এখন শুধু সন্তানের মুখ দেখার অপেক্ষা

এখন শুধু সন্তানের মুখ দেখার অপেক্ষা

অস্ট্রেলিয়া থেকে: বাংলাদেশি এক শরণার্থী যুবক মারা গেছেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ নারুতে। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার এই যুবক ২০১৩ সালে অবৈধভাবে নৌকায় করে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের চেষ্টার সময় অস্ট্রেলিয়ার নৌ সেনাদের হাতে গ্রেফতার হয়। এরপর থেকে প্রথমে অস্ট্রেলিয়া সরকারের বন্দী ও পরে শরণার্থী হিসাবে নারুতে বসবাস করছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর তার লাশ হস্তান্তর নিয়ে বিশেষ এক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে! কারণ অস্ট্রেলিয়া সরকারের কাছে তার কাগজপত্র যা জমা আছে তা সঠিক নয়! স্বজনের যে নাম্বার দেয়া আছে সেটিও ভুয়া! বেশিরভাগ শরণার্থী বিষয়ক মামলায় যেমন থাকে। যেমন দেশটির কর্তৃপক্ষের কাছে জমা কাগজপত্রে আছে মৃতের বাবা বেঁচে নেই! কিন্তু আমরা তার বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বাংলাদেশের একটি ব্যাংকে চাকরি করেন।

ভুয়া তথ্য, ফোন নাম্বার থাকায় এদেশের কর্তৃপক্ষ লাশ হস্তান্তরের জন্য মৃতের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ক্যানবেরার বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। সচরাচর এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজের থেকে যোগাযোগ না করলে হাইকমিশনের এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার সুযোগ হয়না।

ভুল পথে বিদেশে অভিবাসনের স্বপ্ন দেখে মানবিক এক করুন পরিস্থিতির শিকার যুবকের নাম রাকিব। অস্ট্রেলিয়া সরকারের কাছে জমা কাগজপত্রে তার বয়স ২৬। কিন্তু স্বজনের দাবিমতো তার প্রকৃত বয়স ২৪  বছর ৪ মাস। দালালের কুপরামর্শে যুবক তার ২৬  বছর বয়সী বড় ভাই আশরাফ উদ্দীনের নাম ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করেন। যুবকের গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার সুবর্নচর উপজেলার চরজব্বর থানার পশ্চিম চরজব্বলি গ্রামে। নোয়াখালী কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্সে পড়তেন দুই ভাই এক বোনের সংসারের সবার ছোট এই ভাই।

IFgxtJA3D65i

তার বড় ভাই আশরাফ উদ্দিন আমাদের জানিয়েছেন, তিনি স্থাপত্য বিদ্যা পড়তে কানাডায় গিয়েছিলেন। তাদের একমাত্র বোনটি স্বামীর সংগে কানাডায় থাকেন। ছোটভাইর দূর্যোগের কারণে দেশে ফিরে এসে এখন আইন পড়ছেন। উল্লেখ্য রাকিবকে কেন্দ্র করে পরিবারটির দূর্যোগ চলছে সেই ২০১৩ সাল থেকে। যখন সে দালালের হাত ধরে অস্ট্রেলিয়া যাবার উদ্দেশে বাড়ি ছেড়েছিল।

রাকিবের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশন ও বর্ডার প্রটেকশন বিভাগ একটি বিবৃতি দিয়েছে। এই বিবৃতিতে বলা হয়, বুকের ব্যথা নিয়ে গত ৯ মে রাকিব নারুর একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ১১ মে সে সেখানে মারা যায়। মৃত্যুর কারণকে ম্যাসিভ হার্ট এটাক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নারুর একটি সূত্র বলেছে, রাকিবের অবস্থা সংকটাপন্ন হবার খবর পেয়ে তাকে নিতে অস্ট্রেলিয়া থেকে একটি এয়ার এম্বুলেন্স নারুতে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই সে মারা যায়। উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ায় হার্টের রোগীকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। অস্ট্রেলিয়ার ভিতরেও এ ধরনের রোগীকে হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্যে স্থানান্তরে প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। কোন ঝুঁকি নেয়া হয়না। রাকিবের জীবন বাঁচাতেও গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে।

রাকিবের বাবা ও ভাই আমাদের জানিয়েছেন, রাকিব পড়াশুনায় খুব ভালো ছিল। বিদেশে বিশেষ করে পড়াশুনার খুব সখ ছিল তার। আইএলটিএস’এ ৬’এর বেশি স্কোর তার উঠেছিল। কিন্তু এর মাঝে সে দালালের খপ্পরে পড়ে। দালাল তাকে বোঝায় পড়াশুনা করতে অস্ট্রেলিয়া যাবার কষ্ট অনেক। এরচেয়ে তার পথটি সহজ। এরপর রাকিব সহজ পথটি বিশ্বাস করে দালালের সঙ্গে যাবার জন্যে বেপরোয়া হয়ে উঠে। দালালের বাড়িও নোয়াখালী অঞ্চলে। এখন সে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।

দালাল একই সঙ্গে তার ছেলেকেও অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাচ্ছে দেখে তারা তাকে বিশ্বাস করে। এর জন্যে তাদের থেকে ১৫ লাখ টাকা নেয় দালাল। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে দালালের ছেলের সঙ্গে রাকিব মালয়েশিয়ায় যায়। সেখান থেকে যায় ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দোনেশিয়া থেকে তারা নৌকায় করে অস্ট্রেলিয়া রওয়ানা হয়। অস্ট্রেলিয়ার নৌসীমায় পৌঁছলে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার করে ক্রিসমাস আইল্যান্ড নামের এক দ্বীপের জেলখানায় নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে তাদের স্থানান্তর করা হয় নারুর জেলখানায়।

উল্লেখ্য এক সময় শরণার্থীদের স্বর্গরাজ্য অস্ট্রেলিয়া এখন শরণার্থী ইস্যুতে চূড়ান্ত কড়াকড়ির নীতি নিয়েছে। কারণ শরণার্থী ইস্যু এখন এদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু। বেশিরভাগ নাগরিক তথা ভোটাররা চান না সরকার তাদের ট্যাক্সের টাকা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে তাদের পিছনে খরচ করুক। বিশেষ করে অবৈধপথে নৌকায় করে যারা আসে সিংহভাগ স্থানীয় লোকজন তাদের প্রশ্নে খুবই ক্ষিপ্ত। অস্ট্রেলিয়ার আগের লেবার পার্টির সরকার শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার ব্যাপারে তুলনামূলক নরম ছিল। এর সুযোগে লেবার সরকারের আমলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক নৌকায় করে অস্ট্রেলিয়ার নৌ-সীমায় ঢুকে পড়েছিল। নৌকাডুবিতে মৃত্যুও হয়েছিল অনেক অভিবাসন প্রত্যাশীর।

অস্ট্রেলিয়ায় এই লোকজনকে বলা হয় বোট পিপল। আর এদের যারা নিয়ে আসে সেই দালালদের বলা হয় পিপল স্মাগলার।

4Y3twdRsQxvF

দেশটির বর্তমান লিবারেল কোয়ালিশন গত নির্বাচনের আগে এই অভিবাসী নৌকা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে। আর সাবেক লেবার সরকারের পরাজয়ের অন্যতম কারন ছিল এই বোট পিপল ইস্যু। এর জন্যে মজা করে বলা হয় নৌকার ধাক্কায় পড়ে গেছে লেবার সরকার। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নৌবাহিনীর একজন ফোর স্টার জেনারেলের নেতৃত্বে অবৈধ অভিবাসী নৌকা ঠেকাতে সাগরে বিশেষ প্রহরা জোরদার করা হয়। আগে অস্ট্রেলিয়ার নৌ-সীমায় কোন অভিবাসী নৌকা ঢুকলে তাদের আটক করে ক্রিসমাস আইল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে তাদের কাগজপত্র-বক্তব্য পরীক্ষা করে দেখা হতো তারা সত্যিকারের শরণার্থী কীনা, অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় পাবার যোগ্য কীনা। আর এখন অস্ট্রেলিয়ার নৌ-সীমার কাছাকাছি এমন সন্দেহভাজন নৌকা দেখলে আগেভাগে তাড়িয়ে দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার নৌ-সীমাতেই ঢুকতে দেয়া হয় না।

এখন অবৈধ অভিবাসীদের নৌকা ঠেকাতে এমন লোকজনকে ক্রিসমাস আইল্যান্ডের জেলখানা থেকে সরিয়ে নিয়ে নারু, পাপুয়া নিউগিনির বিশেষ জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওইসব জেলখানার সব খরচ অস্ট্রেলিয়া সরকার দেয়। নারুর জেলখানায় থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের এই রাকিবের শরণার্থী মর্যাদাও নিশ্চিত হয়। শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের উদ্ধাস্তু হাইকমিশনের দেয়া তার শরণার্থী নাম্বারটি ছিল ২৩৭৯।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়া সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অবৈধ নৌকায় করে আসা কেউ শরণার্থী মর্যাদা পেলেও এমন কাউকে তারা অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসবেনা। কম্বোডিয়াসহ নানাদেশে তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। অস্ট্রেলিয়া সরকারের ভয় এমন একজনকেও যদি অস্ট্রেলিয়ায় আনা হয় তাহলে তা সরকারের নমনীয় নীতি হিসাবে প্রচার পেয়ে অভিবাসীদের নৌকা্র মিছিল আবার অস্ট্রেলিয়ার দিকে রওয়ানা হবে। পণ্ড হয়ে যাবে তাদের সব সাফল্য। উল্লেখ্য চলতি কড়াকড়ি চালুর পর বোট পিপল ঠেকাতে প্রায় শতভাগ সফল অস্ট্রেলিয়ায় বর্তমান সরকার। তাদের আমলে এমন কোন নৌকা ঢুকতে পারেনি অস্ট্রেলিয়ায়।

বাংলাদেশের রাকিব শরণার্থীর মর্যাদা পেয়ে নারুর শরণার্থী শিবিরে থেকেও তাই অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকতে না পারার হতাশায় মরে গেছে! কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় না এলেও স্বজন-বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকার অভিনয় করে গেছেন রাকিব! তার ফেসবুক আইডিতে সে উল্লেখ করেছিল, লিভস ইন সিডনি, ফ্রম সিডনি, স্টাডিট এট ইউনিভার্সিটি অব সিডনি। স্বজনরাও জানতেন জেল পর্ব শেষে তাদের রাকিব এখন অস্ট্রেলিয়াতেই আছে!

তার ভাই আমাদের বলেছেন সর্বশেষ রাকিব তাদের জানিয়েছেন, তিনি প্রচুর কাজ করছেন। তার কাছে ৪৩ শ’ ডলার জমা আছে। রাকিব আরো জানাতেন তার সঙ্গে থাকা দালালের ছেলে সব সময় তাকে নানান পেরেশানিতে রাখে। সব সময় তার কাছে টাকা চায়। টাকার জন্যে নানান চাপ সৃষ্টি করে। সে জন্যে রাকিবের মৃত্যু স্বাভাবিক না হত্যাকান্ড এ নিয়ে নানান সন্দেহ এখন স্বজনের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে!

রাকিবের দালাল তথা অস্ট্রেলিয়ার ভাষার পিপল স্মাগলারের যাবতীয় তথ্য আমরা অস্ট্রেলিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। এর সঙ্গে দেয়া হয়েছে রাকিবের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের ফোন নাম্বার, ই-মেইল ঠিকানা। মধ্যবিত্ত পরিবারটির সব স্বপ্ন ভেঙ্গে এখন চুরমার। কান্নাভেজা পরিবারটি এখন রাকিবের লাশ, মরা মুখ দেখার অপেক্ষায়! তারা বাবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, আমার বড় ভুল হয়েছে। আর যাতে কোন পিতামাতার ছেলে এভাবে অবৈধপথে বিদেশ না যায়।


Place your ads here!

Related Articles

প্রিয় মানুষের শহর – ৯

ক্যানবেরা প্রথম। বদলী হয়ে এসেছি কুমা থেকে। সাত বছর মালেসিয়ায় থাকার পর কোম্পানি বদলী করেছিল – তাঁদের প্রধান কার্যালয় –

আমাদের মোনাজাতউদ্দিন

ফজলুল বারী: আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাংবাদিকদের কাছে মোনাজাতউদ্দিনের নাম-খ্যাতি শুনি। আমাকে তাদের অনেকে বলেন

মাহামাকুত বুদ্ধিষ্ট টেম্পলে এক বিকেলে

আমাদের শৈশবের বিনোদনের অন্যতম উপকরণ বিটিভিতে শুক্রবারটা ছিল আমাদের জন্য অনেক বেশি আনন্দের। সকালে বিভিন্নরকমের অনুষ্ঠানের শেষে বিকেলে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment