জীবন ভ্রমন ২০, ২১ :

জীবন ভ্রমন ২০, ২১ :

জীবন ভ্রমন ২০ : ১৯৮১  সাল । এইচএসসি পরীক্ষা শেষ । একদিন বিকালে আমি আর বন্ধু দিপু গল্প করছি । তখন ইন্ডিয়ান প্রিন্ট এর লুঙ্গি পপুলার ছিল । পাড়ার এক বন্ধু ইন্ডিয়া আসা যাওয়া করতো ।  ব্যবসায়ী  পরিবার । জানতাম সে  কিছু জিনিস বিক্রি করে ।  আমি আর দিপু কথা প্রসঙ্গে জিগ্গেস করলাম ” লুঙ্গিটা খুব  সুন্দর , তোর কাছে extra  থাকলে কিনতে পারি ” ।  তার কাছ থেকে  একেবারে অনাকাংখিত একটা উত্তর পেলাম । আমরা  দুজন অপমানিত বোধ করলাম ।

দিপু মতিঝিল  সেন্ট্রাল গভর্মেন্ট স্কুলে আর আমিমতিঝিল আইডিয়াল হাই স্কুলে পড়তাম ।  প্রাইমারি স্কুল  থেকে এক সাথে পড়ি । সন্ধায় আরো কয়েক জন বন্ধুকে অপমানের কথাটা বললাম । দুই জন প্রতিগ্গা  করলাম ” ইন্ডিয়া গিয়ে ওই লুঙ্গি না কিনা পর্যন্ত আর লুঙ্গি পরব না ” ।  একজনকে বললাম এই মেসেজটা  ওই হালারে পৌছাইয়া দিস ।

তিন মাসের মধ্যে ইন্ডিয়া যেতে হবে । কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না । প্রথমে মাকে ব্যাপারটা  বলে রাখি । তারপর স্টেপ বাই  স্টেপ । সবার আগে পাসপোর্ট । আর্জেন্ট ফী ৫০০ টাকা ছিল । টিউশনি করতাম । নিজেই ম্যানেজ করেছি । মগবাজারে পাসপোর্ট অফিসে গেলাম । প্রথম ধাক্কা বয়স ১৮ হয়নি । দুই মাসের  মত বাকি আছে । বাবার কাছ থেকে NOC  আনতে হবে । জানি আব্বা  এইটা দিবে না । আব্বার অফিসের  রাবার স্ট্যাম্প  বাসায় ছিল । নিজেই টাইপ করে বানিয়ে নিলাম । বলা  যায় white  লাই  ।

নিজে নিজেই আমরা দুই জন ফর্ম জমা দিলাম । আমাদের বাড়ির এক চাচা পাসপোর্ট অফিসে চাকরি করতেন । সে এক বিশাল অভিগ্গতা । বারো  দিনের মধ্যে পাসপোর্ট  হাতে পেলাম । পুলিশ ভেরিফিকেসন যাতে বাসায় না আসে ৫০ টাকা দিয়ে চাচা এক দালালের মাধ্যমে ব্যবস্থা করে দিলেন । আমরা DB  অফিসে গিয়ে ইন্টারভিউ  দিয়ে আসি । আমাদের ইন্ডিয়া যাওয়ার কাহিনী শুনে DB  পুলিশ  একমত প্রকাশ করেন ।

তারপর এয়ার টিকেট । তখন ঢাকা  কলকাতা  ভাড়া ছিল ৬০০ টাকা ।  এলাকার  রাঙ্গা ভাইট্রাভেল এজেন্সী তে কাজ করতেন । উনি ৭ %  কমিসন দিয়ে টিকেট করে দিলেন । টিকেট হাতে দিয়ে বললেন ” সব কিছু ঠিক আছে , জাস্ট আগের দিন বিমান অফিসে গিয়ে কনফার্মেসন   স্টিকার লাগিয়ে নিয়ে আসবে ” ।

তারপর সাত  দিনের হোটেল ভাড়া এবং খাওয়া খরচ । এই নিয়ে  তথ্য সংগ্রহ করতে  গিয়ে  কস্ট  রিকভারি টেকনিক জেনে গেলাম । অর্থাৎ  ডিউটি ফ্রি  সপ থেকে যা পাওয়া যায়, হোটেলে দালালের কাছে  সেই জিনিস  বিক্রি করলে সাত দিনের হোটেল ভাড়া হয়ে যায় । সাথে জাপানি ১ টা ক্যাসিও  হাত ঘড়ি । এই টেকনিকে হোটেল ভাড়া প্রস্তুত ।

দশ রুপি দিয়ে তখন তিন বেলা খাওয়া হয়ে যেত – নো  সমস্যা ।  থাকা -খাওয়া ও শপিং বাবদ সাত দিনের বাজেট  ১০০০ রুপি ।  প্রায় দুই  হাজার টাকার মত ছিল । মা ভাইকে বলেছে । ভাই ১০ টাকা নোটের একটা বান্ডেল ( এক হাজার টাকা ) দিলেন । আর বললেন “আমার পাস বুকে দেওয়ার মত আর নাই ” । ভাই DU তে  MS  এর ছাত্র  ছিলেন । সন্ধ্যায় পার্ট টাইম  একটা কাজ করতেন । অব্লিগেশন ফ্রি  ডোনেশন  । আমি লজ্জায়  কোনো উত্তর  দিলাম না । মনে মনে বললাম আমার  বাজেট ট্রিপ  এর  জন্য এক  হাজারই  যথেস্ট । ফিনান্স রেডি  । ভিসা  ও ফ্লাই করার জন্য অপেক্ষা করছি (অসমাপ্ত )।

 

জীবন ভ্রমন ২১ : একাশি সাল । প্রথম বিদেশ ভ্রমন । তাও এলাকার সমবয়সী একজনের অনাকাংখিত আচরণের কারণে । পাসপোর্ট , টিকেট , বাজেট প্লান ,ও ফিনান্স রেডি  করার পর দুই বন্ধু গেলাম জিগাতলা রোডে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে । দালাল থেকে ভিসা ফর্ম সংগ্রহ করার পর , রাস্তার পাশে টিনের বাক্সে হাত ডুকিয়ে ৬ টাকা দিয়ে ফটো তুলেছি । দালাল বলল জমা দেওয়া পর্যন্ত চেহারা বুজা গেলেই চলবে ।

আবারো হোঁচট খেলাম ।  সাত দিন বাকি ১৮ বছর হতে । আবার নিজে noc বানিয়ে দিলাম । বললাম ফ্লাই করার আগে ১৮ বছর হয়ে যাবে । যাই হোক ভিসা ক্লার্ক  এর  রেট ১০ টাকা । দিয়ে  দিলাম । বিকালেই লাল একটা রাবার স্ট্যাম্প সহ পাসপোর্ট হাতে পেলাম ।

অবশেষে ফ্লাই করার দিন আসলো । দুই বন্ধু আগের রাতে চেক লিস্ট টিক করে পরের দিন এয়ার পোর্ট গেলাম । দুপুরের  দিকে ফ্লাইট ছিল  । এয়ার ক্রাফট F28 । বিমানের কাউন্টারে চেক ইনের জন্য টিকেট ও পাসপোর্ট দিলাম । অপর প্রান্ত থেকে বলল ” আপনাদের টিকেট কনফার্ম করা নেই , সিট নেই, ওয়েট  করেন  ” । মাথায় ঠাডা  পরার মত অবস্থা ।

একজনকে অনুরোধ করে ট্রাভেল এজেন্সির রাঙ্গা ভাইকে ফোন দিলাম । বন্ধুর বড় ভাই । উনি বলেন কনফার্মেশন স্টিকার লাগাও নি ! আমি বললাম ” এইখানে তো স্টিকার লাগানোর কোনো অফিস নাই ” । উনি বললেন ” আরে বেয়াকুব , এইটা মতিঝিলে বিমান অফিস থেকে করতে হয় , তোদের তো সেই দিনই বলেছি , কাউন্টারে বল লিস্টে তোদের নাম আছে , বুঝতে  পারি নাই স্টিকার  লাগাতে হবে ” ।

কাউন্টারের পাশে থাকা বিমানের ড্রেস পরা একজনকে  ব্যাপারটা বললাম । উনি লিস্ট চেক করে দেখলেন । তারপর আমাদের চেক ইন করতে দিলেন । বোর্ডিং পাস নিয়ে ইম্মিগ্রেসনে গেলাম । এমন  সময় আমার কাজিন সিস্টার এসে হাজির । সিভিল  এভিযেশনে চাকুরী করতেন । উনি ইমিগ্রেশন ও কাস্টম হয়ে আমাদের নিয়ে পায়ে হেটে বিমানে তুলে দিলেন । উনি থাকাতে অতিরিক্ত কোন প্রশ্নের মুখুমুখি হতে হলো না ।

বিমানে  উঠার আগে উনি বলল আমার জন্য কি আনবি । বললাম ” আপানি  হযত জানেন কিভাবে আমি যাচ্ছি ” ।  উনি বললেন ” খালা আমাকে বলেছে , এইটা নে , আমার জন্য একটা কাশ্মিরি  শাল আনবি ” ।  পাশে দাড়ানো একজন বলল ” দম দমে দাদারা কিন্তু ক্যাশ টাকা পেলে নিয়ে নিবে ” । ভয়  পেলাম । খালাতো  বোন বলল ” চিন্তা করিস না , অব্লিগেশন ফ্রি “। সিঁড়ি বেয়ে ভয ও শিহরন মিশ্রিত মনে দুইজন সেই কাঙ্খিত বিমানে উঠে গেলাম । আর দমদমে  নামার অপেক্ষা  করতে  থাকলাম ।


Place your ads here!

Related Articles

ক্রিকেট জাতি অস্ট্রেলিয়া বিব্রত, ক্ষুব্ধ এবং লজ্জিত

মনটা খুব খারাপ,  বিক্ষিপ্ত। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বল ট্যাম্পারিং’এর যে কেলেংকারিতে জড়িয়েছে, তা শোনার-জানার পর কি মন ভালো থাকার কোন সুযোগ আছে?

Why is India so insensitive to the affairs of Bangladesh?

In December 2010, New York based Human Rights Watch in a report described the Indian border guards as “Trigger Happy”

Travel to US and Europe – Reflecting on the morning of hope

We had a good time in New York. We did what we could reasonably do in about a week. As

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment