উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক

উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক

উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক , বিলকিস রহমান রচিত প্রথম গ্রন্থ, তাঁর গবেষণার আলোকে লেখা।

পড়ে শেষ করলাম বইটি, পড়তে যেয়ে একটু বেশী সময় নিয়েছি, নিতে হয়েছে। আমাকে ভাবিয়েছে বইটি, তথ্য উপাত্ত অবাক করেছে, কখনও কষ্ট পেয়েছি, গুমরে কান্না নিয়ে কাটিয়েছি অনেকটা সময়। নিজের অজান্তেই করুণাও হয়েছে এই সময়ের কিছু নারী জীবন দেখে। সেই বৈরী সময়ের কতোটা পাড়ি দিয়ে এসেছি আমরা যদি তা উপলব্ধি করতো তাহলে স্বেচ্ছায় কেউ কেউ যেমন জীবনধারা বেঁছে নিয়েছে তা ভাবাতো, নিশ্চয়ই ভাবাতো!

(বইটির মুখবন্ধ, প্রচ্ছদ এবং লেখক পরিচিতি ছবিটি আমার এই আলোচনায় পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় যুক্ত করে দিয়েছি)।

এবং বলে নিতে চাই, আমি নিতান্তই একজন সামান্য পাঠক হিসেবে এটি পড়তে যেয়ে যা আমাকে ভাবিয়েছে এবং মনে হয়েছে আরো আলোচনার দাবী রাখে সেই হিসেবেই পুরো বইটি’র একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

বইটি নিয়ে মূল আলোচনায় চলে যাই, ২৬৮ পৃষ্ঠার বইটিতে তুলে আনা হয়েছে কয়েক শত তথ্যসুত্র, উইল পরিচিতি, কর্জ পত্র, কিছু তালাকনামা, খোরাকিনামা, সরকারি দলিল ও প্রকাশনা, শতাধিক আত্মজীবনী, স্মৃতি কথা, সমসাময়িক জীবনীসমূহ। লেখককে গবেষণার জন্যে সাহায্য নিতে হয়েছে প্রচুর সংবাদ-সাময়িকপত্র, এপাড় বাংলা ওপাড় বাংলার, অনেক অনেক সংবাদ-সাময়িক পত্রের সংকলন, চিঠিপত্রের সংকলন ও রোজনামচা, সাক্ষাৎকার, শতাধিক সহায়ক গ্রন্থ এবং প্রবন্ধের।

সময়, জুন ২০১৩, বইটি শুরু হয়েছে ‘প্রসঙ্গ কথা’ দিয়ে, লেখক বিলকিস রহমান বলে দিয়েছেন ‘এই গ্রন্থটি আমার পিএইচ.ডি. অভিসন্দর্ভের উপর ভিত্তি করে লেখা। অভিসন্দর্ভটির জন্য আমাকে ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. প্রদান করা হয়’। একদম শুরুতেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন ‘’নারীপুরুষ সম্পর্ক’!

লেখক বলছেন, ‘বিবি কুলসুমের রোজনামচা’ প্রথমআলোতে প্রকাশিত হলে মীর মোশাররফ হোসেনের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আমার জীবনী ও কুলসুম জীবনী-তে প্রতিফলিত আদর্শ সুখীদাম্পত্য চিত্র প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো অনেককেই। পরস্পরের বিপরীত চিত্র পড়তে পড়তে আমার মনে প্রশ্ন জাগে সেই সময়ে নারীপুরুষ সম্পর্ক আসলে কেমন ছিলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমার এই গবেষণা ‘উনিশ শতকে বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীপুরুষ সম্পর্ক’।

এই প্রসঙ্গ কথাতেই কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেছেন, কাজটি করতে যাঁদের সাহস, সাহায্য এবং সহযোগিতা পেয়েছেন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে।

লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন বইটি, সূচিপত্রেই আছে তা উল্লেখ। মুখবন্ধ, প্রসঙ্গকথা, ভুমিকা, পাঁচটি অধ্যায়, উপসংহার, পরিশিষ্ট এবং তথ্যসুত্র।

মূল বইটি পড়বার আগে ভুমিকাটিই অনেক বেশি মনোযোগের দাবী রাখে। কেন উনিশ শতক বেঁছে নিলেন, এই প্রশ্ন মাথায় আসার আগেই পেয়ে যাই লেখকের ব্যাখ্যা।

‘উনিশ শতক বাংলার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। উনিশ শতককে বলা হয় বাংলার নবজাগরণের সময়। নবজাগরণ বা ‘রেনেইসান্স’ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও গোটা উনিশ শতক জুড়েই বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক – সব ক্ষেত্রেই চলতে থাকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যা বাংলার পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এবং এই শতকে ‘ভদ্রমহিলাদের’ নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে কোনো মৌলিক গবেষণা হয়নি বলেই লেখক বলছেন এই ভুমিকাতেই।

বলে দিয়েছেন বড় বাধা উপকরনের সীমাবদ্ধতা, চিঠি, ডায়েরি এবং দলিলাদিতে সম্পর্কের উপকরণ খুঁজতে যেয়ে দেখেছেন সেখানে দাম্পত্য বিষয়ক প্রসঙ্গ বা যৌন সম্পর্ক সচেতন বা অসচেতন ভাবেই এড়িয়ে গেছেন।

প্রাসঙ্গিকভাবে ভুমিকাতেই এসেছে অনেক গবেষক মতামত। সম্বুন্ধ চক্রবর্তী, উনি দেখিয়েছেন যে, মেয়েদের জীবন ও সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে এত লেখালিখি, চিন্তাভাবনা আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও নারীপুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টি দু’একজন ছাড়া কেউ আলোচনা করেননি এবং স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী পুরুষেরাও পুরুষ ও নারীর শিক্ষার ক্ষেত্রে পার্থক্য টানতে উৎসাহী ছিলেন।

বলছেন, যে সমাজে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল, সেখানে দাম্পত্য সম্পর্কের সীমানা সহজেই অনুমিত হয়।

লেখক ভুমিকাতে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারনা করেছেন, পূর্ববর্তী গবেষণায় দাম্পত্য জীবনের পরিচয় দিতে গিয়ে কখনো কখনো দাম্পত্য সম্পর্কের বাইরে নারীপুরুষের সম্পর্কের কথা উল্লেখ হয়েছে তবে কি পরিস্থিতিতে একজন দাসী, বাঁদি বা খাদিমা অনুরূপ জীবনগ্রহণ করে এবং কী পরিস্থিতিতে কেউ উপপত্নী বা রক্ষিতা হয় অথবা বারবনিতা হিসেবে নাম লেখায় তার বিশদ অনুসন্ধান পূর্ববর্তী গবেষণায় পাওয়া যায়না।

উল্লেখযোগ্য ভাবে ভুমিকাতে উঠে এসেছে দাম্পত্য সম্পর্কে ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা, হিন্দু ও মুসলিম ধর্ম আইনে নারীপুরুষ সম্পর্কের বিধান ও নীতিশাস্ত্রে তুলে ধরা দাম্পত্য চিত্র এবং সনাতন মুল্যবোধের কথাও।

ভুমিকায় লেখকের যে অনুসন্ধানটি আমাকে ভাবিয়েছে, ‘বিবাহপূর্ব প্রণয় বলতে একসময় একধরণের সমাজ বিগর্হিত ও কুলষিত সম্পর্ক বোঝাত, উনিশ শতকের বাংলা নাটক/প্রহসনে এর যথেষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।

লেখক উনিশ শতকে বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারে নারীপুরুষ সম্পর্ক গবেষণা ব্যাখায় বলছেন, বিষয় নির্বাচনে, ‘বাংলা’ বলতে ঔপনিবেশিক বাংলা, অবিভক্ত বাংলা অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ এবং এর দুটি প্রধান শহর কলকাতা ও ঢাকাকেই, গবেষণার মূল স্থান হিসেবে নিয়েছেন। প্রাধান্য দিয়েছেন, শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণিকে।

বাংলায় গোটা উনিশ শতক জুড়ে সামাজিক পরিবর্তনের যে পালা বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারে পড়ে তার প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো আলোচনায় স্থান পেয়েছে।

আরো জানিয়েছেন, এই গবেষণায় মুলত সনাতন ইতিহাস গবেষণার ধারা অনুসরন করা হয়েছে, নেয়া হয়েছে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পদ্ধতিরও।

প্রশ্ন আসতেই পারে গবেষণায় মধ্যবিত্তশ্রেণি কারা, ভুমিকাতেই পেয়ে যাচ্ছি তারও ধারণা ‘সাধারণ অর্থে মধ্যবিত্তশ্রেণি বলতে তাদেরকেই বলা হয়, যারা শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বুদ্ধিমত্তা ব্যাবহারের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমাজ কাঠামোয় এক স্থায়ী অধিষ্ঠিত স্তর গঠন করেছে।

মধ্যবিত্তশ্রেণির বৈশিষ্টের মধ্যে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবোধ, কর্মক্ষেত্রে উন্নতিলাভের প্রয়াস, সামাজিক- সাংস্কৃতিক মুল্যবোধ, সম্মানবোধ, পরিবারের ও সন্তানের শিক্ষা এবং একক পরিবারের প্রতি আকর্ষণ অন্তর্ভুক্ত।

বাংলা ভাষায় ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দের আবির্ভাব হয় উনিশ শতকের প্রারম্ভে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে এটি বাংলার শিক্ষিত সমাজে ব্যাপকভাবে ব্যাবহৃত হতে থাকে এবং তখন এটি ভদ্রলোকের সমার্থক ছিলো।

এই বিষয়ক আলোচনার ধারণাকেই লেখক ঈষৎ সম্প্রসারিত করে শিক্ষিত পেশাজীবী ও ব্যাবসায়ী ছাড়াও ভূস্বামীশ্রেণি এবং অবস্থাসম্পন্ন কৃষককেও এই গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

প্রাসঙ্গিঙ্কভাবে উঠে এসেছে ‘উনিশ শতকে ইংরেজ শাসনের অভিঘাতে সমাজব্যাবস্থায় কতগুলো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। গ্রামকেন্দ্রিক স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজে ভাঙ্গন ধরে, জীবনযাত্রা হয়ে উঠে শহরমুখি। এবং কতিপয় হিন্দু পরিবারের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বাংলায় আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির প্রাথমিক বিকাশ হয়েছিলো ১৮৩৫ এ।

১৮৭০ সালের দিকে সরকার দৃষ্টিপাত করেন মুসলমান সমাজের পশ্চাৎপদতায়। ১৮৭১ থেকে ১৮৮৫ পর্যন্ত শিক্ষাবিষয়ে মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ভুমিকার যে তথ্যটি আমার কাছে ভীষণ চমকপ্রদ, ‘উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মফস্বল শহরগুলো ছিল প্রায় নারীবর্জিত। গ্রামই ছিল মানুষের স্থায়ী ঠিকানা ও পরিচয়, চাকুরেদের জন্য শহর ছিল অস্থায়ী নিবাস। সামাজিক উৎসবে সরকারী ছুটি হলে মানুষ ছুটে যেত পৈত্রিক নিবাস গ্রামে, শহর হয়ে পড়তো জনশূন্য।

বিস্তারিত আলোচনার আগে, ভুমিকাতে লেখক উল্লেখ করেছেন, পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম, সাধারণ বিশ্বাস এবং অনেকাংশে বিজ্ঞানও মনে করে যে, নারীপুরুষের সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক সমতার মুলে রয়েছে শারীরিক পার্থক্য।

জীববিজ্ঞানের যে সুত্র বলে নারী ঘরে, পুরুষ বাইরে কাজ করবে, এর জৈবিক কোনো ভিত্তি নেই। সমাজ এ কর্ম বিভাজন সৃষ্টি করে।

এই বিষয়ে বেশ কিছু মতবাদ লেখক তুলে এনেছেন, চমকপ্রদ দুটি উল্লেখ করি। মেরি অলস্টোক্র্যাফটের মতে , শিল্পবিপ্লবের আগে যুক্তরাজ্যে সকল উৎপাদী কর্মকাণ্ডে নারীপুরুষ উভয়েই অংশ নিত। শিল্পবিপ্লবের পর পুরুষ বাইরে কাজ নেয়, নারী ঘরে থেকে যায়। উৎপাদী কর্মহীন গৃহবধূ যাদের স্বামী অপেক্ষাকৃত ধনী পেশাজীবী বা উদ্যোক্তা তারা গৃহকর্ম চাকর-বাকরদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ঘরে বন্দি নিষ্কর্মা শয্যাসঙ্গিনীতে পরিণত হয়। মেরি এই মধ্যউচ্চবিত্ত ও বুর্জোয়া পরিবারের স্ত্রীদের খাঁচায় বন্দি রঙিনপুচ্ছ পক্ষিকুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

আমি মেরির এই মতবাদটি পড়তে যেয়ে বেশ কিছু সময় থমকে ভেবেছি, হায় এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও কি এই উপমহাদেশে এমন নারীর সংখ্যাটি নগণ্য হবে?

আরো একটি তথ্য লেখক নিয়ে এসেছেন, ‘গৃহস্থালী ও কর্মস্থল দুইই সামলাতে গলদঘর্ম কর্মজীবী মহিলাকে বেটি ফ্রিডান ‘অতিনারী’ বা Super Women আখ্যা দিয়েছেন। কারণ তাকে দুই রণাঙ্গনে নিখুঁত চরমউৎকর্ষতা অর্জন করতে হচ্ছে। স্বভাবত কর্মজীবী স্ত্রী তথা ‘অতিনারী’ কেবলমাত্র গৃহকর্মে ব্যাপৃত গৃহিণী স্ত্রীর চেয়ে কম নির্যাতিত নয়।

ভুমিকাতে তুলে নিয়ে এসেছেন লেখক আরো অনেক সমাজ বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, চিন্তাবিদ এবং অর্থনীতিবিদের মত, যার প্রায় সবগুলোই আমাদের মাঝে নানান প্রভাব এবং চিন্তার ছাপ রেখে যায়।

আমাদের অনেকেরই পড়া এবং জানা, মার্কসীয় নারীবাদীদের একটি মত, শ্রেণিমতে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে নারীনির্যাতন স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য।

মার্কসের সঙ্গে একমত পোষণ করে এঙ্গেলস বলেন, উৎপাদনের নাটাই যতদিন নারীর হাতে ছিল, ততদিন পরিবারে পরিবারে নারীর প্রাধান্য ছিল; উৎপাদনস্থল ও উৎপাদন ধারা পরিবর্তিত হলে নারীর প্রাধান্য লুপ্ত হয়, উৎপাদনে পুরুষের ভুমিকা যত বৃদ্ধি পেল নারীর ভুমিকা হল তত গৌণ।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাতৃঅধিকার উৎখাত হলো। সমাজে নারীর অবস্থানের এই বিপর্যয়কে এঙ্গেলস ‘নারীর ঐতিহাসিক বিশ্ব পরাজয়’ বলেছেন। তাঁর মতে, একজন পুরুষ নারীর একমাত্র স্বামী থাকবে, আর কোন স্বামী থাকবে না – এই তত্ত্ব পুরুষের সৃষ্টি। এর উদ্দেশ্য পিতার সম্পত্তি পুত্রে হস্তান্তর নিশ্চিতকরণ।

বইটির ভুমিকাতেই লেখক বিলকিস রহমান বলছেন, এই গবেষণায় ‘নারীপুরুষ’ সম্পর্ক বলতে প্রধানত দাম্পত্য সম্পর্কেই গন্য করছেন। প্রশ্ন এনেছেন ‘দাম্পত্য সম্পর্ক কী? শুধু কি নারীপুরুষের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জীবন পরিচালনাই দাম্পত্য সম্পর্ক? নাকি তা কেবলই নারীপুরুষের প্রাতিষ্ঠানিক যৌন সম্পর্ক? আরো বলছেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীপুরুষের অবদান, মর্যাদা এবং ভূমিকা ভিন্নতর এবং বৈষম্যমূলক।

এইসব মতামতের ধারাবাহিকতায় আরো উল্লেখ করেছেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে একটা ভাববিপ্লব দেখা দিল। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাবে বাঙালি জীবনে প্রেম অর্থাৎ রোমান্টিক প্রেম দেখা দিল। লেখক তাঁর গবেষণায় আরো যে দৃষ্টিভঙ্গির অনুসন্ধানকে ভিত্তি হিসেবে নিয়েছেন, সেটি রজতকান্ত রায়ের মত, ‘মানসিকতা, আবেগ, সংস্কৃতি ও যৌনমনস্কতাকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা যাবে না। নারীপুরুষের মধ্যে আবেগ-ভালোবাসা পরিমাপ করা যায় না, কিন্তু পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এগুলি প্রকাশ পায়।

উঠে এসেছে, নারীপুরুষ সম্পর্ক নিয়ে তাত্তিক মতবাদগুলোর মুলবিষয়গুলো। একদমই জানা নেই যাঁদের বিষয়টি, তাঁদের জন্যে চমকপ্রদই হবে।

প্রথম মতবাদ, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় নারীপুরুষের সম্পর্ক মূলত দেহভিত্তিক। নারীদেহ হলো পুরুষের কর্ষভুমি। এই ভুমিতে পুরুষ তার বীজ বপন করে। এই বীজবপনের প্রক্রিয়াটি তার জন্যে চরমআনন্দদায়ক হয়ে থাকে। বীজবপনের ফলস্বরূপ পুরুষ পায় তার বংশের উত্তরাধিকারী।

দ্বিতীয় মতবাদটি, প্রতিতত্ত্ব বা বিতত্ত্ব যাকে ‘দেহনির্ভরতার অস্বীকৃতি’ বলা যায়। এই মতবাদে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে নারীপুরুষের যৌনাধিকার অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। তবে নারী বা পুরুষ যে একে অপরের প্রতি কেবল যৌন আকর্ষণ বোধ করবে সেটা আবশ্যিক বলে ধরা হয় না।

তৃতীয় মতবাদটি, ‘সমন্বয়ী তত্ত্ব; বা ‘বন্ধুত্বনির্ভর’ মতবাদ। বলা যেতে পারে উপরিউক্ত দুটির সমন্বয়। মানুষের নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বের বিষয়টিকে এখানে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, যা এড়াতে মানুষ বন্ধু খোঁজে। যখন ‘মনের মানুষ’ পায়, বন্ধুত্ব পায় এবং তা চূড়ান্ত রুপ নেয়। আর এই বন্ধুত্বের চূড়ান্ত রুপেই আসে দৈহিক মিলন এবং যৌন পরিতৃপ্তি। এই মতবাদে নরনারীর দেহ বা যৌনতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। একমাত্র দৈহিক আকর্ষণই নারীপুরুষ সম্পর্কের ভিত্তি, অস্বীকার করা হচ্ছে এটিকে।

আলোচিত এই তিনটি মতবাদের প্রতিফলনই আছে এই গবেষণা গ্রন্থে। লেখক তাঁর বইটির ভুমিকার শেষ অংশে এসে বলছেন আধুনিক পরিবারে নারীপুরুষ পরস্পরের পরিপূরক। স্ত্রী হলো পরিবারের নৈতিকতার প্রতিক। অন্যদিকে পুরুষ আর্থিক যোগানদাতা।

পরিবারে নারীপুরুষ সম্পর্ক বলতে মাতা-পুত্র, পিতা-কন্যা অথবা ভ্রাতা-ভগিনী এই সম্পর্কগুলোকে লেখক তাঁর গবেষণায় অন্তরভুক্ত করেননি।

যদি প্রশ্ন উঠে, নারীপুরুষ সম্পর্ক না বলে দাম্পত্য সম্পর্ক বলা হয়নি কেন, লেখক বলছেন, যেহেতু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বাইরেও দৈহিক সম্পর্কের বিষয় জড়িত তাই দাম্পত্য না বলে নারী পুরুষ শব্দ গ্রহন করেছেন, এই সম্পর্ককে তাত্ত্বিক কাঠামোয় ফেলা কঠিন।

পুরো ভুমিকাতেই বইটি নিয়ে একটা ধারণা মনে উঠে এসেছে।

লেখক আলাদা করে প্রতিটি অধ্যায়ে তাঁর নির্বাচিত বিষয়ে আলোচনা করেছেন। প্রতিটা আলোচনার শেষে যুক্ত হয়েছে বিস্তারীৎ তথ্যসুত্র, যা পড়তে যেয়েও পড়তে ভালোবাসেন এমন অনেকেই চমককৃত হবেন আমি নিশ্চিত এবং আগ্রহ হবে এই বিষয়ক আরো পড়াশুনার!!!

প্রথম অধ্যায়ঃ সনাতন মূল্যবোধ

তেরটি ছোট অধ্যায়। লেখক এই বিষয়ে প্রথমেই উল্লেখ করছেন, উনিশ শতকের শুরুতে নারীপুরুষ সম্পর্কের যে চিত্র পাই তা প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সমাজের মতোই ছিল।

নারীপুরুষ সম্পর্ক বিষয়ে সনাতন মূল্যবোধ তথা চিরায়ত বাংলার পারিবারিক জীবনবোধ কেমন ছিল তা মূলত জানা যায় ধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে।

মধ্যযুগের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আরো জানা যায় প্রধানত সাহিত্য ও নীতিশাস্ত্র থেকে এবং বিদেশি পরিব্রাজকদের বিবরণে। তবে এ সকল গ্রন্থই অবশ্য সংকলিত বা লিখিত হয়েছিল পুরুষের দ্বারা, সুতরাং তাতে মূলত ধরা পড়েছে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি।

উনিশ শতকে বাংলার পারিবারিক বিবর্তনের ধারা তুলে ধরা হয়েছে পারিবারিক কাঠামোর এবং এ সংশ্লিষ্ট আদর্শিক দিক যা পরিবারকে পরিচালিত করে অর্থাৎ পিতৃতন্ত্র। আর পরিবারের মুল ভিত্তি হলো বিয়ে, উঠে এসেছে বিয়ের সকল আচার-অনুষ্ঠান এবং এগুলোর মাধ্যমে পারিবারিক জীবনে নারীপুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক।

১: জানা যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে উনিশ শতকের শুরুতে এবং সাম্প্রতিককালে বাংলায় যে পরিবার তার মধ্যে একটি বন্ধন আছে। একটি অখন্ড হিন্দু পরিবার শুধু সম্পত্তির হিসেবেই যৌথ ছিলোনা, ছিলো খাওয়া দাওয়া ও অভিবাবকত্বের দিক থেকেও। সাধারণত পিতা পরিবার প্রধান থেকে সমস্ত ব্যায়ভার করে নেতৃত্ব দিতেন, মাতা তাঁর স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের সেবা করতেন।

পিতৃতান্ত্রিক যৌথ পরিবার প্রথা দীর্ঘকাল কঠোর লিঙ্গবৈষম্য ব্যাবস্থার মাধ্যমে গড়ে উঠে। ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে নারীর সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকরন দৈনন্দিন কর্মবিভাজন যার বৈশিষ্ট। পরিবারে পুত্র ও কন্যার ভিন্ন ভূমিকা, অবস্থান, ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালন করার শিক্ষা দেয়া হতো। পুত্রসন্তানকে সেই পরিবারের স্থায়ী সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষিত করে তোলা হত। অন্যদিকে কন্যাসন্তাকে সেই পরিবারের স্থায়ী সদস্য হিসেবে দেখা হতো!
যৌথ, বিস্তৃতি বা একক ধরনের পরিবারে নারীর বিভিন্ন প্রকার স্থান ও ক্ষমতা নির্ধারিত থাকলেও স্বামীর কর্তৃত্ব ও জ্যেষ্ঠতা কখনও লঙ্ঘিত হতো না। সনাতন পরিবারে বধুর ভুমিকা কঠোরভাবে শাশুড়ির কর্তৃত্ব , তত্বাবধান ও নির্দেশের অধীন থাকতো।

এই বিষয়ে লেখক অপরাপর আলোচক, গবেষক এবং ধর্মগ্রন্থের মত তুলে এনেছেন। সবই চমকে যাওয়ার মতন। ‘প্রাচীন বাংলার পিতৃশাসিত সমাজ পুরুষের সমান সুযোগ নারীকে বঞ্চিত করেছিল। ধর্মশাস্ত্রকারদের বিধান-অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসে খেতো না। তবে রাজকীয় ও বিত্তবান পরিবারে কখনো কখনো স্বামী-স্ত্রী বাজি ধরে পাশা খেলতো।

সেই সময় চাপিয়ে দেয়া নানান শৃঙ্খলায় নারীর যে রুপ উঠে আসে তা মর্যাদাহীন। নারীকে একজন পৃথক ও একক ব্যাক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো না এবং জীবনের কোন ক্ষেত্রেই সে স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে পারতো না।

উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকেও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন প্রেক্ষিতে পরিবারের রুপ ও কর্মকান্ডে প্রভাব রেখেছে, একই সময়ে বিভিন্ন ধরণের পরিবার সহাবস্থান করেছে।

এই অধ্যায়টিতে, একান্নবর্তী পরিবারে বা যৌথ পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনে অসুখী পারিবারিক জীবনের চিত্রও উঠে এসেছে। পরিবারে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যতা কতোটা লঙ্ঘিত হতো, তা উল্লেখ করা হয়েছে কিছু সাহিত্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে। উল্লেখ করা হয়েছে ‘বিশ শতকের সাহিত্যেও বিশেষ করে শরতচন্দ্রের উপন্যাসে এবং রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’’ এবং ‘হৈমন্তী’’ গল্পের কথা’।

বিশেষ আরেকটি তথ্য হচ্ছে, উনিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত শিশু মৃত্যুহার খুব বেশি থাকায় পরিবারের আকার খুব বড় হতোনা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের উদাহরণটি এর বাইরের।

১৮১৭, লোকগণনায় মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রথমে জানা যায়। মুসলমান সমাজে একান্নবর্তী পরিবারের কোন ধর্মীয় অনুশাসন নেই, হিন্দু একান্নবর্তী পরিবারের প্রভাব থাকলেও মুসলমানেরা তা সর্বাংশে গ্রহণ করেনি। ফলে সংখ্যাধিক্য মুসলমান পরিবারগুলোয় পরিবর্তন দেখা যায়।

২: ঘুরে ফিরে তা উঠে আসে, পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে পুরুষের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। অন্তঃপুরবাসিনীদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার মুল্য সেখানে ছিলনা। পরিবারে স্ত্রীর স্থান ছিল স্বামীর অনেক নিচে। পন্ডিতেরা স্বীকার করেন যে পরিবারের ক্ষমতার বিন্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে যে পিতৃতন্ত্র, তার মুলকথা, পরিবারে এবং মানবজীবনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সকল ক্ষেত্রে পুরুষ প্রবল প্রতাপে আধিপত্য করবে; কিন্তু নারী থাকবে ক্ষমতাহীন এবং বাস করবে লোকচক্ষুর অন্তরালে অন্তঃপুরে।
পিতৃতন্ত্র নারীকে দুর্বল, বুদ্ধিহীন, মানসিক ভারসাম্যহীন, ভিতু, হঠকারী ও আবেগপ্রবণ, চিত্রিত করে, অপরপক্ষে, পুরুষকে চিহ্নিত করে সবলদেহী, প্রত্যয়ী, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ হিসেবে। বিভেদাত্মক গুণ ও স্বভাব আরোপ করে পিতৃতন্ত্র বিধান দেয় যে, পুরুষের আশ্রয় ও তদারকি ছাড়া নারী বাঁচতে পারেনা। ‘

নারী পুরুষ সম্পর্ক বিশ্লেষণে লেখক নিয়ে এসেছেন ধর্মীয় ব্যাখাও, ‘যদিও তত্ত্বগতভাবে ইসলাম ধর্মে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার সম্ভবনা রয়েছে, তবু পর্দার মাধ্যমে মহিলাদের বিচ্ছিন্নকরণ এবং পুরুষের প্রতি আনুগত্য ইসলামি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা রাখে।

৩: এই অধ্যায়েই এসেছে ‘বিয়ে’ নিয়ে নানান মত ও ধর্মীয় মতবাদ। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। হিন্দুরা বিবাহকে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে মনে করেন।

হিন্দু বিয়ে হচ্ছে স্বামীর অধীনে নারীর কঠোর দাসিত্ব। স্বামীর প্রভুত্ব নিশ্চিত করার জন্য ঋষিরা শ্লোকের পর শ্লোক লিখে স্বামীকে উত্তীর্ণ করেছেন ঈশ্বরের পর্যায়ে।

হিন্দু শাস্ত্র মতে আট রকমের বিয়ের কথা বলা হয়েছে, এবং প্রায় প্রতিটিতেই ‘পতি’কেই মহিমান্বিত করা হয়েছে।

জেনে বিস্মিত হয়েছি, ‘বিবাহ’ স্বামীকে স্ত্রীর দেহের ওপর সর্বতোভাবে এমন অধিকার দিয়েছে যে, স্বামী তার স্ত্রীর দেহকে সম্ভোগ সামগ্রীর মতো ইচ্ছামত ভোগ করবে; সে বিষয়ে স্ত্রীর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দাম থাকবে না।

এই বিষয়ে উপনিষদের যা আছে ‘স্ত্রী যদি স্বামীর কামনা পূরণ করতে অস্বীকার করে তাহলে প্রথমে তাকে মধুর বাক্যে বশীভূত করবার চেষ্টা করবে। সেটা নিস্ফল হলে তাকে ‘কিনে নেবে’ (আভরণ ইত্যাদি দেওয়ার লোভ দেখাবে বা দেবে), তাতেও যদি সে রাজি না হয় তা হলে লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে মেরে স্ববশে আনবে।

শাস্ত্রীয় অনুশাসন অনুযায়ী নারীর জন্মই হয় পুত্রপ্রজননের জন্য। কৌটিল্য বলেছিলেন ‘পুত্রপ্রজননের জন্যেই স্ত্রীলোকের সৃষ্টি, সুতরাং আট বছরের মধ্যে কোন সন্তান প্রসব না করলে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করবে।

এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক আরো অনেক মতবাদ আছে এই অধ্যায়টিতে, এখানেই এসেছে ‘বহুবিবাহ’ প্রসঙ্গ।

প্রাচীন বাংলায় একটিমাত্র স্ত্রী গ্রহণই ছিল সমাজের সাধারণ নিয়ম। তবে রাজরাজড়া, সামন্ত-মহাসামন্তদের মধ্যেও অভিজাত সমাজে অর্থাৎ সম্পন্ন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বহুবিবাহ অপ্রচলিত ছিল না।

ইসলাম ধমে বিয়ে একটি আইনগত সামাজিক এবং ধর্মীয় বিধান। ইসলামে বিয়ে বলতে দুপক্ষের একটি চুক্তি বোঝায়। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের জন্যে আবশ্যিক কর্তব্য।

ইসলামে বিয়ে বিষয়ক আরো অনেক তথ্য আছে এই অধ্যায়ে।

কুরআনে আরো উল্লেখ আছে ‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা যেতে পার।

একাধিক বিয়ে বিষয়ক যে নির্দেশনা কোরআনে আছে সেটিও এখানে লেখক তুলে ধরেছেন, যাঁদের জানা নেই বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে পড়ার পর ভাবাবে।

হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘সৎস্বভাবা স্ত্রীগ্ণ স্বামীর বাধ্যগত জীবন যাপন করিয়া থাকে। যদি তোমরা কোন স্ত্রীর অবাধ্যতার সম্মুখীন হও, তবে প্রথমে তাহাকে বুঝিয়ে, প্রবোধ দিয়া নছীহত করো এবং আরও অধিক কড়া কড়ির আবশ্যক হইলে তাহার প্রতি ভৎসনাস্বরূপ তাহার বিছানা ছাড়িয়া ভিন্ন বিছানায় থাক এবং আর আবশ্যক হইলে তাহাদিগকে মারিতে পার। ইহাতে যদি স্ত্রী বাধ্য হইয়া যায়, অতঃপর আর তাহাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার অজুহাত খোঁজ করিও না।

হাদিসে আরো আছে, ‘স্বামী তাহার স্ত্রীকে স্বীয় বিছানায় আসিবার জন্য ডাকিলে যদি স্ত্রী স্বামীর ডাকে সাড়া না দেয় এবং স্বামী তাহার প্রতি অসন্তুষ্ট হয় তবে ভোর পর্যন্ত সারারাত ফেরেশতাগণ ঐ স্ত্রীর প্রতি অভিশাপ করিতে থাকেন।

লেখক নিয়ে এসেছেন দাসীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কুরআনে যে নির্দেশ আছে এবং ভীষণ উল্লেখযোগ্য আরো একটি হাদিস ‘যদি আমি অন্য কাউকে সিজদা করতে আদেশ দিতাম, তাহলে নারীদেরই বলতাম তাদের স্বামীদের সিজদা করতে।

৪: ধর্মীয় গ্রন্থাদির অনুকরণে বাংলায় সাহিত্য ও বিভিন্ন নীতিশাস্ত্রে নারীপুরুষের দাম্পত্য সম্পকের ক্ষেত্রে নারীর একনিষ্ঠা ও পতিনির্ভরতার আবশ্যকতাই নানাভাবে প্রচারিত হয়েছে।

সাহিত্যের নানান ধারার যে লেখাগুলো এই অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে তা যেন আমাদের অন্য একটা চিন্তা জগতে নিয়ে বসিয়ে দেয়।

অষ্টাদশ শতকের কবি আবদুল্লাহর দোক্কাতুন নাছেহিন পুথি থেকে নারীপুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন – স্বামীর বস্ত্র ধৌত করা বহু পূন্য কর্ম। স্বামীর অনুমুতি ছাড়া অন্য বাড়ি বেড়াতে গেলে সকল প্রাণী তাকে অভিশাপ দিতে থাকে।

দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর অসন্তোষের কথা পুরনো বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি করে বলা হয়েছে। নারীদের পতি নিন্দা বিভিন্ন মঙ্গল কাব্যের একটা বিশিষ্ট অংশ। এতে সাধারণ নায়কের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন নারীকে নিজের স্বামীর দোষত্রুটি অসম্পূর্ণতা নিয়ে বিলাপ করতে শোনা যায়।

উনিশ শতকে স্বামী দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে উঠার অনুকুল পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল না। সামাজিক ও পারিবারিক মুল্যবোধে স্বামী স্ত্রীর দিবালোকে সাক্ষাৎ হওয়াও অতন্ত্য গর্হিত বিবেচিত হতো।

৫: এরপরই এসেছে ‘বাল্যবিবাহের কথা। প্রথম অধ্যায়ের এই চ্যাপ্টারটি পড়তে যেয়ে আমার বুকের মাঝে ভীষণ একটা চাপ কষ্ট অনুভব করেছি। অনেক অসহায় বিষণ্ণ কিশোরী মুখ যেন নিজের অজান্তেই মনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে গেছে।

প্রাচীন হিন্দু আইনপ্রণেতা মনু, নারীর বিয়ের বয়েস নিয়ে বলেছেন ১২ বছরের কন্যা এবং ৩০ বছরের পুরুষ, চব্বিশ বছরের পুরুষ আট বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে, নইলে ধর্ম নষ্ট হয়।

তবে জানা যায়, মোগল আমলে মুসলমান সমাজে অভিজাতদের মধ্যে বাল্যবিবাহ কম ছিল। হিন্দু নারীর তুলনায় মুসলিম নারীর অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে বিয়ে হতো।

তবে আদমশুমারী বা অন্যান্য সব তথ্য এবং নানান আত্বজীবনীতে যে বর্ণনা উঠে এসেছে এই বিষয়ে সবই বড় বেশি মর্মান্তিক কষ্টের।

শুধু বাল্যবিবাহই হতো না। তাঁদের অনেককেই খুব অল্পবয়সেই মৃত্যুবরণ করতে হতো। এত অল্পবয়সে দাম্পত্য সম্পর্কে প্রবেশে হয়তো শারীরিকভাবে প্রস্তুত ছিল না তার উপর এত অল্পবয়সে সংসারের কাজের বোঝা বহন করার ক্ষমতা বাল্যবধুদের ছিল না।

যে দুইটি উদ্ধৃতি পড়তে যেয়ে আমি বেশ কিছু সময়ের জন্যে অন্য এক বোবা কষ্টের ভুবনে চলে গিয়েছিলাম, কষ্ট চাপা দিয়ে সামনে এগিয়েছি তা উল্লেখ করি।

হৈমবতী সেনের আত্বজীবনী ‘’স্বামীর ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় অনুভব করি কেউ আমার কাপড় সরিয়ে নিচ্ছে, ভয়ে চিৎকার করি’। হৈমবতীর আত্বজীবনীতে উঠে এসেছে স্বামীর বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক আবিষ্কারের পর তার প্রতিক্রিয়ার কথাও।

১৮৭৫ সালে জুন মাসের ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকা বরাতে যে নিউজটি হৃদয় দুমরে মুচড়ে দেয় ‘স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হয়ে এগারো বছরের এক বাল্যবধূর মৃত্যুবরণ’’। এবং ১৮৯০ এ দশ বছরের ফুলমণি স্বামী হরিমোহন মাইতি (৩৫) দ্বারা ধর্ষিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

৬: লেখক অনেক গুরত্বপূর্ণ গবেষণা তথ্য নিয়ে এসেছেন বহুবিবাহ বিষয়ে, এনেছেন।

মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থই বহুবিবাহ অনুমোদন করে, যদিও চারজন স্ত্রীর বেশি স্ত্রী রাখা শরিয়তবিরুদ্ধ।

বহুবিবাহ অনেক নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করেছে, অনেক স্ত্রী দুঃসহ কষ্ট ভোগ করে মারা যায়। অনেকে একাধিক পত্নী থাকা সত্বেও অসংখ্য বাইজীদের নিয়ে আমোদ ফুর্তি করতেন।

৭: এরপর এসেছে যৌতুক প্রথা নিয়ে গবেষণা বিশ্লেষণ। যৌতুকপ্রথা বিয়ে ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত।

বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিবাহব্যবস্থায় যৌতুক প্রথা ভিন্নতর স্থানে ও আঙ্গিকে ক্রমবিবর্তিত হয়ে একই রুপ ধারণ করেছে।

উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে যৌতুকপ্রথার প্রচলন ছিল। মুসলমানদের দেনমোহর সেই সময় সামাজিক বিত্তের একটি নিদর্শনে পরিগণিত হয়।

৮: এসেছ সেই সময়ের হিন্দু ও মুসলিম বিয়ের নানান আচারিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের চমকপ্রদ সব তথ্য ও উদাহরণ। লেখক বিশেষ করে উনিশ শতকের পুরনো ঢাকার বিয়ের রীতির অনেক কিছু খুব সুন্দর করে উল্লেখ করেছেন, পড়তে যেয়ে যে কারো ভালো লাগবে।

ছোট একটা অংশ উল্লেখ করি, বিয়ের পরদিন বরের বাড়িতে নতুন বৌকে ডাক শেখানো হতো। স্বামীর আত্বীয়রা একসঙ্গে ঘরে বসে থাকত। তখন নূতন বৌ হাতে পান ও মিষ্টি নিয়ে একজন একজন করে সবার সামনে যেত। সঙ্গে থাকতো ননদ বা ননাস। সে একেকজনকে পরিচয় করিয়ে দিতঃ ‘ইনি আপনার খালাশাশুড়ি, উনাকে আমরা খালাম্মা ডাকি’। নূতন বৌ তখন হাতের পান ও মিষ্টি খালাশাশুড়ির হাতে দিয়ে বলত, ‘খালাম্মা নিন’।

৯: অষ্টাদশ শতাব্দীতে হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। উনিশ শতকের আলোচনার এই কেন্দ্রবিন্দুতে তা চলে আসে। তাই লেখক তুলে এনেছেন ‘সতীদাহ বা মৃত স্বামীর চিতায় বিধবা স্ত্রীর সহমরনের প্রথার মতন বর্বরতম প্রথা নিয়ে বিস্তারিত একটি অধ্যায়।

১৮২২ সালে ফ্যানি পার্কস একটি সহমরণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তিনি দেখেছিলেন যে প্রজ্জ্বলিত চিতা থেকে যখন বিধবাটি প্রাণের ভয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলো তখন তার আত্নীয়-স্বজন এবং অন্যান্য ব্যক্তিরা ‘কেটে ফেলো’, ‘মাথায় বাঁশ মারো’, ‘হাত-পা বাঁধো’, বলে চিৎকার করে করে বিধবার পিছনে ছুটছিল।

১০: তুলে এনেছেন, পর্দার নামে নারীকে অন্তঃপুরে নারীর অবরুদ্ধ করে রাখার কথা। নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা করার শালীনতা নিয়ন্ত্রণ করার একটু পীড়নমূলক পদ্ধতি হিসেবে সমাজে পর্দা চালু করা হয়েছে।

তবে জানা যায়, প্রাচীন বাংলায় পর্দাপ্রথা তেমন একটা প্রচলন ছিল না। অভিজাত ও বিত্তবান পরিবারের মহিলারা পর্দা মেনে চলতেন।

‘অবরোধ প্রথা’ নিয়ে লেখক প্রাসঙ্গিক অনেক মতবাদ এবং তথ্য তুলে এনেছেন।

উনিশ শতক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত বিশেষ করে মুসলিম নারীদের কি কঠোর পর্দা মেনে চলতে হতো তার বেশ কিছু চিত্র লেখক তুলে ধরেছেন এই অধ্যায়ে।

উনিশ শতকের শেষে হান্টার ঢাকার পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, নারীরা সাধারণত শাড়ি, ছেলেরা সাধারণত ধুতি, চাদর, গামছা, খড়ম প্রভৃতি ব্যবহার করতো।

১১: ধর্মীয় আধিপত্য যেভাবে নারী-পুরুষ সম্পর্কে প্রভাব রেখেছে তার আলোচনা আছে এই অধ্যায়ে। নানান ভাবেই উঠে এসেছে সাধ্বী স্ত্রীলোকের পরমধর্ম পতিপরায়ণতা। , কিন্তু ধর্মানুসারে স্বামীর পক্ষে পত্নীব্রত হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না কোনোদিন।

ধর্ম একদিকে বিবাহিতা স্ত্রীকে গৃহের মধ্যে কঠোরভাবে আবদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে, আবার অপরদিকে পুরুষের যত্রতত্র নারী সম্ভোগের দ্বারটি খোলা রেখেছে।

শ্রীপান্থের ‘হারেম’ গ্রন্থে থেকে লেখক উল্লেখ করছেন, ‘নবাবদের হারেমে থাকতো অগণিত দাসী। হারেমে মেয়েরা বিভিন্ন শিক্ষাগ্রহণ করতো নবাবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে, বাঁদিরাও কেউ কেউ পুরোপুরি অশিক্ষিত ছিল না।

১২: এসেছে বিবাহ বিচ্ছেদ বিষয়ক আলোচনা, তত্ত্বগতভাবে ইসলামি শরিয়ত আইনে নারীপুরুষের যে কেউই দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে স্বেচ্ছায় বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে। কোরআনে বিবাহবিচ্ছেদের কথা বহু জায়গায় উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কোরআনের অপব্যাখ্যা করে অনেক পুরুষ যুক্তিহীন সিদ্ধান্ত নিতে নারীকে প্ররোচিত করে.

উনিশ শতকে হান্টার নোয়াখালি জেলা সম্পর্কে লিখেছেন যে, সেখানে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বিরল, বিশেষ করে যেখানে সন্তান আছে. হয়ত বিবাহবিচ্ছেদে বা তালাক মুসলিম নারীর জন্য অসম্মানের ছিল.

১৩: পিতৃতান্ত্রিক পরিবার কাঠামোতে সম্পত্তির অধিকার পিতার। জ্যেষ্ঠপুত্রই সকল সম্পত্তির মালিক হওয়ার যোগ্য। তাই সম্পত্তির মালিকানা বা উত্তরাধিকারের জন্য পুত্র থাকা অনিবার্য।

পারিবারিক ধনসম্পত্তিতে নারীর কোনো বিধি-বিধানগত ব্যক্তিগত অধিকার বা সামাজিক অধিকার স্বীকৃত ছিলনা।

সম্পত্তিতে নারীর অধিকার বিষয়ে নানানা মতামত এখানে তুলে ধরেছেন লেখক।

দ্বিতীয় অধ্যায় : বিবাহপূর্ব প্রণয় সম্পর্ক

মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পতনের পর নারীর স্বাধীন প্রণয়, জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকার এবং যৌনস্বাধীনতা একরকম বিলুপ্ত হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যে বিবাহপ্রথা প্রবর্তিত হয়, তাতে নারীর যাবতীয় মনোদৈহিক বৃত্তির উপর আরোপিত হয় কঠোর বাধা নিষেধ।

এই প্রসঙ্গে অনেক লেখক শাস্ত্রকার দের মতামতই এসেছে এই অধ্যায়ে, তবে হুমায়ুন আজাদের যে কথা এনেছেন লেখক, সংক্ষিপ্ত আকারে বলি, পুরুষতন্ত্র প্রেমের জয়গান গায়, তবে প্রেমে বিশ্বাস করে না; আর কামের নিন্দা করে, তবে বিশ্বাস করে কামে। পুরুষতন্ত্রের প্রধান বিশ্বাসগুলোর অন্যতমটি সম্ভবত কাম; তার বিধানগুলোতে কামকে যেটুকু নিন্দা করা হয়েছে, তা পুরুষের অংশগ্রহণের জন্যে নয়, নারীর অংশ গ্রহণের জন্যে।

১: বাঙালি রোমান্টিক কাব্যে নরনারীর বিবাহ যে প্রণয়কথা বলা হয়েছে তাতে প্রায়শ স্বপ্নে বা চিত্রে নায়িকার রূপ দেখে অথবা লোকমুখে রূপের বর্ণনা শুনে নায়কের হৃদয়ে প্রণয়ের উন্মেষ হয়, অবশ্য কখনো কখনো আকস্মিক সাক্ষাৎ থেকেও প্রেমের সূচনা হয়।

উনিশ শতকের বটতলায় ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর আর দাশরথী রায়ের পাঁচালি বহুল সমাদৃত ছিল। ধর্ম ও পারিপার্শ্বিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিবাহপূর্ব শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি এঁরা তুলে এনেছেন সযতনে।

২: লেখক সেই সময়ের নানান সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে এই বিষয়ে একটা ধারণা তুলে দিয়েছেন। নাটকে বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর প্রেম এবং পছন্দ করার অধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে সেটিও নিয়ে বলেছেন। বিশেষ করে নিয়ে এসেছেন ব ঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যের নারী চরিত্রের যে রূপ উঠে এসেছে বলা হচ্ছে তাঁর উপন্যাসই প্রেমের মহিমাব্যাখানে বাঙালি পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

তবে এও সত্য যে, তৎকালীন সমাজে রোমান্টিক প্রণয় বা বিবাহপূর্ব ভালোবাসা কম ছিল, অবশ্যই মূল কারণ বাল্যবিবাহ।

রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে নারীপুরুষ সম্পর্ককে ধর্ম ও বিবাহের গন্ডির মধ্যে দেখা হতো।

কাছাকাছি সময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর অন্যরকম শক্তিশালীরূপও উঠে এসেছে। এসব সাহিত্য প্রথাগত নারীর ধারণা পাল্টে দেয়। এখানে আমরা নারীকে দুর্বার ও ভয়ংকররূপে দেখতে পাই, যা একই সঙ্গে করুণা ও ভীতির সঞ্চার করে।

বাল্যপ্রণয়ের বিষয়টিও সাহিত্যে বাদ যায়নি। লেখক এই বিষয়টি নিয়ে এসেছেন ভীষণ মনকারা সব লেখা তুলে এনে. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র সাহিত্যের উল্লেখগুলো আমাদের নুতন করে মনকে আচ্ছন্ন করে এই লেখকের রোমান্টিক প্রেম বিষয়ক নারী-পুরুষ সম্পর্কের হৃদয়বৃত্তিক অনুভব জেনে। শেষের কবিতা এবং শ্রীকান্ত রচনা এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য।

লেখক বলছেন, বাঙালির জীবনে রোমান্টিক প্রেমের চিন্তা ইউরোপীয় চিন্তাধারা থেকে এসেছে। তবে উনিশ শতকে এই চিন্তা বহমান নদীর রূপ পায়, বিবাহিত জীবনে ‘রোমান্টিক’ প্রেম নিয়ে আসে স্বপ্নিল বার্তা।

৩: বিবাহপূর্ব প্রেম পুরোনো বাংলা সাহিত্যে যেভাবে চিত্রিত হয়েছে, আধুনিক সাহিত্যে সেভাবে হয়নি। লেখক বলছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্বে ইউরোপীয় ও হিন্দু এই দুই ধারার সমন্বয়ে নরনারীর সম্পর্কের যে নুতন ধারণা তার প্রকাশ সমস্ত বাংলা সাহিত্য জুড়িয়া আছে এবং সেই ধারণা প্রভাবিত করে ব্যক্তিগত জীবনকে।

ধূর্জটিপ্রসাদের মতে, ‘উনিশ শতকের বাংলায় প্রেম নামক পদ্ধতিটি আবিষ্কার করলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়। এরপর এলেন রবিবাবু। তিনিই আমাদের সকলকে প্রেমে পড়তে শিখিয়েছেন। তাঁরই ভাষা দিয়ে আমরা প্রেম করি। তাঁরই ভাব দিয়ে আমরা প্রেমে পড়ি।

উনিশ শতকের প্রেম, বিবাহ, বিবাহোত্তর প্রেম বা বিবাহবহির্ভূত প্রণয় সম্পর্কের পাশাপাশি বিধবা বিবাহের পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর লেখালিখি শুরু হয়।

লেখক এটিও উল্লেখ করেছেন যে দেশে স্ত্রী -পুরুষের মেলামেশার ধারাটা বহু শতক ধরে একেবারেই নেই সেখানে তা সহজে বা দ্রুত প্রণয় সম্পর্ক গড়ে উঠবে না তা বলাইবাহুল্য।

উনিশ শতকে ব্রাহ্ম সমাজই বাঙালি নারী সম্বন্ধে নুতন শ্রদ্ধা জাগ্ৰত করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র প্রাচীন ও প্রথাগত বাঙালি সমাজে স্ত্রীজাতি সম্পর্কে যে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা ছিল তার কঠিন সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি।

৪: লেখক আলোচনা টেনেছেন এখানে পাশ্চাত্যের ইংরেজী শিক্ষা ও সাহিত্য শিক্ষিত তরুণ সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল তা নিয়ে।

উনিশ শতকের শুরুতে ইংরেজীশিক্ষিত যুবকরা কোনোভাবেই মানতে চায়নি সমাজের সেকেলে ধরাবাধাঁ নিয়ম-কানুন। সমাজ সংস্কার ও স্ত্রীশিক্ষাসহ অনেক কাজে যোগ দিয়েছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। রোমান্টিক প্রেমকে গুরুত্ব দিয়েছেন নিজের জীবনে। গভীর প্রণয়ের পর বিয়ে করেছিলেন রূপসী বিধবা বসন্তকুমারী কে।

শুধু তিনিই নয়, আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিই ব্যক্তিজীবনে রোমান্টিক প্রেমকে গুরত্ব দিয়েছেন, খুঁজেছেন জীবনের স্বার্থকতা। এখানে লেখক রবীন্দ্রনাথ সহ বিখ্যাত অনেকের জীবনের এইসব অভিজ্ঞতারই টুকরো চিত্র তুলে ধরেছেন।

উনিশ শতকের শেষ দিকে হিন্দুসমাজে রক্তের সম্পর্কীয় কারো সঙ্গে বিবাহ তো দূরের কথা, প্রণয় সম্পর্কও গড়ে উঠা নিষিদ্ধ ছিল। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ অতুল প্রসাদ মামাতো বোনকে বিয়ে করার জন্য দেশ ত্যাগ করেছিলেন।

সেই সময় অন্য অঞ্চল ও অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনে বাঙালিদের মধ্যে প্রবল বাধা ছিল। বাঙালি নারীদের মধ্যে সবার আগে যিনি এক বিদেশীকে বিয়ে করেন, তিনি সম্ভবত হরিপ্রভা তাকেদা।

অভিজাত মুসলিম পরিবারে পর্দাপ্রথার কঠোরতার জন্য নিকট আত্মীয় ছাড়া মুসলিম নারীর পক্ষে কথা বলা বা মেলামেশা করার সুযোগ ছিল না। তাই নারীপুরুষের বিবাহপূর্ব প্রেম সহজে হতে পারতো না। তবে আত্মীয়ের মধ্যে প্রেম করেই হোক বা অন্য ভাবেই হোক বিয়ে খুব বেশি হতো।

মুসলমান সমাজে কঠোর পর্দাপ্রথা বিরাজমান থাকায় বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর পরিচয়ের সুযোগ কম ছিল. বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনীতে কাজী সাহেবের তিন মেয়ের একই দিনে বিয়েতে কন্যা উল্টা-পাল্টা হয়েছিল।

লেখকের তুলে আনা প্রতিটি মতামতই আমাদের মনোজগতে ছাপ রেখে যায়, তবে এই অধ্যায়ের যে তথ্যটি না বললেই নয় উনিশ শতকে ভূদেব মুখোপাধ্যায় বা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে হিন্দু পুরুষের সঙ্গে মুসলিম নারীর প্রণয়ের চিত্র মুসলমানদের ক্ষুব্ধ করেছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ‘মুসলমান লেখকরা একবারে ঐতিহাসিক ঘটনার আশ্রয়ে এমন উপন্যাস রচনা করেতে প্রবৃত্ত হলেন, যেখানে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব থাকবে, মুসলমানদের বীরত্ব প্রকাশ পাবে এবং হিন্দু নারী মুসলমান যুবকের প্রণয়ে নিমজ্জিত হয়ে ধর্মান্তর গ্রহণ করবে।

তৃতীয় অধ্যায় : পরিবারের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক

উনিশ শতকের পরিবারে দাম্পত্যজীবনে পুরুষের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব লক্ষ করা যায়. পিতৃতন্ত্র দাম্পত্যজীৰনের জন্য কতগুলো বিধিনিষেধ নির্ধারণ করে দেয় – স্বামী হচ্ছে ইহজগতের প্রভু ও দেবতা, তাঁর প্রতি স্ত্রীর প্রশ্নাতীত ভক্তি প্রদর্শন করতে হবে।

দাম্পত্য সম্পর্কের চমৎকার চিত্র ফুটে ওঠেছে ধীরেন্দ্রনাথ পালের স্ত্রীর সহিত কথোপকথন গ্রন্থে। স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্যে চার ধরণের সম্পর্কের কথা বলেছেন তিনি। তাঁর মতে, স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সম্পর্ক হলো অংশী (Partner) সম্পর্ক, দ্বিতীয়ত স্ত্রী (Wife) সম্পর্ক, তৃতীয়ত সখা (Confidant) সম্পর্ক এবং চতুর্থত আধ্যাত্নিক (Spiritual) সম্পর্ক।

উনিশ শতকে দাম্পত্য সম্পর্কের প্রথাগত ধারণা ছিল সংসারের সর্বময় কর্তা পুরুষ আর নারী বিনে পয়সার দাসী। এই বিষয়ে রামমোহন রায় এর লেখা থেকে লেখক যা উল্লেখ করেছেন তা বড় বেশি বুঁকে বাঁধে।

ঘুরেফিরে সেই নারীকেই নানান পরামর্শ, পতিব্রতা হওয়ার, লক্ষী হওয়ার এবং উপযুক্ত সঙ্গী হতে হলে যা যা জানা উচিত।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মধ্যেবিত্ত পরিবারে দাম্পত্য সম্পর্কের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামী ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। পাশাপাশি স্ত্রীরা ছিলেন অশিক্ষিত, কখনও কখনও অল্পশিক্ষিত।

বিশ শতকের শুরুতে নারীপুরুষের দৈনন্দিন কাজের চিত্র অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে বেগম রোকেয়ার ‘অর্দ্ধাঙ্গীতে। ‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়ার্ড়ের দৈর্ঘ প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন। স্বামী যখন কল্পনা-সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমন্ডলের ঘনফল তুলাদণ্ডের ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল দল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন। বলি জ্যোতির্ব্বেত্তা মহাশয় আপনার পার্শ্বে আপনার সহধর্মিণী কই? বোধ হয়, গৃহিনী যদি আপনার সঙ্গে সূর্যমন্ডলে যান, তবে তথায় পঁহুছিবার পুর্ব্বেই পথিমধ্যে উত্তাপে বাষ্পীভূত হইয়া যাইবেন। তবে সেখানে গৃহিনীর না যাওয়াই ভাল।

১: উনিশ শতকে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক মোটেও ঘনিষ্ঠ ছিল না, ছিল পর্দাপ্রথা, মধ্যরাত পর্যন্ত গৃহকর্ম এবং শ্বাশুড়ি-ননদ কতৃক নিগৃহীতা হওয়ার বিষয়।

লেখক উল্লেখ করেছেন এমন একটি আত্নজীবনী রচয়িতা রাসসুন্দরী দেবীর এমনই সব অভিজ্ঞতা। স্বামী সম্পর্কে তিনি এতোই লাজুক ছিলেন যে একদিন হঠাৎ স্বামীর ঘোড়া বাড়ির পেছনের আঙ্গিনায় চলে এলে তিনি তাড়াতাড়ি নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন – কি করি কর্ত্তার ঘোড়া পাছে আমাকে দেখে, এই ভাবিয়া ঐখানেই থাকিলাম। ইতিমধ্যে আমার বড় ছেলেটি আসিয়া বলিল, মা, ও ঘোড়া কিছু বলিবে না, ও আমাদের জয়হরি ঘোড়া , ভয় নাই। তখন আমি মনে মনে হাসিতে লাগিলাম, ছি ছি আমি কি মানুষ। আমি তো ঘোড়া দেখিয়া ভয় করি না; আমি যে লজ্জা করিয়া পলাইয়া থাকি। এতো মানুষ নহে, তবে, ঘোড়া ও আমাকে দেখলে ক্ষতি কি !

উনিশ শতকের প্রথম দিকে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অভিজাত পরিবারে নারীর অবস্থান মোটামুটি একই ধরণের ছিল।

শ্বাশুড়ির নিকট বধূর ষোলো আনা আনুগত্য এমন বহুলভাবে স্বীকৃত নিয়ম ছিল যে বিয়ে করতে যাবার সময় বর সাধারণত মাকে বলতো, ‘তোমার জন্যে দাসী আনতে যাচ্ছি’।

২: উনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু মধ্যেবিত্ত সমাজে একান্নবর্তী পরিবার প্রথার বিকাশ ও জনপ্রিয়তা ঘটে। আর যৌথ পরিবারে দাম্পত্যসম্পর্কে নারীর অবমূল্যায়নের বর্ণনা পাওয়া যায় নানান রচনাবলীতে।

সেই সময়ের বিভিন্ন আত্নজীবনী, কথা সাহিত্য, প্রবন্ধ পর্যালোচনা করে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, তখন পরিবারের প্রচলিত আচার-ব্যবহার অনুযায়ী স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর দেখা হওয়ার সুযোগ কম ছিল। এই বিষয়ে শ্বাশুড়ির ভূমিকা খুবই মর্মান্তিক। শ্বশুর বাড়িতে বধূর অবস্থা ভীষণই করুণ ছিল।

ওই সময়ে বিয়ের পর নারীদের বাবার বাড়ি যাতায়াত খুব সহজ ছিল না। এক্ষেত্রে শ্বাশুড়ির আদেশই মূলত মুখ্য ছিল। শাশুড়ির নির্দেশ না মানলে শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের ওপর আরো অত্যাচার বাড়তে পারে – এই ভয়ে মেয়ের বাবা-মাও চুপ করে থাকতেন।

পুত্রবধূর সঙ্গে অনেক শাশুড়িই কথা বলতেন না, এটাও বোধ হয় উনিশ শতকের অন্দরমহলের অন্যতম বৈশিষ্ট।

৩: উনিশ শতকের শুরুতে সমাজে বহু বিবাহ ও বাল্যবিবাহ দুটিই সমধিক প্রচলিত ছিল। রাজা রামমোহনকে আধুনিক ভারতের জনক বলা হয়, তাঁর জীবনেও বাল্যবিবাহ এবং বহু বিবাহের বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।

বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অসম শিক্ষা ছাড়াও স্ত্রীর প্রতি স্বামীর চরম অবহেলা দাম্পত্যজীবনে ফাটল ধরিয়েছে। লেখক নিয়ে এসেছেন অনেক বাস্তব উদাহরণ, বিশেষ করে অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকের জীবন ছাড়াও বেশ কিছু আত্নজীবনীতে ফুটে উঠেছে নারীদের নিদারুণ কষ্টের চিত্রই।

বাল্যবয়েসে বিয়ের পর দাম্পত্যজীবন অভিজ্ঞতায় আমোদীনি দাসগুপ্ত জীবনকাহিনীতে বলছেন, ‘এক হাজার টাকা পণ লইয়া আমার মা এগারো বৎসরের মেয়েকে তেতাল্লিশ বৎসরের চতুর্থ পক্ষের বরের নিকট আমাকে বিক্রি করেন। এই সময় হইতেই তাঁহার শখ যে আমি তাঁহার উপযুক্ত স্ত্রীর ন্যায় বাক্যালাপ করি। কিন্তু সত্য কথা বলিতে কি তাঁহাকে দেখিলেই আমার মনে কেমন ভীতির সঞ্চার হইত। বিছানায় শুইতে গেলে চক্ষু মুদিয়া থাকিতাম। তাহাতে স্বামী বড়ই অসন্তুষ্ট হইতেন।

৪: মুসলমান সমাজে বহুবিবাহ বিশ শতকেও বহুলভাবে প্রচলিত ছিল। আধুনিক দাম্পত্যজীবন বলতে যা বোঝায় সপত্নীর কারণে মুসলমান তেমন পরিবারে সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারতো না।

জমিদারি পরিচালনা করে নবাব উপাধি পেলেও ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর দাম্পত্য জীবন তাঁর স্বপত্নীর কারণে সুখের ছিল না, সম্ভবত সেই অতৃপ্তি,
দুঃখবোধ থেকে তিনি রূপজালাল রচনা করেছিলেন।

বেগম রোকেয়ার পিতারও ছিল চার স্ত্রী। এমনকি বেগম রোকেয়ার দাম্পত্য জীবনেও ছিল নানান ছন্দোপতন। এমনকি তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর তাঁরই স্বপত্নী-কন্যা ও তার স্বামীর পীড়নে ভাগলপুর ছাড়তে বাধ্য হন তাঁর হাতে গড়া বালিকা বিদ্যালয়টি ছেড়ে।

৫: দাম্পত্য জীবন কেন অসুখী হয়, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক তুলে এনেছেন অক্ষয়কুমার দত্তের কথা ‘পরস্পর বিরুদ্ধ-স্বভাব, অসম-বুদ্ধি ও বিপরীত-মতাবলম্বী স্ত্রী-পুরুষের পাণিগ্রহণ হইলে, উভয়কেই যাবজ্জীবন বিষম যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়।

একটি পত্রিকায় সেই সময় লেখা পাওয়া যায় এমন, ‘স্বামী পীড়াগ্রস্থ হইলে স্ত্রী প্রাণ মন শক্তিতে তাঁহার সেবা করেন, যদি সেবার কিছু ত্রূটি হয়, স্বামীর আর ক্রোধের সীমা থাকে না; স্ত্রীর পীড়া হইলে স্বামী তাঁহার সেবা করা দূরে থাকুক পীড়ার অবস্থাও ভালো করে জিজ্ঞেস করেন না।

৬: উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নব্যশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কের বিষয়ে নতুন চিন্তার জন্ম দেয়। বিবাহিত জীবনের বিশেষ অংশ হিসেবে স্ত্রীর ভূমিকাকে কেউ কেউ গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে শুরু করেন। উঠে আসে নারীদের শিক্ষিত হওয়ার গুরুত্বের বিষয়টি। অশিক্ষিত স্ত্রীরাও শিক্ষিত স্বামীদের নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতেন। যথার্থ শিক্ষার অভাবে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে আদর্শ দাম্পত্যসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারতো না।

৭: সে সময় গৃহের সকল কাজের দায়িত্ব ছিল নারীর ওপর ন্যস্ত। নারীর সারাদিনই ব্যয় হতো সংসারের কাজে। মধ্যবিত্ত পরিবারে দাস-দাসী, পাচক-পাচিকা রাখার রেওয়াজ থাকলেও ঘরকন্নার কাজ, পরিবারের সদস্যের সেবা করা, এমন কি রান্নার কাজও গৃহিনীকেই সামলাতে হতো।

রাসবিহারী দেবী তাঁর আত্নজীবনীতে উল্লেখ করছেন, ‘বিশেষত তখন মেয়েছেলের এই প্রকার নিয়ম ছিল, যে বৌ হইবে, সে হাত খানেক ঘোমটা দিয়া ঘরের মধ্যে কাজ করিবে, আর কাহারও সঙ্গে কথা কহিবে না, তাহা হইলেই বড় ভালো বৌ হইলো। সে কালে এখনকার মতন চিকন কাপড় ছিল না, মোটা মোটা কাপড় ছিল। আমি সেই কাপড় পড়িয়া বুক পর্যন্ত ঘোমটা দিয়া ঐ সকল কাজ করিতাম।

দিনের বেলা স্বামীর সাথে কথা বলতে দিখিলে সেইরকম পুত্রবধূকে শাশুড়ি বলতেন, ‘ও মা। কি বেহায়া মেয়ে তো আমি বেম্মাণ্ডে দেখিনি। ও কিনা স্বচ্ছন্দে বসে ভাতারের সঙ্গে গল্প করচছে?

যৌথ পরিবার উনিশ শতকে শ্বশুর – শ্বাশুড়ির দাম্পত্যসম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতো। যৌধ পরিবারে স্ত্রীর প্রতি সম্মান দেখানো হতনা, বা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসা বা সমর্থন ভালো চোখে দেখা হতো না।

যৌথ পরিবারে থেকেও কেউ কেউ ব্যতিক্রম ছিলেন, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন, কেউ কেউ স্ত্রীর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে সুন্দর ও অনুরকরণীয় দাম্পত্য সম্পর্ক তৈরীর চেষ্টা করেছিলেন।

স্বামীর ভালোবাসা ও সহানুভূতিৰ উপরই নির্ভর করে পরিবারের নারীর মর্যাদা। এর সঙ্গে অবশ্য স্বামীর উপার্জনের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। স্বামী উপার্জনক্ষম না হলে বধূর অবস্থা আরো বেশি অসহায় ছিল. সন্তান হলে, বিশেষ করে পুত্রসন্তান, বধূর মর্যাদা কিছুটা বাড়ত।

৮: উনিশ শতকের মধ্যভাগ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বাধীন সম্পর্কের অভাব সাময়িক পত্রে লেখার অন্যতম বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। দাম্পত্য সম্পর্কে প্রকৃত পরিবর্তন যেভাবেই হোক না কেন সে সম্পর্কের তদানীন্তন রুপ নিয়ে যে চিন্তা করা হচ্ছে, বাঙালি-জীবনের চিরাচরিত দাম্পত্য সম্পর্কের ঐতিহ্যে এ এক অভিনব ঘটনা। এমনটি বলছেন লেখক এই অধ্যায়ে। উঠে এসেছে নানান সাহিত্য রচনার উদ্ধৃতি, যা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যে সহজ ও স্বাভাবিক ছিলনা তাই জানা যায়।

৯: এই অধ্যায়ে লেখক তুলে ধরেছেন উনিশ শতকের শুরুতে দাম্পত্য সম্পর্কের বেশ কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শুরুতেই আছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের কথা, ৬ বছরের দিগম্বরী দেবী, ১৭ বছরের দ্বারকানাথের ধর্মপত্নী হয়ে ঠাকুর বাড়িতে এসে পা দিলে যেন বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হতে শুরু করে। অতুলনীয় রুপের সঙ্গে তাঁর ছিল প্রচণ্ড তেজ, শাশুড়ি অলকাসুন্দরীও এই ব্যক্তিত্বময়ী বউটিকে সমীহ করে চলতেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা এবং তাঁর নিজ জীবনের অনেক বিষয় লেখক এই অধ্যায় তুলে ধরেছেন, যার প্রতিটিই দাম্পত্য সম্পর্কের নানান ধারণা দিয়ে যায় তবে মন ভালো করা কিছু বিষয়ই জানতে পারি এই অধ্যায় পড়ে।

ঠাকুর পরিবারের ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন স্ত্রী-স্বাধীনতায় পক্ষপাতি, তাঁর স্ত্রীর প্রতি যে প্রেম এবং চিঠির মাধ্যমে যে প্রকাশ লেখক উঠিয়ে এনেছেন তা পড়ে ভালোলাগায় মুগ্ধতায় বুঁদ হয়েছি।

উঠে এসেছে সেই সময়ের আরো কিছু সুখময় দাম্পত্য সম্পর্কের কথা।

লেখক এই অধ্যায়টি আরো যে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন, স্বামীর ভালোবাসার পাত্রী হওয়া সে যুগের নারীর একমাত্র সাধনা ছিল। কিন্তু দাম্পত্যজীবনে এসব সাধনার বহিঃপ্রকাশ খুব কম ছিল।

১০: লেখক আলোচনা নিয়ে এসেছেন ‘স্ত্রী ও স্বামীর পরস্পর সম্বন্ধ’ উন্নয়নের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয়ে।

রবীন্দ্রনাথ দাম্পত্যজীবনে স্ত্রীর অবদানকে স্বীকার করেছেন। মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্কের কথা ছাড়াও মেয়ে মাধুরীলতার সুখী জীবনের সুখ কথা উঠে এসেছে।

জ্ঞানদানন্দিনীর জীবনচরিত লিখতে গিয়ে তাঁর মেয়ে ইন্দিরা দেবী লিখেছে, যা লেখা হবে তাতে আছে ধাপে ধাপে একটি সাধারণ পল্লীবালিকার স্মরণীয়া রমণীতে উত্তরণের ঐতিহাসিক সংকেত। আচে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রেম ও প্রীতির অন্তরঙ্গ নিদর্শন।

চতুর্থ অধ্যায়ঃ বিবাহ বহির্ভূত নারীপুরুষ সম্পর্ক

লেখক শুরুতেই বলছেন সেই সময়ের সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ছিল গর্হিত। এ সত্বেও বাস্তবে তা দেখা যায় উনিশ শতকে, তারই বিষদ আলোচনা আছে এই অধ্যায়ে।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইংরেজ শাসক ও ব্যবসায়ীগ্ণ অধিকাংশ পরিবার ছাড়া এদেশে বসবাস করতেন। সামাজিক নৈতিকতা কাঠামো ভেঙে পড়ার এটি একটি প্রধান কারণ। ঔপনেবশিক শাসকদের গৃহে দেশি নারী, বেশীর ভাগই বিধবা, নানা কারণে সমাজ থেকে উৎখাত হওয়া নারী বা ক্রীতদাসী তাদের থাকা ছিল অতি সাধারণ বৈশিষ্ট।

কলকাতায় বসবাসকারী দেশি বাবুদের বাড়িতেও একই চিত্র। উনিশ শতকে প্রতিটি বাজার ও জমিদার কাচারিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে দেহব্যবসা, বেশ্যালয়।

সেই সময়ের সংবাদ সাময়িকপত্র, নাটক, উপন্যাস, প্রহসন, আত্নজীবনী এবং সরকারি নথিপত্রে একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের সম্পর্কের খবর যেমন – উপপত্নী বা রক্ষিতা, দাসী-বাঁদী কিংবা বারাঙ্গনা প্রসঙ্গ। লেখক তা উঠিয়ে এনেছেন এই অধ্যায়ে।

১: লেখক জানাচ্ছেন, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাড়িতেই স্ত্রী ও বাগানবাড়িতে উপপত্নী রাখার চর্চা চলছিল। এবং সেকালের কলকাতার নতুন ধনী ‘বাবু’দের পরিবারে স্ত্রীর ভাগ্যে স্বামীর দাসত্বটুকুও জুটতো না। এসব বাবুদের অনেকেই সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব হিসেবে বিয়ে করতেন এবং হয়তো স্ত্রীকে দু’একটি সন্তানও উপহার দিতেন। কিন্ত এরা অনেকেই স্ত্রীর সঙ্গে কার্যত কোনো সম্পর্ক রাখতেন না।

২: উনিশ শতকে বাংলায় পতিতাবৃত্তি সমাজের প্রান্তসীমা পার হয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিল। ব্রিটিশরাজ বিভিন্ন আইনের দ্বারা পতিতাবৃত্তি নিবারণের জন্য পতিতাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। লেখক সেই সময়ের প্রশ্নমালাটিও এখানে তুলে ধরেছেন।

জানা যায় সেই সময় সিলেট অঞ্চলে রক্ষিতা বউদের বলা হতো ‘খাদিমা বউ’। খেদমত করার জন্য রাখা হতো এই ‘খাদিমা’ কে, আসল বউ কোনো কাজ করবে না। খাদিম তার সেবা যত্ন করবে। যদি খাদিমার ঘরে কোনো সন্তান হয় তবে সে সন্তান অবশ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তি পেতো।

উনিশ শতকের বাংলায় সামাজিক চিত্রে কুলীনপ্রথা একটি বিশেষ স্থান দখল করেছিল এবং একাদশ শতকের রাজা প্রসন্ন সেনের আমলে বাংলাদেশে এই প্রথার প্রচলন হলেও উনিশ শতকে এসে ভয়াবহ রুপ নেয়।

এই প্রথার কারণে অনেক কন্যাকে আজীবন কুমারী থাকতে হতো অথবা সধবা হয়েও বাপের বাড়িতেই থাকতে হতো। অনেক সময় কারো কারো কাছে এই জীবন দুঃসহ হয়ে উঠতো এবং পুরুষের প্ররোচনায় অনেক মেয়েই সমাজের বাইরে পা রাখতে বাধ্য হতো। তখন তাদের কাছে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা খোলা থাকতো না।

বিবাহ কুলীনদের ব্যবসায় পরিণত হয়। উইলিয়াম হান্টারের লেখা থেকে জানা যায়, ১৮১৭ সালে বিক্রমপুর অঞ্চলের জীবিত এক কুলীন যার স্ত্রীর সংখ্যা শতাধিক। অপর পক্ষে তাঁর তিন পুত্র তখন পর্যন্ত যথাক্রমে মাত্র পঞ্চাশ, পঁয়ত্রিশ ও ত্রিশটি করে বিয়ে করতে পেরেছিলেন।

৩: লেখক এই অধ্যায়ে বলেছেন হিন্দু, বিধবাদের কঠিন ব্রাহ্মচর্য বাল্যবিধবাদের জীবনে এক দুঃসহ অভিশাপ।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বাঙালি সমাজে মেয়েদের অবস্থার আরো অবনতি হয়েছিল। একদিকে বহুবিবাহ, যার পরিণতিতে তৈরি হয় হিন্দু বিধবা সমাজ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপে পড়ে অনেকে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতো, কেউবা আত্নঘাতি আবার কারো কারো স্থান হতো কাশী অথবা বৃন্দাবনে, যেখানে পাঠিয়ে আত্নীয়স্বজন তাদের ভুলতে দেরী করতো না। যার পরিনতিতে দেবদাসী বা বেশ্যাবৃত্তি করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো।

পুরো অধ্যায়টিতে বিধবাদের অমানবিক কষ্টের টুকরো চিত্র উঠে এসেছে।

লেখক আরো জানাচ্চেন, সেসময় রক্ষিতা কেবল যৌনবৈচিত্র্য বাড়ানোর পাত্রীই ছিলেন না, রক্ষক তার মধ্যে প্রেমের স্বাদ পেতেও চেষ্টা করতেন। বিবাহিত জীবনে যা পাওয়া যায়নি, সেই দুর্লভ বস্তু পাওয়ার হা-পিত্যোশ চলত পরকীয়া এবং রক্ষিতা রাখার মধ্য দিয়ে।

ঘরে স্ত্রী থাকা স্বত্বেও পরনারী নিয়ে ফুর্তি করা বা রাত কাটানো স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া হতো।

লেখক সেই সময়ের নাট্যজগতের বিখ্যাত অভিনেত্রী বিনদিনী দাসীর জীবন কাহিনী তুলে ধরেছেন এই অধ্যায়েই।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এবং ব্রাহ্ম আন্দোলনের ফলে এক নূতন পবিত্রতা ঔচিত্যবোধের দ্বারা উদ্বধিত হয়েছিলেন।

পঞ্চম অধ্যায়ঃ পরিবর্তিত পারিবারিক মুল্যবোধ

উনিশ শতকের সূচনালগ্নে বাংলার নারীপুরুষের সম্পর্ক গর্ব করার মতো ছিল না। শিক্ষার আলোবঞ্চিত, বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্কশুন্য বাঙালি হিন্দুনারীর প্রায় সমস্ত মানবিক অধিকার থেকে ছিলেন বঞ্চিত।

নারীদের নিরুপায় অবস্থার প্রধান কারণ ছিল পরাধীনতা। ধন-সম্পদহীন নারীদের ছিল না সম্পত্তির অধিকার, ছিল না বাইরে বেরিয়ে উপার্জনের ছাড়পত্র।

মুসলমান নারীরা তুলনামূলক কিছু সুযোগ-সুবিধাভোগ করতো। তাদের সম্পত্তি অধিকার ছিল, হিন্দুবিধবাদের তুলনায় মুসলমান বিধবা-নারীদের অবস্থা ভাল ছিল; ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিধবাবিবাহের অনুমতি ছিল।

এরপরও সমাজে মধ্যবিত্ত নারীরা ছিলেন অন্তঃপুরে পর্দার আড়ালে অবগুণ্ঠনবর্তী। বহির্বিশ্ব ও অন্দরমহলের মধ্যকার দৃশ্য অথবা অদৃশ্য পাঁচিল ছিল দুর্লঙ্ঘ্য ।

লেখক বিলকিস রহমান তাঁর ‘উনিশ শতকে বাংলায় নারীপুরুষ সম্পর্ক’ বইটির শেষ অধ্যায় সুচনায় এমনটিই বলছেন।

উনিশ শতকের শেষার্ধে নারীর ‘নূতন’ ভূমিকা এবং পরিবারে নারীর কর্তব্য নিয়ে উপদেশমালা লেখা হয়।

১: উনিশ শতকে বাংলার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পুরুষরা একদিকে নারীদের শিক্ষিতা, সংস্কৃতা, সহকর্মীনী পত্নী চেয়েছিলেন যারা পাশ্চাত্যের নারীদের মতো শৃঙ্খলা মেনে কাজ করবেন, সময়ের সদ্ব্যবহার করবেন, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শিশু পালন করবেন। সামাজিক প্রতিষ্ঠালাভে স্বামীকে সহায়তা করবেন, অন্যদিকে প্রাচীন আর্যনারীদের দৃষ্টান্ত অনুসারে পতিসেবা করবেন, শিশুমানস গঠন করবেন এবং আপন চরিত্রমহিমায় সমগ্র পরিবার ধর্ম আলোকিত করবেন।

২: লেখকের গবেষণায় উঠে এসেছে, সমাজ সংস্কারকদের প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠেছিল নারীকেন্দ্রিক বিভিন্ন আন্দোলন সেই সময়েই। এইসব আন্দোলনের মধ্যে সতীদাহ বিরোধী আন্দোলন, বিধবাবিবাহ আন্দোলন, কৌলিন্যপ্রথা বিরোধী আন্দোলন, বাল্যবিবাহ, সহবাস সম্মতি ও পণপ্রথা বিরোধী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য।

এবং শেষমেশ এসে এও জানা যায়, এত আন্দোলন, আইন প্রণয়ন, সমাজসংস্কার সবকিছুর পরেও বাল্যবিবাহ বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

তবে এটা সত্যি যে শতকের শুরুতে সেখানে ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বিয়ে হতো শতকের শেষদিকে এসে বিয়ের ক্ষেত্রে ২-৩ বছর বাড়ে অর্থাৎ শতকের শেষদিকে মেয়েদের বিয়ে হতো সাধারণ ১২-১৪ বছর বয়সে।

৩: এখানে লেখক পণপ্রথার কথা তুলে এনেছেন, শেষদিকে বলছেন ‘যে ছেলে যত পাস, তার বাজার দর তত বেশি’। বিশেষ করে হিন্দু শাস্ত্রে যথাসাধ্য বস্ত্র-অলংকারসহ কন্যাদানের বিধান আছে।

৪: উনিশ শতকের শুরুতে সমাজে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ যে পরিমাণ শেকড়ে বিস্তৃতি লাভ করেছিল শতাব্দীর মধ্যভাগে এসব সামাজিক আচারে পরিবর্তনের ব্যাপক হাওয়া লাগে।

লেখক বলেন প্রথম দিক থেকেই সচেতন কিছু ব্যক্তি নারীশিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেন। এঁদের মধ্যে হিন্দু সমাজপতি রাধাকান্ত দেব, রামমোহন এবং প্রসন্নকুমার ঠাকুরের মতো ব্যাক্তিত্ব ছিলেন।

তবে বিশেষভাবে বাঙালি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে এগিয়ে আসে খ্রিস্টান মিশনারিরা।

শতাব্দীর মধ্যভাগে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজপতিরা অন্তঃপুরে বসে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার মধ্যে কোনো দোষ খুঁজে পাননি। তবে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সম্পন্ন, এমনকি ‘দরিদ্র অথচ ভদ্রলোক’রাও পর্দাপ্রথা কঠোরভাবে মেনে চলতেন।

৫: এই অধ্যায়ে নারীদের নামের পাশে বাবা ব স্বামীর পদবী ব্যাবহারের নানান উদাহরণ উঠে এসেছে।

৬: এখানে লেখক তুলে ধরেছেন, নারীর অধঃস্তনতার যে অমানবিক চিত্র পরিবারে পুরুষদের চিন্তিত করে তুলেছিল, কিভাবে নিজের স্ত্রী-কন্যাকে নিরাপদে রাখা যায় তা নিয়ে যে পুরুষও উদ্বিগ্ন হয়েছিল সেই কথা।

এসেছে বিধবা হওয়ার পর রাতারাতি পুত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় বিধবাগণ কিভাবে হয়ে উঠতেন পুত্রবধুর অবজ্ঞার পাত্রি সেই চিত্র।

এসেছে উইল এ নারীর অবস্থান নিয়ে তথ্য।

৭ এবং ৮: এখানে লেখক তুলে এনেছেন অনেকগুলো কাবিননামা যার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে নারীদের অন্যরকম একটা অবস্থা।

৯, ১০, ১১ এবং ১২: লেখক বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতার এবং বাস্তব পদক্ষেপ হিসেবে উনিশ শতকের আর কিছু কাবিননামার উল্লেখ যোগ্য অংশ তুলে এনেছেন এখানেও।

কাবিননামায় এসব শর্তের বারবার ব্যবহার থেকে মনে হয় যে, ধর্মীয় বিধিবিধানের বাইরেও বাঙালি মুসলিম সমাজে দাম্পত্যসম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু বিধিবিধান গড়ে উঠেছিল এবং তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পালন করা হতো।

বইটির উপসংহারের একদম শুরুতেই লেখক বলেছেন, উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক বাংলায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নারী। নারীর অধঃস্তনতার চিত্রই সে সময়ে বিদেশি লেখকদের রচনায় খুব বেশি ফুটে উঠেছে।

খুব বোবা এক কষ্টে ভুগেছি যে বিষয়টি জেনে, তা নিয়েই এই বই-লেখকের একটি অংশ দিয়ে শেষ করি। উনিশ শতকের শুরুতে অল্পবয়সী বধূমৃত্যুর হার তুলনামুলকভাবে বেশি ছিল। অল্পবয়সী নারী দাম্পত্যজীবনে প্রবেশের জন্যে পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত ছিল না, স্বামীর শারীরিক চাহিদা মেটাতে যেয়ে মৃত্যুর ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এমন অনেক ঘটনাই অজানা আমাদের।

অল্পবয়েসে নারীকে সংসারের সমস্ত কাজের চাপ সামলাতে হয়েছে বালিকা সেই বধুদের। রান্নাঘরেই যে জীবন বন্দি ছিল তা উঠে এসেছে আত্নজীবনীতে।

নারী পর্যাপ্ত আহার পেত না, ক্ষুধা লাগলেও খেতে পেত না বা কাউকে বলতেও পারতো না। ঘরের বউ সবার শেষে উচ্ছিষ্ট থাকলে খেতো, খাবার না থাকলে না খেয়ে রাত পার করতে হতো। বালিকা বধুদের অধিকাংশই অপুষ্টিতে ভুগতো।

উনিশ শতকে নারীর সূচিতা রক্ষা পরিবারের ঐতিহ্য হয়ে দারিয়েছিল। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই, স্বামীর সঙ্গে সহবাস করুক না করুক, হিন্দু নারীকে কাকাডাকা ভোরে অন্যরা দেখার আগেই গঙ্গাস্নান করতে হতো।

বইটি লেখকের গবেষণালব্ধ, উনিশ শতকের নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ক যেসব চিত্র উঠে এসেছে তা বড় বেশী বেদনার। এই সময়ের বাংলার নারীদের একজন হিসেবে আজকের প্ৰেক্ষিত নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই নিজের অবস্থান নিয়েও বারবার ভেবেছি। ভাবনা এসেছে আজকের বাংলাদেশ এ নারীপুরুষ সম্পর্কের অবস্থা নিয়েও।

লেখককে সাধুবাদ দিতে হয় তাঁর সময় এবং নিষ্ঠার জন্যে, নিঃসন্দেহে এটি আগামী যে কোন সময়ের দলিল হয়ে থাকবে।

বইটি পড়ার জন্যে পাঠক হিসেবেও আমাকে দিতে হয়েছে বেশ নিষ্ঠা এবং মনোযোগ। বইটির বিশদ আলোচনার বেশির ভাগই আমাকে ভীষণ টেনেছে পাঠক হিসাবে অন্যদের মাঝে তুলে ধরবার। সেই তাগিদ থেকেই আমার এই চেষ্টা, যারা পড়বেন তাঁদেরকে অশেষ ধন্যবাদ দিতেই হবে লেখক এবং আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে।

নাদিরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া


Place your ads here!

Related Articles

মনের শান্তি

মনে শান্তি পাবার জন্য, মনকে ভাল রাখবার জন্য আমরা অনেকে অনেক কিছুই করি.. বাইরে ঘোরাঘুরি, মুভি দেখি, গান শুনি, বই

Book launch: Vulnerability and Adaptation to Climate Change in Bangladesh by Bangladesh Scientist Dr Younus

Bangladeshi-Australian Research Fellow of Adelaide University, Dr Younus’ book entitled ‘Vulnerability and Adaptation to Climate Change in Bangladesh’ has recently

Canberra Eid-ul-Adha Friday 31st July

Assalamu Alaikum. Eid day will be Friday, 31st July, Inshallah – Imam’s Council of the ACT.

2 comments

Write a comment
  1. Lipi
    Lipi 25 November, 2017, 03:38

    নদী, তোমার এই পর্যালোচনাটি আমার খুব ই ভালো লেগেছে। মন ছুঁয়ে গেল। সেই সময়কার নারীদের কথা ভেবে। ঠিক ই কত এক লম্বা ইতিহাস!

    Reply this comment
  2. নদী
    নদী 11 December, 2017, 00:55

    ভালো লাগলো, একটু লম্বা লেখা কেউ একজন পড়েছে এবং জানিয়েছে দেখে, অশেষ ধন্যবাদ!!!

    Reply this comment

Write a Comment