আশার কথন নিরাশায়

পজেটিভ ভাবনা ভালবাসি। নিরাশায়ও আশা খুঁজি। কোন ভাল মানুষ সম্পর্কে হঠাৎ মন্দ কিছু শুনলে প্রথমে তার ইতিবাচক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করি। মানুষকে সহজেই বিশ্বাস করি, যদিও জেনেছি এটি আজকের দিনে দুর্বলতা। তবু আশা রাখি। বিশ্বাস করি পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই ভাল মানুষ।
এক নিরাশা থেকে আশার কথা শেয়ার করব আজ।
আমার বিয়ে হয়েছে নয় বছর। আমার একমাত্র কন্যার বয়স দুই। অর্থাৎ, বিয়ের সাত বছরে আমি তাকে পাই। আর এর মাঝের দীর্ঘ সময় ছিল আশা-নিরাশায় দোদুল্যমান। যদিও আমার বিশ্বাস ছিল, আশা ছিল। কিন্তু আমার স্বামী অনেকটাই নিরাশ হয়ে পড়েছিল।
বিয়ের প্রথম বছরে আমি প্রথমবার গর্ভধারণ করি। যেদিন প্রেগন্যান্সি পরীক্ষার রিপোর্ট পজেটিভ পাই, সেই সকালটা ছিল ছুটির দিনের এক অনিন্দ্য সুন্দর সকাল। বিষয়টা জানার পর বাসায়, শ্বশুরবাড়ি একে তাকে ফোন করে বেড়াচ্ছিলাম আমরা। এই আনন্দে স্বামী আমায় দু’সেট থ্রীপিস কিনে দিল। কিন্তু এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হলো না, দু’সপ্তাহ পর অর্থাৎ প্রেগন্যান্সির সাত সপ্তাহের মাথায় সব উবে গেল। এক সকালে উঠেছি অফিসে যাব, ব্রাশ করতে গিয়ে দেখি প্রচন্ড পেট ব্যাথা, দাঁড়াতে পারছি না। সেই ব্যাথা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে তীব্র হয়ে ক্ষণে ক্ষণে যে জ্ঞান হারাচ্ছি, বমি করছি। সেদিন আমার বোন ছিল আমার বাসায়, মামা শ্বশুর এলেন হাস্পাতালে নিয়ে যাওয়া হলো আমায়। ধরা পড়ল- অ্যাকটোপিক প্রেগন্যান্সি, অর্থাৎ জ়রায়ূ ছাড়া অন্য কোথাও ভ্রুণের অবস্থান ও বৃদ্ধি। যা জ়ীবনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমার হয়েছিল টিউবাল প্রেগন্যান্সি, অপারেশনের আগেই বাম টিউবটা ফেটে যায়। যাহোক অপারেশন হলো, সেই অপারেশন তথা কথিত সাকসেসফুল হলেও শুদ্ধ হলোনা।
ডাক্তার বলেছিলেন ৬মাসের মধ্যে বেবি প্ল্যান না করতে, আমরা এক বছর অপেক্ষা করলাম। শরীরে আরো একটি টিউব অবশিষ্ট থাকলেও আমি আর কন্সিভ করলাম না, অন্তত এক বছর। তার পর চিকিৎসা, এই ডাক্তার সেই ডাক্তার। পরীক্ষা করে দেখা গেল আমার অন্য টিউবটি কাজ করছে না। সত্যি বলতে কি সে সময় যে একটুও নিরাশ হইনি তা নয়। তবে তার ব্যাপ্তি ছয় সাত দিনের বেশি নয়। নতুন করে আশা, সাহস, বিশ্বাস কিভাবে পেলাম নিজের মনে বলতে পারব না।
ডায়াগনসিসের জন্য আবার একটা ছোট অপারেশন মানে ল্যাপারস্কপি করা লাগল। দেখা গেল, প্রথম অপারেশনে আগের ডাক্তারের ভুলের খেসারত দিয়ে বেড়াচ্ছি আমি। তিনি আমার বাম টিউব কেটেছেন ঠিকই, কিন্তু ডান্ দিকেরটাও পেঁচিয়ে রেখেছেন। কিছু পুরনো রক্তও পরিস্কার করা হলো।
তার দেড় মাস পর বেবির কথা ভাবতে বললেন। তিন মাস পর আবার কন্সিভ করলাম। এবারও আশায় নিরাশ হতে হলো। এবারেও অ্যাক্টোপিক। আবার অপারেশন থিয়েটারের ট্রে’র ওপর যেতে হলো অল্প সময়ের নোটিসে। এবার আমার স্বামীকে থিয়েটারের ভেতরে ডেকে নিল। তাকে দেখালো- এবারে টিউবাল ছিল না, প্রথম অপারেশনে যে টিউব কাটা হয়েছিল, সেটির মুখ ভালভাবে সেলাই করা হয়নি, তাই এবারের টাইনি স্যাক সেই কাটা টিউব দিয়ে অন্য কোথাও পড়ে গেল, অনেক খুঁজে খুঁজে পাওয়া গেল। বাধ্য হয়ে সেটিও রিমুভ করা হলো।
এর পর বরের ধারণা ছিল টেস্টটিউব ছাড়া হবেনা বুঝি। যখন আমি তাকে আশার কথা বলতাম, আমার জন্য তার মায়া লাগত, যদিও প্রকাশ করত না। বরং, স্কলারশীপটা হয়ে গেলে বিদেশে এসে চিকিৎসা করবে বলে প্ল্যান করত।
একটা প্রবাদ আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু- আমিও তার ফল পেলাম, শেষবার গর্ভধানের পর ফুটফুটে এক পরী-কন্যা পেলাম।
এই এতগুলো কথা এজন্যে বলছি যে, আমি অনেক মাকে দেখেছি যে এই জাতীয় সমস্যা বা অকাল গর্ভপাতে ভীষণ রকমের ভেঙ্গে পড়ে। কেউ কেউ মানসিক ভাবে এতই হতাশ হয়ে পড়ে যে দীর্ঘ সময়েও স্বাভাবিক হতে পারে না । আসলে আমাদের মানসিক জোরটা খুব জরুরী। তবেই হতাশা আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। সব সময় মনে বল রাখা দরকার যে আমার সমস্যার সমাধান হবে, আজ না হলে কাল, নয়তো পরশু। আর না হলেই বা কতটুকু ক্ষতি? তার মধ্য ভাল কিছুও রাখতে পারেন ঈশ্বর।
সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিল বলে আমি একটা বেবি পেয়েছি, নাও পেতে পারতাম। তাহলেই কি হতো? জীবন থেমে থাকত কি? তবে ভালভাবে কেন নয়? বিশ্বাস করুন, তাকে না পেলেও আমি হতাশ হতাম না। আমার জীবনকেই আমি সুন্দর করার চেষ্টা করতাম, অন্যের সেবা বা এই ধরনের কিছু ভাল কাজ খুঁজে বের করে সুখী হতে চেষ্টা করতাম।
১২মে, ২০১৬
Related Articles
আমার দেশ ও বন্যা
দেশ ও তার মানুষ যখন চরম বিপর্যয়ের মাঝে, কি করছি আমরা তখন? ২০০ বছরের মধ্যে নাকি ভয়াবহ বন্যা হতে চলেছে
Bangladesh-US Dialogue
Ms. Wendy R. Sherman, Under-Secretary for Political Affairs, accompanied by more than ten officials, held a comprehensive partnership dialogue with
General Strike againt Human Rights
হরতাল বনাম নাগরিক অধিকার : হারুন রশীদ আজাদ (সিডনি থেকে ) ২৯শে নভেম্বর বি এন পি তথা বাংলাদেশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টি