মেলবোর্নের চিঠি – ১
বিশেষত প্রবাস জীবন বেঁছে নেয়ার পিছনে থাকে কিছু টুকরো গল্প। সুখ-দুঃখ গল্পগাঁথা ছাপিয়ে শুরুতে কেবল একটা আশা বা প্রত্যাশার ভেলায় চড়েই মেঘ কেটে উড়াল দেয় নীল আসমানের বুকে ‘’একটা মানুষ’’ কিংবা তাঁর এক পৃথিবী নূতন স্বপ্ন!!!
আমিও তাই, প্রবাস জীবন বেছে নেবো, নিতে হতে পারে বা নিয়তি সবই ছিলো কল্পনার বাইরে। তারপরও সব মিলে ভীষণ অনিচ্ছুক আমিই কিনা ঠিক চলে আসি একদিন দূর পরবাসে। মানুষের কল্পনার বাইরে অনেক কিছু ঘটে, প্রতিটা মানুষের জীবনেই, আমিও হয়তো তার ব্যতিক্রম নই, এইটুকুন সান্ত্বনাই মনের এক কোণে দেই স্থান, পরবাস জীবনে পাড়ি দেয়ার একদম শুরুতে।
১৭ জুলাই ২০০৯ পরিবার নিয়ে চলে আসি অস্ট্রেলিয়া, অভিবাসন ভিসা নিয়ে। সাউথ অস্ট্রেলিয়া গভরমেন্ট স্পন্সরশিপ ভিসায়, শর্ত এডেলেড, সাউথ অস্ট্রেলিয়াতেই থাকতে হবে প্রথম দুই বছর। শুরুতে সিডনী’ত আসি ছোট ভাইয়ের ওখানে এক মাস থেকে শুরু করি আমাদের প্রবাস জীবন ১৭ অগাস্ট ২০০৯ সেই এডেলেড থেকেই।
‘প্রিয় অস্ট্রেলিয়া’র জন্যে শুরু করছি ধারবাহিক লেখা। বেঁচে থাকলে বলতে চাই না-বলা অনেক কথা, শেয়ার করতে চাই ভালোলাগা মন্দ লাগা, আশা ভালোবাসা, প্রত্যাশা প্রাপ্তি, স্বপ্ন ভঙ্গ বা একান্তই সব মিশ্র অনুভূতি এই পরবাসী জীবনের !!!
শুরু থেকেই শুরু করছি, প্রথম লেখাতেই প্রাসঙ্গিক ভাবে বলে নেই। আমার ভীষণ আগ্রহের জায়গা ‘’মানুষের মনোজগত’’ জীবন দর্শন। একটা মানুষের এই মনোজগতের অনেক কিছুই নির্ভর করে মানুষটির জন্ম, বেড়ে উঠা, জীবন অভিজ্ঞতা এবং তার থেকে নেয়া শিক্ষা। আমি আমার দেখা সময়কেই নিয়ে আসবো আমার কলমে একান্তই আমার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।
আমার জীবনের প্রায় গেলো আটটি বছর ধরে এমন মানুষদের ‘জীবন দর্শন’ একটু বেশীই টানছে, যারা প্রবাসী জীবন বেঁছে নিয়েছেন, নিতে পেরেছেন বা নিতে যাচ্ছেন! হতে পারে আমি এঁদেরই একজন বা কাছ থেকে অনেক কিছু অনুধাবনের সুযোগ আসছে বলে। নিয়মিত লেখার এই কলামটিকে বলা যেতে আমার ‘’পরবাসী মন’’ এবং মনন নিয়ে ভাবনা’র একটা ‘খোলা জানালা’’!!!
‘খোলা জানালায়’ প্রথম লেখাটায় শুধু একটা মানুষের প্রবাসী হওয়ার ঠিক আগের সময় নিয়ে কিছুটা বলি। বাংলাদেশ একটি মধ্যআয়ের দেশ আজ। একটা সময় পর্যন্ত ‘উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ ভ্রমন’ এই বিষয়টি থাকলেও, এর বাইরে আজ নানান বাস্তবতা খুব বেশীই কার্যকর মানুষদের প্রবাস জীবন বেঁছে নেয়ার পিছনে। কিন্তু ঠিক যে কারণগুলো মুল হিসেবে কাজ করে তারমাঝে নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক অবস্থা, যৌথ পরিবারে ‘একটি মেয়ের বউ হয়ে আসার পর’ উভয় পক্ষের মানিয়ে নিতে না পারা, নিরপত্তাহীনতা এবং উচ্চবিত্তের জন্যে হয়তো কেবলই একটা ‘সেকেন্ড হোম’’ এর অপশন, এই তো।
যার জন্যে যে কারণটিই কাজ করুক না কেন, একটা মানুষ যখন সিদ্ধান্ত নেয় বাইরে চলে যাবে দেশ ছেড়ে চিরতরে, সেই মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে পুরো ভিসা পাওয়া সংক্রান্ত বিষয়টিই ঘটে একটা ঘোরের মাঝে।
‘বাইরে চলে যাচ্ছি’ এটা একটা মোটিভেশন একদম শুরুতে। এরপর ধীরে ধীরে একটা আকাংখা, এরপর এর সাথে ক্রমশঃই যোগ হতে থাকে স্বপ্ন এবং তীব্র প্রত্যাশা, ‘পেতেই হবে সোনার হরিণ’ এই ঘোরেই অনেক অনুভূতির সাময়িক ছুটি ঘটে নিজের অজান্তেই, জীবন থেকে, কেউ টের পায়, অনেকেই পায়না।
অনেক কাঠ খর পুড়ে যখন মিলে উড়াল টিকেট তখন পর্যন্ত ‘মানুষটি’ কোনভাবেই অনুধাবন করতে পারেনা কি রকম ভাবে, কি ভীষণ ভাবে তাঁর পৃথিবী বদলে যাবে।
কেউ প্রবাসী হতে যাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা না। প্রায় প্রতিটা পরিবারের কেউ না কেউ আছে পৃথিবীর কোন না কোন দেশে।
তবে এটা ঠিক যে মানুষটি ভিটে-মাটি বন্ধক দিয়ে পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার জন্যে পাড়ি দিচ্ছে মূলতঃ ‘’মধ্যপ্রাচ্য’’ বা অন্য কোথাও শ্রমিক ভিসায় সেই মানুষটির মনোজগত, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের, আমরা যাকে বলি, উন্নত বিশ্ব, সেখানে চাকরী বা ইমিগ্রেশন নিয়ে পাড়ি দেয়া মানুষটির সাথে একটু ভিন্নতাই লক্ষণীয়।
যা অভিন্ন তা হচ্ছে প্রবাসী মানুষেরা ভীনদেশের নীল আকাশের নীচে অনেকবার কোন না কোনভাবে অনুভব করে ’হায় আমি আজ আকাশের মতো একেলা’। প্রবাসী মানুষ কোন না কোনভাবে এটা অনুভব করে দিনশেষে সে ‘একা’। যে নিবাসেই থাকুক চোখ মেলে, মেলেনা দেখা ‘চারপাশে সব আপন মানুষের’ যা নিজ দেশে থাকা অবস্থায় মাথায় আসেনি কখনও।
ফেলে আসা স্বদেশ তাই বুকের মাঝে অনেকবার অনেকভাবে ডাক দিয়ে যায়, বর্ণালী সব স্মৃতির ঝাঁপি নিয়েই চলে ‘প্রবাসের দিন রাত্রি’ সমান্তরাল!!!
‘’খোলা জানালা’’ দিয়ে তবে আসুক মুক্ত হাওয়া। যারা সময় নিয়ে পড়ছেন তাঁদের জন্যে শুভ কামনা। আর হে ‘পরবাস কাংখিত হোক, ভালোবাসাময় হোক’’ যে যেখানে আছেন লাল সবুজের দেশটি ছেড়ে!!!
নাদিরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া
অস্ট্রেলিয়া
Related Articles
লুইজি পিরানদেল্লো-র গল্প – যুদ্ধ – অনুবাদ: ফজল হাসান
রাতের এক্সপ্রেস ট্রেনে যে সব যাত্রীরা রোম থেকে রওনা হয়েছিলো, তাদেরকে সকালবেলা ছোট্ট ষ্টেশন ফেব্রিয়ানোতে নামতে হয়েছে । পরে যাত্রীরা
আগস্টের ছয় তারিখে ওপেনহেইমারের ‘লিটল বয়’এর তান্ডব
দিলরুবা শাহানা: একদিন পৃথিবীতে ডাইনোসররা ঘুরে বেড়াতো কোথায় তারা আজ? নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তাইতো। মানুষ এভাবে নিশ্চিহ্ন হবে না কারন
Bangladesh: Release Factory Inspection Reports
Bangladesh government and retailers have largely failed to make public the findings of factory safety inspections ordered after the April