টার।পোস্টারে ছিল অনেক নান্দনিকতা,যা এখনকার ডিজিটাল পোস্টারগুলোতে নেই। বর্তমান নকল ছবি নির্মাণের মতো হরহামেশা বিদেশি ছবির পোস্টারের নকলেই ঢাকার বেশিরভাগ ছবির পোস্টার তৈরি হচ্ছে। অদ্ভুত অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দিয়ে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিতে দর্শক টানার চেষ্টা ছলছে।অন্য প্রসঙ্গে চলে এসেছি।ববিতায় ফিরি আবারো ‘বড় বাড়ীর মেয়ে’ চলচ্চিত্রে ববিতার নায়ক ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক প্রানপুরুষ কিংবদন্তি অভিনেতা আলমগীর ।আলম গীর ও ববিতা জুটির সিনেমা__ আমার আগ্রহটা দ্বিগুণ হল।জাতীয় পুরষ্কারসহ অসংখ্য পুরষ্কারপ্রাপ্ত মহানায়ক আলমগীর তনয়া আঁখি আলমগীর জানালেন – পোস্টারটি ‘বড় বাড়ীর মেয়ে’ বাংলা চলচ্চিত্রের।উল্লেখ্য আঁখি আলমগীর নিজেও অত্যন্ত সুপরিচিত স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী।পেয়েছেন অসংখ্য পুরষ্কার ও সম্মাননা।

ইউটিউব ঘেঁটে, গুগুল/উইকিপিডিয়া সার্চ দিয়ে ‘বড় বাড়ীর মেয়ে’ চলচ্চিত্রটির কোন তথ্য পেলাম না। আর্কাইভে ছবিটিও নেই, যা দেখে মনের ক্ষুধা মিটবে। জানার আগ্রহ বাড়বে। আলম গীর ও ববিতা জুটি আরো অসংখ্য সিনেমা উপহার দিতে পারতেন। কেন পরিচালকেরা তখন তা ভাবেননি! কেন প্রযোজকেরা তাঁদের স্বপ্রতিভ অভিনয় দক্ষতা ও মেধা কাজে লাগানি!তাঁদের কাজ ও জীবনী নিয়ে কেন পর্যাপ্ত বই নেই!? কেনই বা তাঁদের কর্মজীবনের উপর কোন ডকুমেন্টারি নেই!নেই তথ্য সংশ্লিষ্ট নির্ভর আর্কাইভ!গনমাধ্যম, ইউটিউব ঘেঁটে, গুগুল/উইকিপিডিয়া সার্চ দিয়ে যা পেয়েছি তার বেশীর ভাগই হচ্ছে – কে কয়টা বিয়ে করলেন! কার সংসার ভাঙলো!কে হিজাব ধরলেন, কে ছাড়লেন!

নতুন প্রজন্ম শিখবে কোথা থেকে!
ষাটের দশক থেকে শুরু করে নব্বই দশক পর্যন্ত ঢাকার ছবির রমরমা বাণিজ্য ছিল। সেই সঙ্গে ছিল চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট তারকা ও কলাকুশলীদের কর্মচাঞ্চল্য। এই সময়টুকুকেই মূলত চলচ্চিত্রের সোনালি যুগ বলা হয়। যা গেছে, তা কি একেবারেই গেছে! নব্বই দশকের শেষের দিকে এসে সোনালি যুগের পতন শুরু। মুক্ত বাজারের ভোগসর্বস্ব সংস্কৃতির পরিণাম ভয়ংকর। দীর্ঘ গৌরবের পথ-পরিক্রমার বর্তমানে অশ্লীলতা ও ভাঁড়ামির প্রেক্ষাপটে অনেক প্রাচীন ও অভিজাত প্রেক্ষাগৃহ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভারতীয় চলচ্চিত্রের অনুপ্রবেশ আর যৌথ প্রযোজনায় ক্রমাগতভাবে রিমেক সব চলচ্চিত্রের ভিড়ে বাংলাদেশি সিনেমার মৌলিকতা জৌলুস হারিয়ে প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে।

বাংলা চলচ্চিত্র বাঁচুক।সংস্কৃতি বাঁচুক।
চলচ্চিত্রাঙ্গনে জ্বলজ্বল করুক তারকাশিল্পীরা।

উপমহাদেশ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শুধু নয় বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ও অনবদ্য এক অভিনেত্রীর নাম
নাম ববিতা। আজ তাঁর জন্মদিন।বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে উজ্বল নক্ষত্রদের তালিকায় প্রথমদিকেই যার নাম আসে তিনিই ববিতা।জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী।পেয়েছেন আন্তর্জাতিক জাতীয় পুরষ্কারসহ অসংখ্য পুরষ্কার ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে পাওয়া আজীবন সম্মাননা।আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পতাকা যে নায়িকা প্রথম উড়িয়েছিলেন তিনি ববিতা।


Place your ads here!

Related Articles

Australia’s First Female Prime Minister

We are used to women Prime Ministers in South Asia and it all started in 1960 with Ms. Srimavo Bandarnaike

'শেখ হাসিনা পারেন, শেখ হাসিনাই পারবেন'

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “আওয়ামী লীগই পারে, আওয়ামী লীগই পারবে” বিশেষ লেখাটি পড়লাম। সাধারণত

বাদল দিনে বাদল ধারা

ক্যানবেরার ছোট্ট বাঙালি কমিউনিটিতে বেশ কয়জন গুণী কবি- সাহিত্যিক, গীতিকবি, কণ্ঠ শিল্পী, তবলা বাদক আছে। ফেসবুক ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এদের

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment