মেলবোর্নের চিঠি – ১১

মেলবোর্নের চিঠি – ১১

একটু লম্বা বিরতি নিতে হলো, আজ ফিরছি চিঠি – ১১ নিয়ে। যেখানে ছিলাম, সেখান থেকেই শুরু করি।

আমার একমাত্র ছেলে ও তার বাবা, আমাকে নিয়ে এই তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে যে ভিসা নিয়ে দেশ ছেড়ে উড়াল দিলাম এই সাগর মহাসাগরের দেশ অস্ট্রেলিয়া, সেই ভিসার সাবক্লাস ছিল ৪৭৫। টেম্পোরারি রেসিডেন্স ভিসা, সাউথ অস্ট্রেলিয়া গভর্নমেন্ট স্পন্সরশীপ। শর্ত সাউথ অস্ট্রেলিয়াতেই দুই বছর থাকতে হবে এবং উইকলি ৩৫ আওয়ার্স জব করতে হবে, আর এই ৩৫ ঘন্টার ৫২টা পে স্লিপ হতেই হবে, এরপর, পারমানেন্ট রেসিডেন্সি এবং সিটিজেনশিপ ধাপ, একের পর এক।

বাংলাদেশ থেকে এসে ছোট ভাই, ওর বউ আর বন্ধুদের সাথে সিডনীতে মোটামুটি এক মাস পার্টি টাইম কাটিয়ে এডেলেড, সাউথ অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেই ১৭ অগাস্ট ২০০৯ এই দিনে।

ছোট্ট ওই শহরে আত্মীয় বন্ধু থাকায় আগে থেকেই একটা বাসা ভাড়া করে রাখা হয়েছিলো। নূতন আসবেন যারা, তাঁদের জন্যে বলে রাখি আমাদের অভিজ্ঞতাটুকু, হয়তো কারো না কারো কাজে লাগবে। আজকাল যদিও যে স্টেট এ যাবেন, সব খানেই বাংলাদেশী কমিউনিটি আছে, আছে তাঁদের ফেসবুক পেজ, এইরকম প্রাইমারী যোগাযোগ ওখানেই সেরে ফেলা যায়। অনেক ক্ষেত্রে অনেক হেল্পফুল এইসব পেজ বা নানান সংঘটন। কিন্তু আমি যে সময়টার কথা বলছি তখন এমন ছিলোনা, অভিজ্ঞতাও আলাদা তাই।

ভিসা হওয়ার পর যে শহরে আসবেন, অনলাইনে বাংলাদেশে বসে বাসার জন্যে এপ্লাই করা যায়। সেক্ষেত্রে আগে থেকেই আছেন এমন কোন বন্ধু বা আত্মীয়ের একটু সাহায্য লাগে একদিন ইন্সপেকশনের জন্যে এবং অন্যান্য যোগাযোগটা করার জন্যে, অন বি হাফ ইউ।

আরও একটা বিষয় হচ্ছে, সরকারী কিছু একোমোডেশন থাকে ইনটাইম এপ্লাই করলে পেয়েও যেতে পারেন। যা খুব সাশ্রয়ী। পেয়ে গেলে শুরুতেই টাকা সেভ করার জন্যে এটা খুব কাজে লাগবে। তবে এপ্লাই করলেই পাওয়া যায়না, আমি পাইনি।

দেশ ছেড়ে পারমানেন্টলি অন্য একটা নূতন দেশে নূতন জায়গায় পাড়ি দেয়া বিষয়টার সাথে অনেক অনেক কিছু জড়িয়ে থাকে। দেশ ছেড়ে আসা সময়ের আগের এবং বিমান ভ্রমণ নিয়ে বলেছি এর মাঝেই।

সাথে করে কি রকম টাকা নিয়ে আসা উচিত, এটা যদিও সামর্থ বুঝে, কিন্তু যতোটা না হলে আপনি একটু খারাপ সময়ের মুখোমুখি পড়তে পারেন, সে টুকুই বলি। নেমেই কিছু কেনাকাটা, অত্যাবশ্যক জিনিসগুলো, একটা গাড়ী এবং এটলিস্ট ৩/৪ মাস চলার মত টাকাটা নিয়ে এলে একটু নির্ভার থাকা যায়, থাকা উচিত। শুরুতেই খুব বেশী স্ট্রেস হলে আসলে সামনের লম্বা সময় পাড়ি দেয়া একটু কঠিনই হয়ে যেতে পারে।

২০০৯ থেকে ২০১৭ লম্বা সময়, তারপরও বলবো, খুব খুব চেষ্টা করা উচিত, ১০/১৫০০০ হাজার ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৬/৭ লাখ টাকা নিয়ে আসার, ভালো একটা স্টার্ট এর জন্যে। ব্যাতিক্রম থাকতেও পারে। আমার নিজের এবং অন্য কিছু পরিবারের অভিজ্ঞতা সময়মত শেয়ার করবো আশা করছি।

গন্তব্যে নামার দিন থেকে অল্প কিছু সময় নিয়েই বলি আজ। আমি যেদিন নামলাম এডেলেড সাউথ অস্ট্রেলিয়া এয়ারপোর্ট। ২০০৯ এ এডেলেড এয়ারপোর্ট ছিলো, আজকের এই সময় থেকে অনেকটাই আলাদা। জনসমাগম আরো কম, বাংলাদেশ থেকে আসার পর এইরকম এক এয়ারপোর্ট যে কারো জন্যে একটা বিশাল ধাক্কা।

অনেকটাই নিজেদের নিঃশ্বাস শোনা যাওয়ার অবস্থা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই সময়ে নামলাম। কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছিনা, কান্না গিলছি আর এয়ারপোর্টের প্রয়োজনীয় কাজ সারছি। একমাত্র ছেলে নভঃ তখন ৪+। ওর ভালো লাগা মন্দ লাগা খেলার জগত সবকিছুরই প্রকাশ নিজের মত করেই। বুঝাই যাচ্ছে কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। আমার মনের মাঝে বেজে চলেছে গান, ‘আমি আজ আকাশের মত একেলা’!!!

এয়ারপোর্টে যে আত্মীয়ের নিতে আসার কথা তাঁর অফিস তখনও শেষ হয়নি। এর আগে একবার ফ্লাইট ডেট চেঞ্জ করাতে সে দ্বিতীয়বার ছুটি নিতে পারেনি। আমাদের একই দিনে বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে ভিসা লেভেল নিতে যাওয়া স্বল্প পরিচিত এক বন্ধু এলেন ওয়েলকাম করতে। তাঁকে দেখেই আমাদের হালে একটু পানি এলো।

বিকেল বিকেল ট্যাক্সি যোগে পৌছালাম আত্মীয়ের বাসায়। চাকরীজীবী হাজবেন্ড ওয়াইফ বাড়ী ফিরলো আগে পরে। আমাদের লাগেজ রেখে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনীং এ বসে বসে দেখছিলাম দুইজন মিলে কিচেনে দ্রুত হাতে কিভাবে ডিনার গুছাচ্ছে। তখন পর্যন্ত ধারণা নেই আমাদের সামনের সময়গুলো কেমন হতে যাচ্ছে।

রাতের খাবার সম্ভবত সন্ধ্যে ৭/৮ টার মাঝেই শেষ এবং উনারা আমাদের ৯ টার মাঝে গুড নাইট জানিয়ে চলে গেলেন, পরদিন সকাল ৬টায় নাস্তার টেবিলে দেখা হবে বলে। ভোর ৭টার মাঝে আমাদের বের হতে হবে তাঁদের একজনের সাথে এটিও ঠিক করা হলো।

তিনজন আবার নব উদ্যমে কাঁদতে বসি বসি অবস্থা। কি কথা বলবো, কাকে বলবো। নিজেকে আটকাই, ছেলের দিকে চাই, ওর ভালোলাগার জন্যে কি করা যায় মনোযোগী হই সেদিকে।

অনেকটাই নির্ঘুম রাত কাটিয়ে শুরু হয় আমাদের ঘটনাবহুল প্রথমদিন, এডেলেড, সাউথ অস্ট্রেলিয়া। আমাদের আত্মীয় এবং বন্ধু পরামর্শে লম্বা একটা লিস্ট করি আমাদের অবশ্য করণীয় কাজের। সেই লিস্ট ধরে শুরু হয় পথচলা…

পরদিন প্রথমেই যাই একটা সুপার মলে, কিনতে হবেই এমন কিছু জিনিস কেনাকাটা করি। এরমাঝেই আমাদের সাথে দেখা করতে আসে পরিচিত আরেক ছোট ভাই। আমাদের বাসা দেখতে যাই তাকে নিয়েই। কেনাকাটাগুলো রেখে ছোট্ট দুই রুমের বাসাটা দেখে আমার ভালো লাগে।

ভালো লাগে বাসায় ঢুকার দরজার সামনেই বিশাল জবা ফুলের গাছ দেখে। গাছ ভর্তি জবা ফুল, সুন্দর। বাসার ব্যাক ইয়ার্ড জুড়ে আপেল, আঙ্গুর এবং বেশ কয়েক রকমের গোলাপের গাছও চোখে পড়লো।

পরিচিত ছোট সেই ভাই জাহিদের গাড়ি করে ওর বাসায় যেয়ে দেখি আমাদের জন্যে ভীষণ বিস্ময় অপেক্ষা করেছিলো। সেই ছোট ভাইয়ের ছোট্ট বউ দীপা, কত হবে বয়েস ২০/২২, দারুণ সব রান্না করে টেবিল ভর্তি করে রেখেছে। ভীষণ আন্তরিকতায় খেতে দিলো সে। আরাম করে খেয়েদেয়ে সিনেমা দেখারও ব্যবস্থা করেছে আমাদের জন্যে। পুত্র নভঃ কিছু খেলনাও পেলো…

অল্প করে হলেও মন খারাপটা আমরা চাপা দিতে পারলাম। সেই রাতের জন্যে আবার আত্মীয়ের বাসায় ফিরে এলেও, পরদিন তাঁদের প্রতি সকল কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নিজের বাসায় উঠে গেলাম।

পরবাসী জীবনের একদম শুরুর এই সময়টা খুব বেশীই অন্যরকম। ধারণার বাইরে অনেক কিছু ঘটে। মানসিক খুব বেশীই শক্তি দরকার হয় সময়টা পার করবার জন্যে। এই সময় অল্প দুই একজন বন্ধু বা আত্মীয়ের সাহায্য খুব বেশী দরকার হয়। বিশেষ করে পরিবার নিয়ে এলে।

আমরা খুব খুব ভাগ্যবান সেটা পেয়েছি, তারপরও দিনশেষ মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে, আমাদের দিয়ে বোধ হয় হবেনা, কিন্তু হয়েছে, মেনে নিতে হয়েছে, মানিয়ে নিতে হয়েছে।

বাসা একটা ঠিক হয়ে গেলেই, সবার আগে আসে জব এর বিষয়টা। বিশেষ করে পরিবার নিয়ে এলে, একজনকে জব শুরু করাটা খুব বেশীই জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে এবং এর পাশাপাশি একটা গাড়ি। বাচ্চা ৩/৪ প্লাস হলে স্কুলের সাথে যোগাযোগ, এটাও জরুরী।

ব্যাংক একাউন্ট খোলা, মোবাইল ফোন, বাসায় গ্যাস বিদ্যুতের কানেকশন এইসব কাজও মাস্ট লিস্টেই রাখতে হয়।

আমাদেরও তাই করতে হয়েছে। সিডনী থাকা সময়েই মোবাইল এবং ব্যাংক একাউন্ট আগেই নেয়া হয়েছিলো বলে সময় একটু সেভ হলো এই শহরে এসে।

চাকরী খোঁজা এবং গাড়ী কেনাটা একটু বেশীই জরুরী এবং এই বিষয়ে যথাযথ টিপস নিয়ে নিলে ভালো। আমরা পেয়েছিলাম, এই বিষয়টি নিয়েই শুধু বলবো আগামী চিঠিতে।

আজ ছোট্ট একটা মজার অভিজ্ঞতা বলে শেষ করি, ২০০৯ এ এডেলেড সাউথ অস্ট্রেলিয়াতে ছিলো হাতে গোনা বাংলাদেশী। পথে চলতে গেলেই চোখে পড়তোনা, যেটা সিডনী দেখে গিয়েছিলাম।

একদিন সিভি হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে এডেলেড শহরে দিচ্ছি। যখন যেখানে যেভাবে পারছি। এক হোটেল লবিতে বসে আছি, হোটেল ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই বলে। একটু দূরের টেবিল থেকে বাংলা ছেঁড়াছেঁড়া কথা ভেসে আসছে, আমার ছোট্ট নভঃ হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে, আম্মু আম্মু বাংলা… ও সেই থেকে বাংলাদেশী কাউকে দেখলেই এভাবে বলে উঠতো, বাংলা বাংলা।

এইরকম ছোট্ট একটা অভিব্যাক্তিতে চোখে পানি এসে যাওয়ার কথা না, আমার হতো, দেশ ছেড়ে না এলে এই অনুভূতিটুকু অজানাই থাকতো বুঝি বা!!!

ধন্যবাদ যে আপনি পড়লেন সময় নিয়ে, ফিরবো চিঠি ১২ নিয়ে… বেঁচে থাকলে।

নাদেরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
১৮ নভেম্বর ২০১৭


Tags assigned to this article:
মেলবোর্নের চিঠি

Place your ads here!

Related Articles

RIP Syeda Nirupama Hossain

Sherele Moody: 33-year-old Syeda Nirupama Hossain was stabbed to death on Easter Sunday in Minto. Her children – aged six

বহে যায় দিন – সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলো

> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব > ৷৷ তিন ৷৷ সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলো আশির দশকের মাঝামাঝি ক্যাপিট্যাল হিলের ওপর

Let us usher in New Year 2013 with hope expectation!

In ancient days, there was no New Year. They used to say ‘in the tenth year of the reign of

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment