মেলবোর্নের চিঠি – ৪

মেলবোর্নের চিঠি – ৪

[মেলবোর্নের চিঠি]

যেকোনো ভিসার জন্যে অপেক্ষায় থাকা সময় থেকে ‘ভিসা প্রাপ্তির’ ক্ষণটি ভীষণই অন্যরকম একটা সময়। মুহূর্তেই বদলে যায় প্রেক্ষাপট এবং সময়।

তবে কেউ ভিসা নিয়ে পড়তে যাচ্ছে, বেড়াতে বা ডাক্তার দেখাতে যাবে, এমন সবগুলো বিষয়েই থাকে যতোটা না উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা, আশা, প্রত্যাশা এবং অপেক্ষা, ইমিগ্রেশন ভিসা বিষয়টি একটু বোধ হয় অন্যরকম!!!

একটা মানুষ যখন নিজ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় এবং অপেক্ষায় থাকে সেই সোনার হরিণের মতোই কাংখিত ভিসা প্রাপ্তি সংবাদটির, সেই সময়গুলোও তাই খুব আলাদা।

একদম শুরুতে আশংকা, অনিশ্চয়তা, হবে কি হবেনা টা থাকেই। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে, পজেটিভ রেজাল্ট পেলে শুরু হয়ে যায় একটা প্রস্তুতি মন থেকেই। টান পড়তে থাকে সুতোয়, বন্ধনগুলো একটু একটু করে সামনে এসে একটা ঘোরের মাঝে নিতে থাকে। কিছু বন্ধন যে বদলে যাবে, বদলে যায় এই বোধটাই ভোঁতা হতে থাকে অজান্তেই।

অভিবাসন ভিসায় প্রথম কয়েকটি ধাপের পরই কিছুটা নিশ্তিত হওয়া যায়, মুল ভিসা হতে যাচ্ছে কিনা। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়াতে মেডিক্যাল এপ্রোভাল পেয়ে গেলে এর পরের সময়গুলো শুধুই কাউন্ট ডাওন।

স্টুডেন্ট ভিসায় প্রার্থীদের মাথায় খুব বেশিই থাকে বাইরে পড়তে যাওয়ার উত্তেজনাটা। পড়তে যাওয়া ছেলে-মেয়েটি এবং তার পরিবারেরও থাকে একটা প্রস্ততি এবং পুরো বিষয়টির সাথেই থাকে আশা ভালোবাসা এবং আনন্দই বেশি!!!

যে মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিনদেশে তার পিছনে থাকে একটু অন্যরকম গল্প, কেউ স্বেচ্ছায় কেউ নিতান্তই বাধ্য হয়ে কেউ বা আরো একটু নির্ভার এক জীবনের ডাকে সাড়া দিয়েই মূলত বেঁছে নেয় এই সিদ্ধান্ত। একটি সিদ্ধান্ত, একদিকে বাড়তে থাকে এই স্বপ্নকে ঘিরে প্রত্যাশা, অনাগত জীবন কল্পনা মেলতে থাকে ডানা, অন্যদিকে ছিঁড়তে থাকে নানামুখি বর্তমান বন্ধনের সুতোগুলো!!!

নিজের কথা বলি, কোনদিন ওভাবে ভাবিনি নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি দেবো পরবাসি জীবনে। আমার ক্ষেত্রে পুরোটাই নিয়তি, চাইনি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতেই হল।

একটা ক্ষোভ ছিলো, মন কিছুতেই লাগছিলো না। IELTS পরীক্ষায় সব ব্যান্ডে ৬ পেতেই হবে, শুরুতেই তাই এই বিপত্তিতে পড়ি, একটু কঠিনই মনে হতে থাকে। পড়তে আসা ছাত্রদের না বুঝেই টিপস দিয়েছি, কিভাবে ভালো স্কোর পেতে হবে, নিজে দিতে গিয়ে বুঝলাম বিষয়টা কতোটা সঙ্গিন। ইনফ্যাক্ট একবারে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলামনা।

BETS Centre, ধানমন্ডিতে কয়টা মক টেস্ট দিয়েই পৌঁছালাম অভীষ্ট লক্ষ্যে, দুইবারের প্রচেষ্টায়। এরপর লম্বা একটা সময় অপেক্ষা, অনিশ্চয়তা নিয়ে। প্রথম কয়টা ধাপ শেষ হওয়ার পরের সময়গুলো বড্ড বেশিই ছেঁড়াছেঁড়া, এলোমেলো। যা করি, যেখানেই যাই, মনের মাঝে ঘাই মেরে উঠে ‘’আমি দেশ ছেড়ে যাচ্ছি’’!

মেডিক্যাল এপ্রোভাল হয়ে যাওয়ার পর যখন মুল ভিসা আসার অপেক্ষা, এই সময়টা এমন বেশি অন্যরকম হয়ে যায় চোখের পলকে। সময় যে হলো হলো, নোঙ্গর তোল তোল এমন একটা ভাব নিজের পৃথিবীকে আরো একটু ভালোবাসতে বলে, সামনে কি হবে তার ধোঁয়াসা থাকলেও প্রেক্ষাপট শুধুই যেন, ‘জেমস’ মানে ওর গান ‘’আরো কিছুক্ষণ কি রবে বন্ধু, আরো কিছু কথা কি হবে’’!!!

দেশ ছেড়ে যাওয়া যে মানুষটির সংসার থাকে, হোক তার বয়েস মাস বা বছর, সংসার মানেই ঘরের কোণে ছড়ানো মায়া বস্তু, দেয়ালে ফ্রেমবন্দি সুখী মুহূর্ত, কোন একটা লাগোয়া বারান্দায় গোলাপের টব, সামনের বাসার জানালার মেরুন হলুদ পর্দা। ‘এই সব সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি’ আর দেখা হবে কিনা জানিনা, এই অনুভবগুলো কম আর বেশি দেশান্তরি মানুষকে ভোগায় বোধ হয়।

যে মানুষটি রোজকার অফিসে ঢোকার আগে দাঁড়িয়ে দিতো সিগারেটে সুখ টান সেও বুঝিবা হয় একটু উদাস… এই জায়গাটাকে ঘিরে যে মায়া, এই বোধ নূতন করে জাগে, সেখানেও পড়ে বুঝি টান।

সবার কথা জানিনা, কারো জীবন নানান কারণে এমন অবস্থায় দাঁড়াতেই পারে, দেশ ছাড়াতেই শুধু বাঁচার প্রেরণা মেলে, দেশ ছেড়ে যাচ্ছি এবার বুঝি মিলবে আমার মুক্তি এই বোধ নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকে মন।

৯ বছর, লম্বা এই সময়ের সংসার আমার, চিনা মাটির ছোট গোলাপ শোপিস, ফ্রেমবন্দি ছবিগুলো, বসার ঘোরের কোনায় প্রিয় পটারী, সব হঠাই যাদু ছড়াতে থাকে যেন, যখনই চোখ যেয়ে পড়ে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

ফাইনালি ভিসা পেপার পাই এপ্রিল ২০০৯ এ, অফিস ছেড়ে দেই তার অল্প কিছু সময় পর। ১৭ জুলাই ২০০৯ বাংলাদেশ ছেড়ে উড়ি অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে।

এপ্রিল’০৯ থেকে জুলাই’০৯ এই সময়েই গুটিয়ে নিতে হয় আমার বাংলাদেশ জীবন অধ্যায়। পরিবার, পরিজন, বন্ধু, অফিস কলিগ যাদের সাথে ছিল নিয়মিত যোগাযোগ, ছিল একটা মায়া-মমতা-ভালোবাসার বন্ধন, সারি বেঁধে দাঁড়ায় সেই সব মুখ মনের আয়নায়, কাউকে দেখি অনেক স্পষ্ট ভাবে, কেউ কেউ ঝাপসা…

শেষ তিন মাস অফিস শেষে আমার খুব প্রিয় জুনিয়র কলিগ অরুন্ধুতি আর মাজহারকে নিয়ে একটা করে মিশন এ নামতাম প্রতিদিন। আজ জার্নি বাই ক্যান্টনমেন্ট টু মিরপুর তো কাল সেই মতিঝিলের কোন এক পাড়ায় যেয়ে খুপরী হোটেলে মোরগ পোলাউ খাওয়া।
একদিন ঢাকায় কোন এক রাস্তার পাশের টং দোকানের সেরা চা সিঙ্গারা তো পরদিনই ধানমন্ডির চা-বারে যেয়ে ভেলপুরি আড্ডা।

বিশেষ করে অরুন্ধতী আমাকে টানা ২/৩ মাস এমন দারুণ কিছু সন্ধ্যা দিয়েছে আমার ফেলে আসা বাংলাদেশের সুখ-স্মৃতির মাঝে যা সবসময় একটু বেশিই উজ্জ্বল।

আমার সবজিপ্রীতি জানতো আমার কলিগরা, মাজহার একদিন গাড়ি করে ভোর ৬ টায় অরুন্ধতীকে নিয়ে আমার বাসার নিচে এসে হাজির। ও নদীর ধারে এমন একটা সবজী বাজারে নিয়ে গেলো, নানান দিক থেকে নানান সবজি আসা দেখে খুশীতে আমার পাগল হওয়ার দশা। আহ যেন অপার্থিব এক সুখ স্বপ্ন, ছোট্ট একটা ক্ষণ।
টানা বছর ২/৩ দিনের অনেক অনেক উৎকণ্ঠা সময় পার করে যখন নিশ্চিত হই, দেশ ছেড়ে যাচ্ছি, হঠাৎই যেন নির্ভার আর শান্ত একটা সময়।

আমি কোনদিন প্রবাসি জীবন বেঁছে নেবো ভাবনায় ছিলোনা। পারিবারিক কারণে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েও একটা ক্ষোভ, কষ্ট, হতাশা, ব্যর্থতা যা ছিল মনে মনে চলে আসার একদম আগের মুহূর্তে তাই তুলেই রাখলাম, মানে রাখতে পারলাম।

মনকে বোঝালাম আর্থিক সংকটময় জীবন নরকতুল্য। দেশে নানান কারণে সেটা যখন কিছুতেই কাটানো যাচ্ছিলোনা, তবে এবার জীবনে নূতন কিছু হোক, অন্যরকম কিছু। বাইরে যাচ্ছি কাজ করতে আরও বেশি কাজ শুধু কাজ, আর কিচ্ছু না! মনকে এই প্রভোদেই বাঁধলাম, সাথে গেঁথে নিলাম প্রিয় মানুষদের ঘিরে যে সুখময় স্মৃতিগুলো।

উড়ে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছিল, মনের অলিগলি ধরে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলো অসংখ্য মুখের মিছিল। পাড়ার যে দোকান থেকে ছেলের জন্যে চিপস, নিজের জন্যে মিনি শ্যাম্পু কিনতাম, যে টেইলরের কাছে জামা বানাতে যেতাম, লন্ড্রিতে শাড়ী ধুতে দিতাম সেই সব মানুষদের বলে এসেছি ‘বিদায়’।

কেউ কেউ কি ভীষণ মায়া নিয়ে তাকিয়ে ছিল। বাংলাদেশে আমরা যে কাউকে জড়িয়ে ধরে চাইলেও বিদায় জানাতে পারিনা। কারো কারো গভীর মায়ার দৃষ্টি আর প্রশ্নবাণ মনের গভীরে ঢুঁকে যাচ্ছিলো, ‘আপা আপনার সাথে আর দেখা হবেনা’???!!!

আমি তখন ঘোরের মাঝে, অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি, পরিবার নিয়ে নূতন কোন আশায়, চোখ ভীষণ পোড়ায় যখন তখন, আমি চেপে যাই, হাসিমুখেই সবাইকে বলি ‘বেঁচে থাকলে ফের দেখা হবে’ বেড়াতে আসবো যখন আপনাদের দেখতে আসবো, ভালো থাকবেন!!!

ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করতে যাই কলিগ অরুন্ধুতিকে নিয়ে। সুদর্শন তরুণ ম্যানেজার সেই সাত সকালেই তুমুল ব্যাস্ততার ভান নিয়ে উদাস হয়ে যান। আমাদের বসতে বলে, কি যেন হাতড়ে বেড়ান।

অরুন্ধুতি হঠাৎই বলে উঠে, আপু সামথিং ইজ বারনিং, আমি নাক বাড়িয়ে গন্ধ নেয়ার চেষ্টায় খুঁজতে থাকি উৎস, চা না টোস্ট! কলিগ হাসতে হাসতে আমার গায়ে লুটিয়ে বলে, উফ, আপনাকে নিয়ে আর পারিনা, ‘’লুক এট হিজ আইজ’’ … হ্যান্ডসাম আপনার জন্যে কাঁদছেন, না মানে কেঁদেই দেবেন, আমি হঠাৎই বুঝতে পারি, কি ভীষণ অপচেষ্টা বেদনা লুকানোর!!!

ব্যাংক একাউন্ট ক্লোজ, বললাম আমাদের হয়তো আর দেখা হবেনা, ভালো থাকবেন। অফিসের পুরো ব্যাংকিং সময়টাতে যেভাবে পাশে ছিলেন, কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, অনন্ত শুভ কামনা, সবই মনে মনে বলি। মুখে ভীষণ হাসি দিয়ে চূড়ান্ত বিভ্রান্ত আমি বা সে, জানাই শুধুই বিদায়। ট্যাক্সিতে উঠে নেই লম্বা নিঃশ্বাস!!!

পাঁচতলা যে সিঁড়ি বেয়ে অফিস করেছি টানা ৭/৮ বছর, যে জানালার গ্লাসে চোখ রেখে প্রিয় মাগ এ খেয়েছি পৃথিবীর সেরা বনানী বাজারের চা-কফি, সেই কফি হাতে করেই প্রিয় কলিগদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি বিদায়।

অফিসের ড্রয়ারে রাখা ছোট কিছু জিনিস, কিছু গিফট, ছবি, প্রিয় কালো ডায়েরীসহ ছোটখাট ব্যাগ নিয়ে সেই শেষদিনেও অরুন্ধুতিকে নিয়ে ফিরছিলাম সিএনজীতে করে। জ্যাম এড়াতে নাখালপাড়া দিয়ে ঢুঁকে প্রধানমন্ত্রী অফিসের পাশ দিয়ে যখন বের হতাম সন্ধ্যাগুলো যে কি ভীষণ মায়ার ঘ্রাণ ছড়াতো। সেইদিনও একটা তীব্র দারুচিনির ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম যেন আমরা, দুজনই খুব অবাক হয়ে প্রাণভরে নিচ্ছিলাম সেই সুবাস।
এই বিভূঁইয়ে মাঝে মাঝেই সেই সন্ধ্যার ঘ্রাণ এসে ছুঁয়ে যায় যেন আমায় আজও।

এবার উড়ার পালা, প্রায় নয় বছরেরে সংসার গুটিয়ে তিন সদস্যের পরিবারের ৬ টা ছোট বড় সুটকেসে ভরে নেই।

যে চোখ জ্বালায় ভুগছিলাম, শেষমেস কিনা এয়ারপোর্ট রওনা দেয়ার পর সেটা সাড়লো। ভিতর থেকে কাঁপছিলাম, বাবা, আমার মা, কতোটা একা হয়ে যাবেন ভাবতে পারছিলামনা।

আর কিছুতেই হাসিমুখে বিদায় জানানো হলোনা মাকে, নিজেকে কতোটা শুন্য আর একা মনে হচ্ছিলো সেই সময় বুঝাতে পারবোনা।

শুধু আর একবার নিজেকে ভীষণ করে জীবনে ফেরাতে, সাহস যোগাতে পুত্র নভোঃকে শক্ত করে ছুঁয়ে থাকি, বিমানের ছোট্ট জানালার বাইরের অসীম অন্ধকারে চেয়ে!!!

নাদিরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া


Tags assigned to this article:
মেলবোর্নের চিঠি

Place your ads here!

Related Articles

International Mother Language Day

The UN International Mother Language Day celebrated on 21 February commemorates the lives sacrificed by Bengalis to defend their right

দয়াকরে এবার থামুন

বিরোধীদল ও সরকারী দল এবার দয়া করে থামুন। দেশের কেমন উন্নতি আপনারা চান তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। দেশের মানুষের

How does global financial crisis affect Bangladesh? By Barrister Harun ur Rashid

There is a saying that when America sneezes, the countries around the world get flu. This has been evident when

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment