আমরা চলি অবিরাম, অগ্নি অক্ষরে লিখি মোদেরই নাম
![আমরা চলি অবিরাম, অগ্নি অক্ষরে লিখি মোদেরই নাম](https://priyoaustralia.com.au/wp-content/uploads/2016/12/1482677316-890x395_c.jpg)
Print this article
Font size -16+
উদীচী বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর নানা দেশে আজ অবধি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। এ কথা ভাবতেই খুব ভালো লাগে যে, উদীচী আজ মানুষের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। ১৯৬৮ সালে সত্যেন’দাকে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। সে সময় আমরা যারা যুক্ত হয়েছিলাম তাদের অনেকেই কোনো না কোনো ভাবে গান বাজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।
তাছাড়া ছাত্র শ্রমিক ও নানা প্রগতিশীল কার্যক্রমের সঙ্গে আমরা সক্রিয় ছিলাম। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। নিজের বাড়িতে গানের আসর বসতো নিয়মিত। সেখানে আমরা ভাই-বোনেরা দল বেঁধে দেশের গান গাইতাম। নজরুল, রবীন্দ্র জয়ন্তীসহ অনেক অনুষ্ঠান এ বাড়িতে হতো। তাদের মধ্যে অজিত’দা, শেখ লুত্ফর রহমান, আজমল হুদা মিঠু, কাদেরী কিবরিয়া, ফকির আলমগীর, তপন, নিয়াজ আহমেদ এসেও গান করেছে আমাদের বাড়িতে। সেই সুবাদে একদিন আমার বড় ভাই মনজুরুল আহসান আমাদের জানালেন আরো বড় আয়োজনে গানের মহড়ার কথা, আর সেটা হবে নারিন্দা গেন্ডারিয়াতে; থাকবেন সত্যেন সেনসহ আরো অনেকে। আমরা বেশ উত্সাহের সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। হারমোনিয়াম কাঁধে করে বাস-এ চলে গেলাম। বোনের হারমোনিয়াম নিয়ে নারিন্দাতে সাইদুল হক ভাই-এর মেসে। সেখানে আরো কজন থাকতেন। ইদু ভাই হারমোনিয়াম ধরলেন আর আমরা সবাই শুরু করলাম গানের মহড়া। সত্যেন’দাও গান ধরলেন।
প্রথম গানটি ছিল সত্যেন’দার লেখা—‘ওরে ও বঞ্চিত সর্বহারা দল, শোষণের দিন হয়ে লো ক্ষীণ নবযুগ আসে।…’ তারপর শুরু হলো আইপিটি-এর কিছু জনপ্রিয় গান। সব শেষে সত্যেন’দা নিজের লেখা গান ধরলেন, যা তিনি জেল থেকে রচনা করেছিলেন। ‘মানুষে রে ভালোবাসি এই মোর অপরাধ, মানুষের কাছেই পেয়েছি যে বাণী / তাই দিয়ে রচি গান মানুষের লাগি / ঢেলে দিয়া যাব মানুষের দেয়া প্রাণ’। এই গানের মধ্যে দিয়া সত্যেন’দা তার মানুষের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ছিলেন। সেই অমর বাণী আজ আমাদের উদীচীর মূলমন্ত্র বা পাথেয় হয়ে আছে। এ গানে ছিল একজন প্রকৃত শিল্পী ও মানুষের মমত্ত্ববোধ আর আত্মোত্সর্গের চূড়ান্ত প্রকাশ—যা আমাদের কাছে আজ অনুসরণীয়।
এই অনভূতি নিয়ে সেদিন আমরা শুরু করেছিলাম আমাদের অবিরাম পথচলা। পরে আমাদের এলাকা চামেলীবাগ-এ নিয়মিত মহড়ার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় আমাদের নবযাত্রা। ১৯৬৮-তে আমাকে আহ্বায়ক করে প্রথম কমিটি করা হয় এবং সেখানেই আমাদের দলের নামকরণ স্থির হয় উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। সত্যেন’দা এই নামকরণ করেন।
গানের দল নিয়ে আমরা প্রথম অনুষ্ঠান করি গোদনাইল শ্রমিক এলাকাতে। বিশাল শ্রমিক সমাবেশে আমরা গাই। শ্রমিক নেতা ও শিল্পী খালেক ভাই ও সাইদুল হক ভাইও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এর পর-পরেই আমরা বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠান করি। বিশাল আয়োজন, পুরো হল ভর্তি লোক ছিল। সত্যেন’দার সভাপতিত্বে আলোচনা করেন রণেশ’দা, মতিয়া চৌধুরী আরো অনেকে। আমি অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করি।
ইদু ভাই গান পরিচালনা করেন আর আক্তার হোসাইন-এর লেখা একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়, অনুষ্ঠানটি দর্শক নন্দিত হয়। একটি ছোট প্রকাশনা আমরা সেদিন বের করেছিলাম।
কৃষক সমিতি ও জিতেন’দার আয়োজনে রায়পুরা কৃষক সম্মেলনে রাতের বেলা প্যান্ডেল-এর নিচে চলতে থাকে আমাদের জাগরণের গান। আজ সে কথা মনে করলে শিহরণ জাগে। আটষট্টির দশকে তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কল-কারখানা গ্রামেগঞ্জে ছাত্র শ্রমিক কৃষকের মধ্যে সে সময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সে সময় প্রচলিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্যে সাধারণের মধ্যে গিয়ে গান করা ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ। আমরা অকুতোভয়ে সেই সময় গণমানুষকে জাগিয়ে তুলতে অনেক কিছু তুচ্ছ করে এগিয়ে গিয়েছি মানুষের জন্য। ক্রমশ আমাদের শক্তি বাড়তে থাকে।
স্বাধীনতার পরে আপন লক্ষ্যে অটল থেকে উদীচী তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। উদীচীর এই পথচলা খুব মসৃণ ছিল না। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বরাবরই উদীচীর অগ্রযাত্রা রুখে দিতে চেয়েছে। কিন্তু যশোর উদীচীর উপর নারকীয় হামলা বাধাসহ কোনো হামলা উদীচীকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। আজ উদীচী প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সারা দেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে নিপীড়িত মানুষ ও স্বদেশের জন্য প্রতিশ্রুতবদ্ধ। স্বদেশের সীমানা ছাড়িয়া উদীচীর কর্মকাণ্ড সমপ্রসারিত হয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সসহ নানা দেশে। আশা করি উদীচী বিশ্ব পরিসরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য নাম হয়ে থাকবে।
সাহিত্যিক, মানব দরদী, বিপ্লবী সত্যেন’দা আমাদের হাতে যে পতাকা তুলে দিয়ে গেছেন—আজ তা সাহসের সঙ্গে বহন করে চলছে দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত তাঁর উত্তরসূরীরা, তাদের সকলের প্রতি আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। ঢাকাতে অনুষ্ঠিতব্য বাইশতম এই সম্মেলনের সাফল্য কামনা করছি। সেই সঙ্গে আশা করছি আগামীতে সুখী সম্মৃদ্ধ শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য আমাদের সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাদের ভবিষ্যত্ কার্যক্রম আরো শাণিত করবে। উদীচীর জয় হোক। মানুষের জয় হোক।
লেখক : উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক ১৯৬৮
Related Articles
American Policy toward Bangladesh
America remains the super power after the collapse of the Soviet Union in 1991. It is the world’s strongest military
মেলবোর্নের চিঠি – ১৪[পূর্ব প্রকাশিত মেলবোর্নের চিঠি]
[পূর্ব প্রকাশিত মেলবোর্নের চিঠি] মেলবোর্নের চিঠি শুরু করেছিলাম গেলো বছর। আজ লিখছি এর ১৪তম। শুরুতে প্রায় প্রতিমাসে দুই/একটা লেখা নিয়ে
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman: My Personal Experience
I had the privilege to work with Bangabandhu from 1973 to 1975 while I was a senior official at the
No comments
Write a comment
No Comments Yet!
You can be first to comment this post!