মেলবোর্নের চিঠি – ২

বাংলাদেশে আমার চাকরী জীবন, ছাত্র অবস্থা এবং পরবর্তী সব মিলিয়ে প্রায় এক যুগ।
দেশ ছেড়ে আসার আগে আমার কাজ ছিলো ‘স্টুডেন্ট ভিসা’ নিয়ে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া পড়তে আসা এবং আলাদা করে স্পাউস এবং অভিভাবকদের ভিজিট ভিসা নিয়ে। কাজটি করেছি ৮ বছরেরও বেশি সময়।
শুরুর আগে আমার ধারণায় ছিলোনা, এতো লম্বা সময় কাটিয়ে দেবো। স্টুডেন্ট কাউন্সিলর পজিশন দিয়ে শুরু, সেন্টার ম্যানেজার হয়ে বিদায়।
প্রাসঙ্গিক ভাবেই একটা কথা বলে নেই, দর্শনের ছাত্রী হিসেবে বা অন্য কারনেই হোক মানুষের চিন্তা জগত আমাকে সব সময়ই খুব টানে, যেকোন আচার-আচরণ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে আমি হুট করেই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাইনা। কেন, কিভাবে বা কি প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবি, ভাবার চেষ্টা করি।
স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে কাজ, সাধারণ ভাবেই কথা বলতে হতো লম্বা সময় ধরে ভিসাপ্রার্থী এবং অভিভাবকদের সাথে। কাজটি করতে যেয়ে আমার সেই দর্শন খুব কাজে লেগেছে। অনেক বেশি ধৈর্য নিয়ে কথা বলতে এবং শুনতে, একই কথা বারবার ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে নিজের কাছে নিজেই বোর না হয়ে যেতে!!! বলা যায় ‘মানুষের জীবন দর্শন’ প্রিয় বিষয় হয়ে যাওয়ার পিছনে আমার এই চাকরী’র ভূমিকা স্বীকার করতেই হবে।
‘’বাইরে পড়তে যাওয়া’’ পুরো বিষয়টার সাথে অনেক কিছু জড়ানো। স্টেপ বাই স্টেপ প্রসেস ফলো করতে যেয়ে একজন শিক্ষার্থী এবং তার পরিবারের অনেক কিছুই সামনে এসে যেত জানা হয়ে যেত অনেক কিছুই নিজের অজান্তেই।
আমার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণেই দেখেছি মুলত ‘’পড়তে আসা’’ স্টুডেন্টসদের পরিবারের আচার আচরণ নির্ভর করতো তাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থানের উপর।
উচ্চবিত্ত অভিবাবকদের মাঝে অনেকেরই ধারণা ছিল, ‘’হাই কমিশনের নিয়ম কানুন তাদের জন্য প্রযোজ্য হবেনা। স্টুডেন্ট ভিসার’ চেক লিস্ট ধরে আগাতে চাইলে ফাইনানশিয়াল কাগজ পত্র যেভাবে জমা দিতে হবে তা বেশির ভাগ সময় প্রথম বসাতে আমলে নিতে চাইতেননা। যেন আমিই বানিয়ে বলছি।
২০০১ থেকে ২০০৯, এই লম্বা সময়, বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পপতি, মিডিয়া এবং চলচিত্র অঙ্গনে কাজ করেন, মাল্টিন্যাশনালে অনেক বড় পজিশনে আছেন এবং ক’জন সংসদ সদস্যের ছেলে মেয়ের ভিসা প্রসেজ করতে যেয়ে অনেক অন্যরকম সময়ের মুখোমুখি হয়েছি এবং তাদের খুব কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য দুটোই হয়েছে!!!
চলচিত্র বা মিডিয়াতে আছেন এমন কাউকে কাউকে পুরো বাংলাদেশ যেভাবে চেনে বা জানে আমি এবং আমার সেই অফিসের লোকজন পেয়েছি অন্যরকম বিনয়ী এক রুপে। পুরো কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের বিশেষ ভাবে আপ্যায়িত করা হয়েছে কারো বাসায়ও, এক ধরণের ভালো লাগাই বলা যায়।
এমন অনেকবার হয়েছে, একদম শুরুর দিন কথা বলছি, কিন্তু বুঝতে পারছি আমাকে ঘিরে এক ধরণের অবজ্ঞা। আমি ছোট খাট মানুষ, অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের বিষয়াদি, একাডেমিক এবং ফাইনান্সিয়াল দুইটাই, আমার এতো ভালো জানার কথা না, কেন জানি বা আসলেই আমি ঠিক জানি কিনা একটা সন্দেহ ভাব টের পেতাম কারো কারো চোখে মুখে আচরণে।
কিছু সময় মন খারাপ ঠেলে আসতে চাইলেও, একটা সময় খুব শিখে নিয়েছিলাম ইগনোর করা। চেষ্টা একটাই থাকতো অফিসিয়ালি একসেপ্ট করা প্রতিটা স্টুডেন্ট এরই যেন ভিসা হয়, পূরণ হয় তার পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন।
এপ্লিকেশন লজ করার আগেই তাই সবটুকু আন্তরিকতা এবং চেষ্টা থাকতো, প্রতিটাই যেন হাই কমিশনের চেক লিস্ট ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করে। যে অফিসে কাজ করতাম সেটিও ছিল অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের টপ লিস্টে, সাকসেস এবং ট্রাষ্ট নিয়ে ছাড় দেয়ার কোন স্কোপ ছিলোনা। এটি ছিল একটা বাড়তি আনন্দেরও জায়গা।
কাজ করতে যেয়ে এমনও হয়েছে সেই মনোহরদী’র কোন এক ব্যাবসায়ী, আলু এবং শুটকী নিয়ে, সেই পরিবারের বড় ভাই যখন কলেজ পাশ করা ছোট ভাইকে নিয়ে এসে সামনে বসে বলেন, আপা আমার ছোট ভাইকে পাঠাতেই হবে… সেও এক অন্য রকম অনুভূতি। টাকা আছে কিন্তু ব্যাংক ডকুমেন্টস যেভাবে থাকার দরকার সেভাবে নেই। এম ডি স্যার এমন কিছু নিয়ে কাজ করবেন না, আমি করতে চাই। উনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন!!!
আমি শুরু করি একটা পরিবারের স্বপ্নের সাথে হাঁটা, যেভাবে বলি সেভাবেই কাজ করে, টানা মাস ছয় নামী ব্যাংকের সাথে কাজ করে যখন দুরুদুরু বুকে পেপার গুছিয়ে সাবমিট করি, সেই পরিবারের লোকদের কথা তো বলে বুঝানো যাবেনা, নিজের ভিতরেও চলে অস্থিরতা। ভিসা হয়, যতোটা আমার প্রাপ্য তার চেয়ে অনেক বেশিই সম্মান মেলে, সেই পরিবারের সাথে একটা অদেখা বাঁধনে জড়িয়ে যাই।
আনন্দ কিনতে কার না ভালো লাগে, এবার প্রেক্ষাপট, নেত্রকোনার কোন এক প্রান্তিক চাষির ছেলে, নূতন চ্যালেঞ্জ, মনকে বলি, চল যাই আনন্দ নগরে!!!
দেশের নামীদামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি ছিল বাইরে পড়তে যাওয়ার দলে। তারা প্রথম সাক্ষাতে শুধু বন্ধুদের নিয়ে বা একাই কথা বলতে আসতো। অন্যরা পরিবারের কাউকে না কাউকে নিয়ে।
একদিন এক মা এলেন, ছেলেকে নিয়ে। কথা বলে জানলাম উনি ময়মনসিংহের, একটু যেন বেশিই আপণ। যা জানানোর গুছিয়ে জানালাম, শুনে জানালেন, আছে সব কিছুই কিন্তু ব্যাংক স্টেটমেন্ট অরিজিনাল দেখাতে পারবেননা। তখন নিয়ম ছিল এফডিআর বা সঞ্চয় পত্র হলে তা দেখাতেই হবে, ফটোকপি নয়।
কেন যাবেনা সেও এক মজার বিষয়, উনার হাজবেন্ড কিছুতেই রাজি হবেন না, উনি অসম্ভব রাগী একজন মানুষ, তার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কেউ কথা বলতে পারেনা।
আমার ঐটুকু চাকরী অভিজ্ঞতা তখন আমাকে যতোটা সাহসী ছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশি আত্নবিশ্বাসী করে দিয়েছে, বললাম আন্টি আপনি উনাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যাবস্থা করেন বা ফোন নাম্বার দেন।
উনি এলেন, পুরো অফিসকেই বলা ছিল বিনয় এবং আন্তরিকতা দুটোই জেনো পরিপূর্ণ থাকে। দুই কাপ চা, ভীষণ উত্তেজিত টক শো যেমন হয়, তেমনটি না হলেও, সেই প্রথম কাউকে দেখলাম না রেগে কোন কথাই বলতে পারেননা। প্রচণ্ড জেরাটা তুমুল সামলিয়ে আমি বললাম আংকেল আপনাকে আমি যেদিন বলবো, অবশ্যই আগে থেকে জানাবো, সেদিন হাই কমিশন গেইটে আসতেই হবে, আপনার এফডিআর নিয়ে, আমি ভিতরে আপনার ছেলের ফাইল সাবমিট করার সময় কেস অফিসারকে ওগুলো দেখিয়ে এনে ইন্টারভিউ শেষ করেই দিয়ে দেবো।
তারপরের ইতিহাস, সে এক বিরাট ইতিহাস।
ছেলে এবং মা একদিন বলছিলো, জানো নদী আমার ছেলে কি বলে, ও যেদিন চলে যাবে সেদিন এয়ারপোর্টে যেয়ে কোনভাবেই পেছন ফিরে তাকাবেনা যদি কোন ভাবে বাবার মুখ আবার দেখতে হয়!!! ভীষণ কষ্ট নিয়ে কান্নাটা গিলে ফেলি আমি, হাসিমুখে আশার কথা বলি, মা- ছেলের প্রেমময় জগতটা উপভোগ করি।
ছেলের চোখে মুখে মা’কে ঘিরে কি ভীষণ ভালোবাসা, কিন্তু মানসিক ভাবে অসুস্থ সেই বাবা যদি তা পড়তে পারতো, জানতো, কি আর বলা যায়। আন্টির কাছে শুনতে না চাইলেও জানা হয়ে যায় কি ভীষণ কষ্টের এক সংসার পারি দিচ্ছেন তিনি শুধু একটা বদরাগী মানুষের জন্যে!!!
গোটা চাকরি জীবনে পেয়েছি অমূল্য সব স্মৃতি, ভালোলাগা, ভালোবাসা এবং অভিজ্ঞতা। মনের মাঝে গেঁথে গেছে নানান রকম মানুষের মুখ!!!
ভালো লাগতো, নিজের সততা এবং আন্তরিকতা যতোটা উজাড় করে দিয়েছি, পেয়েছি ঢের বেশি। প্রলোভন ছিলো নানান চুড়াবালিতে নিজের সততা বেঁচে দেয়া, দেইনি এমন একটা মানসিক প্রশান্তি নিয়েই ছাড়ি এই অফিস।
২০০৯ এ আমি যখন অস্ট্রেলিয়া নিজেই চলে আসি, তখন সব স্টেটেই ছড়িয়ে আছে আমার চেনা অনেক অনেক মুখ। সিডনী আসি, স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশীদের বেশি দেখা যায় এমন জায়গাগুলোতে গেলেই দেখা হয়ে যেত কারো না কারো সাথে।
এক সিনিয়র আপা সরকারি চাকরী ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া চলে আসেন, খুব ধীর স্থির একজন মানুষ, একাই আসলেন প্রথম, কথা বলে ভালো লাগলো। ভিসার কাজ শুরু হওয়ার পর হঠাৎ বিয়েও করে ফেললেন। স্পাউস ভিসায় যেভাবে পেপার রেডি করতে হয় ঠিক সেভাবেই করে দিলেন, ভিসা নিয়ে চলে এলেন আমাকে ধন্যবাদের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে।
দেখা হয়ে গেল একদিন সেই হাজবেন্ড ভাইটির সাথে, হাসিমুখে তাকিয়ে আছি, কেন যেন আমাকে চিনতে পারলেন না বা অন্যকিছু!!! ভাবলাম ৩/৪ বছর লম্বা সময় কে কাকে মনে রাখে, তখনও আমার জন্যে যে এতো চমক অপেক্ষা করছিল কে জানতো। যে দোকানে গেলাম সেখানেই সেই আপাকে একটু পড়ই আবিষ্কার করলাম, হাজবেন্ড কে বলছেন মামা…
আমাকে দেখে ভূত দেখার মতোন চমকে, হাত চেপে নিয়ে গেলেন একটু অন্যপাশে। জানলাম ফ্যাক্ট ছোট করে, মামার বন্ধু উনি, বিজনেস করছেন এখানে এসে, আসা দরকার ছিল, তাই ছোট একটা মিথ্যার আশ্রয়!!!
বেশ ক’দিন বোকার স্বর্গে বসবাস, যে বিশুদ্ধ চিত্ত নিয়ে এতো কাজ করেছি, কত শত স্পাউস ভিসা নিয়ে কাজ করেছি, তার মাঝে আর কতগুলো এমন কেস হয়ে যেতে পারে, কে জানে!!!
কাগজের বউ উপন্যাসটার কথা মনে হল, কি যেন প্রেক্ষাপট? এমনতর ঘটনাকে ঠিক কোন দর্শন দিয়ে বিবেচনা করে নিয়েছি সান্ত্বনা, সে গল্প আজ তবে থাক তোলা।
একটাই চাওয়া, একটাই বিশেষ বার্তা এই লেখায় দিতে চাই, বিশেষ করে বাংলাদেশী কোন মানুষের নাম যেন এমন ‘চতুরতা’ বা বে-আইনী বিষয়ের সাথে জড়িয়ে না যায়। বিশেষ করে দেশের বাইরে তো নয়ই, কারণ ‘প্রবাসী’ প্রতিটা মানুষই কোন না কোন ভাবে কোথাও না কোথাও নিজেই একটা ‘বাংলাদেশ’ হয়ে যায়!!!
নাদিরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
Related Articles
বহে যায় দিনঃ পর্ব ২২, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সংগে কিছুক্ষন
বহে যায় দিন পুর্ব প্রকাশিত পর্ব এখানে
হুমায়ূন আহমেদঃ সাহিত্য ও বিত্তের যাদুকর
কথাসাহিত্যের যাদুকর লেখক হুমায়ূন আহমেদএর লেখালেখির ভুবন যেমন ছিল বিশাল বিসত্মৃত তেমনি তাঁর জনপ্রিয়তাও আকাশচুম্বী৷ হুমায়ূনের সমসাময়িক জনপ্রিয় একের বেশী
UN Vote for Palestine resolution snubs Israel and the US
Palestine resolution for admission into the UN as an “observer non-member state” was adopted on 29th December by a huge