কবি-সাংবাদিক – আবিদ রহমান
মেলবোর্নের স্প্রিংভেল কবরস্তানে শুয়ে আছেন আশির দশকের বাংলাদেশের সাড়াজাগানো এক কবি-সাংবাদিক! আবিদ রহমান। তার ডানপাশের কবরে শুয়ে আছেন জন্মসূত্রে টার্কিশ একজন। বামপাশের ছিলেন জন আরব। তারা কবিতা লিখতেন বা কবিতা ভালোবাসতেন কীনা জানিনা। তাদের আত্মা হয়তো এখন জানে প্রতিবেশী এক কবির কথা। কবিতার আসর কী বসে কবির শেষশয্যার পাশে? না ফেরার দেশের এসব নিয়ে কোন উত্তর এখনও মেলেনি।
এ কবির দেহত্যাগের বেশ অনেক দিন হয়ে গেলো। দিনটি ছিল ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ। বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলার আগে দেশে ফিরতে এ কবির হূদয় ছটফট করতো। এক বা একাধিক বইতো বেরুতোই। কিন্তু শেষবার এ কবি ফেব্রুয়ারি দেখেও দেশ থেকে চলে এসেছিলেন! কিছু কাছের মানুষ আঘাত দিয়েছিল তার হূদয়ে! কাছের মানুষেরাইতো হূদয়ে আঘাত দেয়। দিতে পারে। কিন্তু এ কবি হূদয় তা সহ্য করতে পারেনি! হূদয়ের অসুখ নিয়ে কবি ফিরে এসেছিলেন মেলবোর্ন। এসেই টুপ করে মরে গিয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন! বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবরটি হয়েছিল। কারন এ কবি যে হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আলী রিয়াজ, মিনার মাহমুদ, সোহেল অমিতাভদের সমসাময়িক কবি-সাংবাদিক অথবা বন্ধুস্থানীয়। কবিপত্মী ও তাদের একমাত্র সন্তান মেলবোর্ন থাকেন বলে তার শেষ শয্যাটি মেলবোর্নেই করা হয়। তারা কী তার পাশে নিয়মিত যেতে পারেন? জীবন এখানে যে অনেক কঠিন।
সিডনিতে বসে তার মৃত্যু সংবাদ শুনে স্তব্দ হয়ে গিয়েছিলাম। কারন বিদেশ বিভূঁইয়ে বড় আপন একজন মানুষ তিনি ছিলেন, সবকিছু অকপটে শেয়ার করা যেত তার সঙ্গে। বিচিন্তার মাধ্যমে ঢাকার মিডিয়ায় যাত্রা শুরুর সময় থেকেই তিনি চিনতেন জানতেন। অস্ট্রেলিয়ার জীবনের প্রথম দিন থেকে প্রায় প্রতিদিন একবার ফোন করে জানতে চাইতেন, বদরুল কী করছেন। তার চলে যাওয়াতে পেয়ে বসে একা হয়ে যাবার কষ্ট সংক্রমন করে! কিন্তু এই দূরদেশের কঠিন জীবনে সিডনি থেকে তার শেষকৃত্যে ছুটে যেতে পারিনি। ফোনে কী বলবো তা ঠিক করতে না পারাতে তার স্ত্রী, আমাদের ভাবীকেও ফোন করতে পারিনি তাৎক্ষনিক! আজোবধি সেই ফোন করা হয়নি!
সেই মৃত্যুর বহুদিন পর মেলবোর্ন এসেছি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা উপলক্ষে। মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে যারা রিসিভ করেছেন সেই আশরাফুল, চন্দ্রবিন্দু ইমরান, আজমল এরাও আবিদ ভাইর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রথম আলাপেই বিশেষ একটা চাহিদার কথা তাদের বলে ফেলি। ক্ষমা চাইতে আবিদ ভাইর কবরের কাছে যেতে চাই। প্রয়াত কবির এক অনুজ খালাতো ভাই মেলবোর্ন থাকেন। ডাক নাম আদর। ইমরান আদরকে ফোন করেন। আদর আমাকে বলেন খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগতে পারবো কীনা। সকাল সাতটার দিকে যেতে পারবো কীনা। ইত্যাদি। সবকিছুই রাজি। আমার যে একবার যাওয়া দরকার তার কাছে।
সেই সকালে তৈরি হয়ে অপেক্ষায় থাকি। আদর আসতে দেরি করছিলেন। সারারাত জেগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্যে প্ল্যাকার্ড বানিয়েছেন। মেলবোর্নের আবার এক প্রান্তর থেকে আরেক প্রান্তর বহুদূর। মাঝখানে মূল শহর। আরেক প্রান্তর থেকে আসতে যানজটেও দেরি হয়েছে আদরের। এরপর গাড়ি হাঁকিয়ে ঝড়ের বেগে চলতে শুরু করেন আদর ওরফে নকিব রহমান।মেলবোর্নবাসী বাংলাদেশের তুমুল এক তরুন। মেলবোর্ন থেকে যিনি বাংলানিউজে লিখেন। সারা পথ আদর বলে গেলেন আবিদ ভাইর শেষ দিনগুলোর কথা। পেশার টানে বাংলাদেশে যাওয়া, এক বুক কষ্ট নিয়ে ফিরে আসা, টুপ করে মরে যাওয়া সবকিছুর বৃত্তান্ত। চোখ ভিজে আসে।
স্প্রিংভেল সিমেন্ট্রি এলাকায় ঢুকে চমকে উঠি। এ যেন এক সবুজ প্রান্তর। অথবা সাজানো সুন্দর বিশাল এক ফুল বাগান! দু’পাশে সারি সারি সব বাঁধানো কবর। কোন একটি কবর এলাকা এত সুন্দর পরিকল্পিত হতে পারে, তা না দেখে বিশ্বাস করা কঠিন। খ্রীষ্টান, ইহুদি, মুসলিম এলাকাগুলো আলাদা করা। কবরের মুসলিম এলাকাটি নতুন হয়েছে। তারই একটিতে চির শয্যা হয়েছে আমাদের আবিদ ভাইর। আমি তার কবরের পাশে বসে পড়ি। ছুঁয়ে দেখি ওপরের মাটি। মাথার এলাকাটায় কাঠের একটি ফলকে ইংরেজিতে তার নাম লেখা। আশেপাশের কবরগুলোর মতো সেটি বাঁধাই করা নয়। তাই আদর বা পরিচিত কেউ নিয়ে না এলে কবরটি একা একা চিনতে পারতাম না। আমার শোক কী সেখানে দুই সঙ্গী, মেলবোর্নে আবিদ রহমানের রেখে যাওয়া দুই স্তম্ভ চন্দ্রবিন্দু ইমরান আর আদর নকিব রহমানকে সংক্রামিত করেছে? জানিনা। জানতে চাইওনি। আমি শুধু তাদের বলেছি, এখানে আসতে পেরে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমাকে এখানে আমার আবিদ ভাইর শেষশয্যার কাছে নিয়ে আসাতে আমি তাদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ।
বাংলাদেশ, তোমার পক্ষে আমি তোমার এক প্রাণোচ্ছল কবির শেষশয্যায় শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম। তার জন্যে এখানে এপিটাফ লিখছি নীলিমা ইব্রাহিমের ভাষায়। “অনন্তকালের তরে/গৌঢ় মন মধু করে/ পান করি করিবেক/ যশস্বী তোমারে।”