নতুনত্ব

নতুনত্ব

সকাল সকাল চায়ের তেষ্টা পাগল করে দেয়। বাসি মুখে চা চড়িয়ে মুখে ব্রাশ গুজি। দক্ষিণের জানলাটা প্রায়ই খুলে রাখে টিপু। রাত করে জানলা খোলা রাখা মানে বিপদ। এই সেদিন পাঁচ তলার ফ্ল্যাট থেকে ডাকাতি হ’ল। এসব বললেও মাথায় থাকে না ওর। সারাদিন অফিস আর অফিস শেষে টি ভি’র সামনে বসে ঝিমনো ছাড়া আর কোন কাজ টিপু করে না। প্রথম দিকে ঝগড়া অভিমান করে দেখেছি, তাতে শুধু সময়ই অপচয় হয়। আমার কাজ হয় না।

নাস্তার টেবিলে রুটি ভাজি দেখে ঠোঁট উল্টায় স্বামী সাহেব, “ একটা ডিম তো ভাজতে পারতা…” আমি তখন ‘মুহূর্ত’কে তৈরি করছি। মুহূর্ত আমাদের ৫ বছরের মেয়ে। তাকে স্কুলের জন্য তৈরি করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। আমি ওর চুলের ঝুটি করতে করতে বললাম, ‘’পোঁচ করে দিব?” টিপু মুখ কালো করে বলল, “ লাগবে না।“

ওর মুখ কালো এখন আর আমাকে বিমর্ষ করে না। জীবনটা একহাতে চালাচ্ছি। সহযোগিতা করার যখন কেউ নেই তখন এসব ছোটখাটো মুখ কালো কে গুরুত্ব দেওয়ার কোন মানে হয় না।  হ্যাঁ, একটা সময় অনেক ছোট বিষয়ে কেঁদে ভাসাতাম। এখন জীবন বড্ড বেশী যান্ত্রিক। ভালবাসার ব্যাপার স্যাপার গুলো জৈবিক কিছু উদ্দামতা ছাড়া আর কিছুতেই কাছে আসতে চায় না। সেই উদ্দামতায় ও কি প্রেম থাকে? আমি তো খুঁজে পাই না। জীবন কেবলই একটা প্রয়োজনের নাম।

একটা ব্যাঙ্কে সারাদিন নিজের মাথা, মন, শ্রম খরচ করে যখন বাড়ি ফিরি তখন আর কিছুই ইচ্ছে করে না। কিন্তু মুহূর্ত যখন কোলে ঝাপিয়ে পরে আদর চায়, খেলতে ডাকে, পড়াতে বলে, তখন ভাঙ্গা শরীর নিয়ে ওকে সময়টুকু দিতে হয়। গত নয় বছরে টিপু ওর ভালবাসার দৌড় দেখিয়ে দিয়েছে। ভালবাসার মানুষের কাছে চাওয়াগুলো হয়তো বেশী থাকে, তাই অভিমান, যন্ত্রণার পাহাড় গুলো বেশ বড় হয়ে যায়।

মুহূর্ত হওয়ার আগে বেশ ছিল। টোনা টুনির ভালোবাসায় মাখোমাখো সংসার। মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া, জ্বর পরখ করা, ভয় পেলে রাত দুপুরে আকড়ে ধরা। ঘুম ঘুম সকাল গুলোয় এস্রাজের রেকর্ডে ঘুম ভাঙানো আর বিকেল গুলোয় কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়া। সময়ের সাথে এগুলো গায়েব হয়েছে, তাতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু এগুলোর বদলে যোগ হয়েছে, নির্লিপ্ততা, সময়হীনতা, প্রচ্ছন্ন অবহেলা আর ভালবাসাহীণ জৈবিক প্রেম, যা শুধু ঐ সময়ই আমাকে গুরুত্ববহ করে তোলে। তাও মাসে দু এক বার। আমি এই ভালোবাসাটুকুও চাই না।  ছ সাত মিনিটের এক পাক্ষিক তৃপ্তির পর যখন আমার উত্তেজনা শীর্ষে তখন অপরপক্ষের নাসিকা ধ্বনি ছাড়া আমার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। নির্লজ্জের মত নিজের অধিকার যে বুঝে নিতে চাইনা হঠাৎ হঠাৎ,  তা নয়, তবে তাতে অপমানকর প্রত্যাখ্যান থেকে বুঝেছি ভালবাসা এখন শূন্যের কোঠায়।

সারাদিনের না পাওয়া, হতাশা, অভিজ্ঞতার  কৌটো কারো কাছে উগরাতে ইচ্ছে হয়। টিপুর সময় কোথায়? আগ্রহই বা সেলফোন অথবা টিভির বাইরে পৌঁছে কিভাবে?

বন্ধুরা সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। কলিগ মৌটুসির সাথেই একটু আলাপ হয় অফিসে। মৌটুসি একটু বেয়াড়া, ঠোঁটকাটা। ওকে নিয়ে কেচ্ছাও কম না। তাই একটু সাবধানেই মিশতে হয়। তারপরও অফিসে আমাকে আর মৌটুসিকে নিয়ে নানা কথা লেগেই থাকে। ফরেন এক্সচেঞ্জের শাহেদ মৌটুসির বস। মৌটুসির ভাষায় ‘নাম্বার ওয়ান লুইচ্চা’। সে একদিন এসে আমাকে বলে, “মৌটুসির সাথে এত মিশেন না, অফিসের নানান জন নানান কথা বলে, আর আপনার ডিপার্টমেন্ট তো আলাদা। নিজের রেপুটেশন বজায় রাখেন।“ আমি শুনে তব্দা মেরে গেছি। মৌটুসি যখন লাঞ্চ আওয়ারে টেনে নিয়ে গেল তখন বলতে বাধ্য হলাম। শুনে বলে, “ শালা কাল আমাকে ওর ফ্ল্যাটে ডেকেছিল, মুখের উপর বলছি, স্যার আমি আমার হজব্যান্ডের সাথে  স্যাটিসফাইড তাই যেতে চাচ্ছি না।“

সে যাই হোক, এগুলো থেকে দূরেই থাকতে চাই। জীবনের রোজকার ধকল তো কম নয়।

কিন্তু, একটা নতুন কাহিনী আমি না চাইতেও শুরু হয়ে গেছে। মাস খানেক আগে একজন ইন্টার্ন জয়েন করেছে। শিল্প সরকার।  ৬ফুট লম্বা, কালো, চওড়া বুক আর গভীর চাউনির এক ছেলে। আমার চেয়ে বছর সাতেক ছোট তো হবেই। ক’দিন যেতেই খেয়াল করলাম আমার দিকে তার ভিন্ন চাউনি। নোংরা কিছু নয়, চোখে ভীষণ আগ্রহ যেন আমার প্রতি। নানান কথায় আমার প্রসঙ্গ আনা, আর ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে আমার ডেস্কে গোলাপ আর চকলেট রাখায় যখন জিজ্ঞাস করলাম যে আমাকেই কেন, তখন বলল, “আপু আপনাকে ভাল লাগে তাই।“ আমি আকাশ থেকে পড়লাম এই পিচ্চির পাকামী দেখে। একদিন বৃষ্টির সময় তো জোর করে সি,এন,জি তে লিফট দিল। তবে কোন আসভ্যতা এখনও করেনি। যেদিন করবে, সপাটে চড় কশাবো হয়তো!

মৌটুসি বলে, “আরে প্রেম কর, লাইফটা তো ভেজিট্যাবল করে রাখছিস!”

আমি চাপা গলায় বলি,” তোর কি মাথা খারাপ! বাচ্চা একটা ছেলে!”

মৌটুসি মুখ ঝামটা মেরে বলে, “ বাচ্চা না ছাই! তোর ছবি ওর সেলফোনের স্ক্রিন সেভার করে রাখা, সারাদিন রাত দেখছে তোকে…”

আমি অবাক হয়ে গেলাম। মৌটুসি বলল, “ তুইও শয়তান কম না, না চাইলে এখনি রাশ টান, নাইলে চালায়ে যা…”

আমি ভাবলাম, “ তাই তো, আমিও কি এসব বেশ এনজয় করছি? একটা ছেলের অ্যাটেনশন, ভাললাগা ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে! এই যে সেজেগুজে আসি, আমি কি চাইনা  শিল্প আমাকে দেখুক। আমি কি টিপুর অবহেলা, বা ওর মুগ্ধতার কথা আদৌ ভাবি এখন?   কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এটা কি করছি আমি, নিশ্চিত সর্বনাশ!

আমি গুটিয়ে নেই অনেকটা। মৌটুসির সাথেও আর ইন্টার‌্যাকশন আগের মত রাখতে ইচ্ছে হয় না। শিল্প টেবিলে কাজ নিয়ে আসলে বাড়তি সময় দাঁড়িয়ে থাকে, ইতস্তত করে। আমি কম্পিউটারের মনিটরে চোখ অনড় রেখে বলি, “ আর কিছু বলবে?” শিল্প মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।

ভাললাগা গুলো হঠাৎ যেন মুখ থুবড়ে পড়ল। সেই আগের গৎ বাঁধা জীবন, তাতে কোন আনন্দ নেই।

মৌটুসি একদিন চেপে ধরে, “ কি হইছে তোর?

আমি বলি, “ কিছুই না, সারাদিন তো গাধার মত খাটি নতুন আর কি?”

-“ আয়না দেখিস? চেহারা কদিন আগেও মাধুরীর মত ছিল এখন ময়নার মা হয়ে গেছে…।“

আমি আয়না দেখি, সত্যি! বড় বেশী বিষণ্ণ আর ক্লান্ত। চোখের নিচে কত রাতের আঁধার কে জানে…। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি নিজের অজান্তেই।

এক রাতে টিপুর সাথে চূড়ান্ত ঝগড়া হলো। ঝগড়া শেষে কাঁদলাম একা একা। টিপু টেলিভিশন দেখতেই থাকল। আমার অভিমান মোছাতে সে আসবে না জানি। তাই একাই নিজেকে সামলাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় একটা টেক্সট এলো। শিল্প পাঠিয়েছে। কিছু কথা সে বলতে চায়। আমার যেন মনে হল আমার এখন কারো সাথে কথা বলা দরকার। আমি ফোন নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। টিপু তাকালো না পর্যন্ত।

শিল্পের সাথে অনেকক্ষণ কথা হ’লো। ও ওর অনুভুতি প্রকাশ করল সাহস করে। বড় বেশী পছন্দ করে আমায়। বলল, “ শাবিন, আমি জানি আপনার যে অবস্থান তা থেকে আপনি আমাকে কখনই গ্রহণ করতে পারবেন না, আমারও যে গ্রহন করার মত পরিস্থিতি আছে তাও বলব না, তবে প্রেম যদি বলেন তাহলে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে গ্রহন আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার ভাললাগা বলেন বা ভালবাসা বলেন অনেক গভীরে চলে গেছে। আমি আপনার সবটা দাবী করতে পারি না, কিন্তু কিছু সময় কি ভিক্ষে পেতে পারি।“

আমি শুনে নিশ্চুপ হয়ে যাই।

শিল্প বলে, “ জবাব আজ চাই না। কাল যদি আগের মত আপনাকে দেখি তাহলে আমি বুঝে নেব।“

আমি ফোন কেটে দেই। একা একা অনেকক্ষণ তারা দেখি। নিজের সাথে অনেক কথা হয়। মন অসভ্যের মত আগামীকালের  পোশাক সিলেক্ট করে, সাথে সাথে শিল্পের মুগ্ধ দৃষ্টি ভাসায়। আমি হালকা চালে ঘরে ফিরি।

Naina Shahrin Chowdhury

Naina Shahrin Chowdhury

Enlisted Singer, Lyricist Bangladesh Betar & Television. Writer.


Place your ads here!

Related Articles

ক্রিকেট অধিনায়ক ছিল এক জঙ্গি

ক্রিকেটের বাইশ গজে থাবা বসাল আইএস৷ তবে মাঠে জঙ্গি হামলা নয়৷ ক্রিকেট দলেই লুকিয়ে ছিল এক জঙ্গি! এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য

My teacher Dr. Abu Usuf Alam and a unsolved question

আমার স্যার ড. আবু ইউসুফ আলম এবং একটি অমিমাংসিত প্রশ্নঅধ্যাপক নজরুল ইসলাম হাবিবী (লন্ডন থেকে) ১৯৮৪-৮৫ সেশনের শিক্ষা বর্ষে আমি

Land erosion by rivers brings miseries to millions of people

Rivers are the life-blood of Bangladesh. In fact Bangladesh’s land territory owes to its physical existence to rivers, that carried

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment