১৯৭১ ভেতরে বাইরে – একটি নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ বিশ্লেষন – পর্ব ৩

১৯৭১ ভেতরে বাইরে – একটি নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ বিশ্লেষন – পর্ব ৩

জনাব এ, কে খন্দকার সাহেব তার বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের আওয়ামী লিগের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীকে স্বাধীনতার ঘোষনা দেওয়ার জন্য সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। কোথাও কোথাও এমনও উল্লেখিত হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু ই পি আর এর বেতার যন্ত্রে বা ডাক ও তার বিভাগের টেলিগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষনার বার্তাটি প্রচার করেন। এগুলোর কোন যুক্তিসংগত প্রমান আমি কোথাও পাইনি।‘ স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও জনাব এ, কে খন্দকার সাহেব বস্তুত দুইটি বিষয়ে যুক্তিসংগত প্রমানের অপেক্ষায় আছেন। বিষয় দুইটি হলো; বংগবন্ধু কি স্বাধীনতা ঘোষনা করেছিলেন আর তা কি ভাবে চট্টগ্রামে জনাব জহুর আহমেদ সাহেবের কাছে প্রেরন করা হয়েছিল।

যুক্তিসঙ্গত নির্ভরযোগ্য প্রমানের সন্ধানেঃ ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষনা না দিলেও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন এই ভাবে-“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এ প্রসংগে জি ডব্লিউ চৌধুরী তার The Last Days Of United Pakistan গ্রন্থের ১৬১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন –“… The daily Telegraph (London) reported on March 9, 1971 that Sheikh Mujibur Rahman appears to have declared the independence of East Pakistan.” একই দিন দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়ঃ “Already we hear the putative name of the separate state that East Pakistan could become – Bangladesh.” Similar reports appeared in the Economist (March 13, 1971) and the Time magazine (March 15, 1971): “Pakistan as it stands today is Finished.”

একই ভাষনে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে বলে গিয়েছিলেন যদি (পরিস্থিতীগত কারনে) তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষনা দিতে না পারেন তা হলে কি করনীয়, “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।“ ৭ই মার্চের ভাষনেই বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে এই ধরনের পরিস্থিতীতে কি করনীয় তার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে গিয়েছিলেন।

আর ২৫ শে মার্চ রাত্রে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর সেইরকম পরিস্থীতির উদ্ভব হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে যারা বিদ্রোহ করেছিলেন তাদের বক্তব্যে তাই প্রমানিত হয়। রামগড়ে মেজর রফিক বীর উত্তম (লক্ষ প্রানের বিনিময়ে, মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম), ব্রাম্মনবাড়িয়ায় মেজর শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল), জয়দেবপুরে মেজর শফিউল্লাহ’ এদের কেউই’ কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষনার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন নাই। আরো যেমন বসে থাকেন নাই রাজারবাগের বীর পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা, পীলখানার আর চুয়াডাঙ্গার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বি ডি আর এর সৈনিকরা।

রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রান্ত হয় ২৫ শে মার্চ রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটের দিকে। প্রায় সাথে সাথে রাজারবাগ ওয়্যারলেস বেইজ স্টেশনে বসে থাকা কনস্টবল শাহজাহান তার ওয়্যারলেস সেটে বলতে শুরু করল, “Base for all stations of East Pakistan Police, keep listening, watch, we are already attacked by PAK army, try to save yourself over.”

(নক্ষত্রের রাজারবাগ, মোশতাক আহমেদ – পৃঃ ১৬৭ – ১৬৮)।

কনস্টবল শাহাজানের এই মেসেজটি সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। হূমায়ূন আহমেদের বাবা জনাব শহীদ ফয়জুর রহমান ২৫শে মার্চ তারিখ রাতে পিরোজপুরে কর্মরত অবস্থায় এই মেসেজ শুনতে পেয়েছিলেন। (প্রফেসর ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাক্ষাতকার ৮ জুলাই ২০১১, একাত্তর এবং আমার বাবা, হুমায়ুন আহমেদ) । তাই দেখা যাচ্ছে টেলিগ্রাফ ছাড়াও ঢাকা থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা বা বার্তা চট্টগ্রামে বা দেশের যে কোন স্থানে পাঠানোর একাধিক উপায় ছিল। এর পর পরই রাজারবাগ পুলিশ লাইনে শুরু হয় আমাদের স্বাধীযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ যার বিস্তারিত এবং জীবন্ত বর্ননা পাওয়া যায় মোশতাক আহমেদ রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘নক্ষত্রের রাজারবাগ’ গ্রন্থে। রাজারবাগের বীর পুলিশ বাহিনী প্রকৃত পক্ষেই যার যা আছে তাই (৩০৩ রাইফেল) দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।

২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাত ১০- ১১টার মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরে প্রবেশ করে এবং রাজারবাগ, পিলখানা এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। গ্রেফতার হওয়ার আগে বংগবন্ধু কমপক্ষে দুইবার সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রথম প্রমান পাওয়া যায় সাংবাদিক ডেভিড লোশাক- এর পাকিস্তান ক্রাইসিস গ্রন্থের ৯৮-৯৯ পৃষ্ঠায়। তিনি লিখেছেন- “The voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like a Pre-recorded message, the Sheikh Proclaimed East Pakistan to be the People’s Republic of Bangladesh.

সম্প্রতি শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ এর কন্যা শারমিন আহমেদ এর লেখা গ্রন্থ ‘তাজউদ্দীন আহমেদ নেতা ও পিতা’ গ্রন্থে (পৃ ৩০১-৩১০) আমরা সেই ব্যাক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি । তিনি হচ্ছেন টি এন্ড টি’র শহীদ প্রকৌশলী এ, কে, এম নুরুল হক যিনি একসময় পাকিস্তানে টেলিকমিউনিকেশন ব্যাবস্থার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। তিনি ২৫ শে মার্চ জনাব আমিরুল ইসলামকে জানিয়েছিলেন যে তিনি খুলনা থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ট্রান্সমিটার এনেছেন। এই ট্রান্সমিটারের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষনা প্রচার করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় ঘোষনাটি রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পীলখানা আক্রমন বিষয়ে প্রনীত। এই ঘোষনাটির মূল ডিক্টেশন তিনি নিজেই দিয়েছিলেন টেলিফোনে। টেলিগ্রাফ অফিসে বংগবন্ধুর এক কর্মী এই ডিক্টেশন গ্রহন করে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে তা চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরীকে প্রেরন করেন। এই মহান দেশপ্রেমিক কর্মীকে শহীদ প্রকৌশলী এ, কে, এম নুরুল হক এর ন্যায় হত্যা করে। পাকিস্তানীরা জনাব এ, কে খন্দকার সাহেবের মত অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, ‘কার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এই টেলিগ্রাফ প্রেরন করেছিলেন?’ এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় HERBERT FELDMAN এর The End And The Beginning (Pakistan 1968-1971) গ্রন্থে। (পৃঃ ১২৮/ফুটনোট আক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিপ্রেস ১৯৭৫)

টেলিগ্রাফে যে বার্তাটি পাঠানো হয়েছিলো তা নিন্মরূপঃ

The message of Sheikh Mujib

To

The people of Bangladesh

On the night of 25th March, 1971

Pakistan armed forces suddenly have attacked our country under the cover of darkness. They have treacherously attacked the East Pakistan rifles base, Pilkhana and Rajarbag police barracks in Dacca, killing lacs of unarmed people. The East Pakistan rifles in Dacca, the police and the people are fighting the enemy forces sternly. Let the world know of the genocide. Brethern, take up the arms, whichever you have Resist the enemy forces at any cost. May Allah bless you and help you in your struggle for freedom.

Jai Bangla

-S.M.R

[১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে Indian Associated Publishing Co. Private Ltd. থেকে প্রকাশিত গাজিউল হক-এর Bangladesh Unchained গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।] লক্ষনীয় যে বার্তাটির শেষে বংগবন্ধুর নামের অদ্যাক্ষর -এস এম আর লেখা। যার অর্থ শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিনই বংগবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষন, ‘বজ্রকন্ঠ’ অনেকবার প্রচার করা হতো। তাজউদ্দীন আহমেদে এর মত বড় মাপের নেতা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার কোন নিয়মিত বক্তব্য, ভাষন বা বানী প্রচারের প্রয়োজন হয় নাই। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এবং একই সাথে তার স্বকন্ঠে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষনার রেকর্ড না থাকার কারনে, ৭ ই মার্চের সেই স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষনাই সময়ের দাবীতে স্বাধীনতার ঘোষনায় পরিনত হয়।

ডা বেলায়েত হুসাইন, এমডি বর্তমানে ট্রয়, ওহাইও, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র। তিনি লিখেছেন, “ রাত আনুমানিক ১২ ৩০ মিনিট। মাইকের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। কান পেতে শুনলাম ঘোষনা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষনা করেছেন। দেখলাম দু’জন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। আগের সৈনিকটি ততোধিক উত্তেজনা মিশ্রিত স্বারে বললো, ‘শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন। লড়াই শুরু হয়ে গেছে’।“ (একাত্তুর স্মরনে, ডা বেলায়েত হুসাইন পৃঃ ১৩-১৪)

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনা যে চট্টগ্রামে ২৫শে মার্চ রাতেই পৌছেছিল তার নির্ভরযোগ্য প্রমান ডা বেলায়েত হুসাইন, এমডি’র মত চট্টগ্রামে অবস্থিত অনেকের লেখাতেই পাওয়া যায়।

আসুন সঠিক ইতিহাসের স্বার্থেই আরেক বার ফিরে যাই চট্টগ্রামে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। এখন দৃষ্টি দেয়া যাক ক্রমানুসারে রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষনা কে এবং কখন প্রচার করেছিল।

রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষনাঃ স্বাধীনতার প্রথম ঘোষনাঃ হারুন হাবীব সম্পাদিত “প্রত্যক্ষ দর্শীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ” গ্রন্থে মোস্তফা আনোয়ারের বেতার বিদ্রোহ শীর্ষক লেখায় তিনি লিখেছেনঃ “আওয়ামী লিগের হান্নান সাহেব প্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনাটি পরেছিলেন (কালুর ঘাট ট্রান্সমিটার থেকে ২৬ শে মার্চ দুপুর ১ ০৫ মিনিটে।“ [পৃ-৪৬])

স্বাধীনতার দ্বিতীয় ঘোষনাঃ এর প্রায় মিনিট পনেরো পর এম, এ হান্নান আবার একটি লিখিত বক্তব্য প্রচার করতে আসেন। কিন্তু বেলাল মোহম্মদ এম, এ হান্নানকে নাম প্রচার করতে দেননি, তবে বক্তব্য প্রচার করতে দিয়েছিলেন (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বেলাল মোহম্মদ )।

স্বাধীনতার তৃতীয় ও চতুর্থ ঘোষনাঃ ২৬শে মার্চ বংগবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষনার প্রসঙ্গে দুবার এম এ হান্নানই শুধু প্রচার করেন নি বরং বঙ্গবন্ধুর তারবার্তাটির মুল ও অনুবাদ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ এবং আব্দুল্লাহ আল ফারুক পাঠ/প্রচার করেছিলেন। সেই সুত্রে দ্বিতীয় দেনে অর্থাৎ ২৭ শে মার্চ আমাদের সঙ্গে যোগদান করে মেজর জিয়া যে ঘোষনা প্রচার করেছিলেন তাকে অবশ্যই পঞ্চম ঘোষনা বলা সঙ্গত।“(সাঃ বাঃ বেঃ কেঃ পৃষ্ঠা -২৬৯)

প্রকৃত পক্ষে জিয়াউর রহমানের আগে পঞ্চম ও সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘোষনাটি দিয়েছিলেন মাহমুদ হোসেন!

স্বাধীনতার পঞ্চম ঘোষনাঃ “মাহমুদ হোসেন বলেছিলেনঃ আমি ইংরেজী একটা ঘোষনা প্রচার করেছি মাত্র। বলতে পারেন এস ও এস। সম্বোধন করেছি “হ্যালো ম্যান কাইন্ড বলে। এই মিনিট দশেক।“ (সাঃ বাঃ বেঃ কেঃ পৃষ্ঠা -৩৭)

[এই মাহমুদ হোসেন ছিলেন ইউরোপ প্রবাসী বাঙ্গালী যুবক। এন্থনী ম্যস্কারেনহাসের ‘এ লিগেসী অফ ব্লাড’ থেকে জানা যায়, এই মাহমুদ হোসেনের বাড়ি ছিলো বগুড়ায়। ২৫ শে মার্চে তিনি চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ হোটেলের বোর্ডার ছিলেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই এর ভাতৃকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তার দৃড় বিশ্বাস ছিল তিনি ভারত থেকে আস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবেন তাই তিনি বেলাল মোহম্মদ’কে নিয়ে মেজর জিয়ার কাছে গিয়েছিলেন। তার পর এক পর্‍যায়ে মাহমুদ হোসেন জিয়াউর রহমানের ৮ ম বেঙ্গলের সৈনিকদের গুলিতে মারা যান। মাহমুদ হোসেনের মৃত্যু রহস্যাবৃত। তার লাশ বুড়া মৌলভীর টেকে তিনদিন জলে ভেসে ছিল, কেউ সে লাশ দেখতে যান নি, এমন কি তার বন্ধু বেলাল মাহমুদ ও নন! (অন্তর্ঘাত ১৯৭১, মানিক চৌধুরী)] মেজর রফিক (লক্ষ প্রানের বিনিময়ে, মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম) এবং বেগম মুশতারী শফি’র বইয়ে (স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন, বেগম মুশতারী শফি) আমরা এই মাহমুদ হোসেনের বর্ননা পাই। জেনারেল নিয়াজি হয়তো এই সব রহস্যের কারনেই তার বইয়ে বলেছিলেন, “চট্টগ্রাম ছিলো প্রতারনামূলক স্থান।“

উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে আজমপুর বাস ষ্টান্ড এর পাশে অবস্থিত ‘আমীর কমপ্লেক্স’ এর মালিক ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল হক সাহেব তার স্মৃতিচারন মূলক গ্রন্থে ১৯৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রামের এই মাহমুদ হোসেন সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। (১৯৯৪ সালে ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল হক সাহেব আমাকে বইটি উপহার দিয়েছিলেন। বইটির নাম আমার এই মূহুর্তে মনে আসছে না বলে দুঃখিত)।

স্বাধীনতার ষষ্ঠ ঘোষনাঃ ২৭ শে মেজর জিয়াউর রহমান প্রথম বাঙ্গালী সামরিক অফিসার হিসাবে এই ঘোষনাটি পাঠ করেন বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে নিজের নামে। এই ঘোষনা কিছুক্ষন পর পরই প্রচার করা হতে থাকে কালুরঘাট রেডিও ষ্টেশন থেকে। পরবর্তীতে উপস্থিত সবার চাপে তিনি বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষনাটি পাঠ করতে বাধ্য হন।

গোলাম মুরশিদ (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস, গোলাম মুরশিদ) তাই যথার্থই লিখেছেন মেজর জিয়ার এই ঘোষনা সম্পর্কেঃ “তিনি ঘোষনা দেওয়ার অন্তত ৪০ ঘন্টা আগে থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বাঙ্গালীরা স্বতস্ফূর্তভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেছিলেন। তার ঘোষনা শুনে কেঊ সংগ্রাম আরম্ভ করেন নি। কিন্তু একথা স্বীকার না করে উপায় নাই যে, তার ঘোষনা বাংলাদেশের যে সব জায়গায় শোনা গিয়েছিল, সে সব জায়গার লোকের দারুন উতসাহিত হয়েছিলেন।“ প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা তাই ছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম প্রহরে ব্রাম্মনবাড়িয়ায় মেজর শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম এবং জয়দেবপুরে মেজর শফিউল্লাহ’ নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, রাজারবাগের বীর পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা, পীলখানার আর চুয়াডাঙ্গার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বি ডি আর এর সৈনিকরা যুদ্ধ শুরু করলেও সেই সময় অতন্ত্য দূর্বল যোগাযোগ ব্যাবস্থার কারনে শুধুমাত্র স্থানীয় জনগন ব্যাতীত সমগ্র দেশবাসী বাঙ্গালী সৈনিকদের বিদ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদান সম্পর্কে একেবারেই অবহিত ছিল না। রেডিও’তে মেজর জিয়ার ঘোষনার মধ্য দিয়ে দেশবাসী প্রথম বাঙ্গালী সৈনিকদের বিদ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদান সম্পর্কে প্রথম বারের মত অবহিত হয়।

এক পর্‍যায়ে জনাব এ, কে খন্দকার সাহেব আবার লিখেছেন, “স্বাধীনতার ঘোষনা আর ঘোষকের (আসলে লেখা উচিত ছিল রেডিও’তে) বিষয়টি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে খুব বেশি প্রভাবিত না করলেও পরবর্তী সময়ে অনেক বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে।“ আসলে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রথম এক সপ্তাহের পর উল্লেখ করার মত কোন ভাবেই প্রভাবিত করে নাই, আর সেই কারনেই স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের আগষ্ট পর্‍যন্ত এই আনুষ্ঠানিক ঘোষনা নিয়ে কোন বিতর্ক বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় নাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পর ইতিহাস বিকৃতির ফলে অনেক মানুষ’ বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়েছিল। আর জনাব এ, কে খন্দকার সাহেব তার বইয়ের মাধ্যমে সম্প্রতি (ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে) সেই বিভ্রান্তিকে আর একটু উশকে দিয়েছেন।

এখন জনাব এ, কে খন্দকার সাহেব হয়তো আবার প্রশ্ন করতে পারেন বঙ্গবন্ধু কেন কখনোই শহীদ প্রকৌশলী এ, কে, এম নুরুল হক বা টেলিগ্রাফ অফিসের সেই কর্মীর নাম উল্লেখ করেন নাই? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই, যেমন জানা নাই কেন বঙ্গবন্ধু কখনো ই‘মুজিব নগর’ এ যান নাই!

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র বেলায়েত হুসাইন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং জেড ফোর্সের সাথে তিনি ‘ডাক্তার সাব’ হিসাবে কাজ করেন। তিনি তার বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন, “১৯৭৫ সালে যখন আমি পি জি হাসপাতালে তখন আমি প্রথম আমার ডাইরীটা প্রকাশ করার কথা ভাবি। ঘটনাক্রমে জেনারেল জিয়াকে এটা বলায় তিনি লেখাটি পড়তে চান। পড়ার পর তিনি আমাকে বলেন এটাকে রি-রাইট করতে”!

ইতিহাস বা সত্য ঘটনা রি-রাইট করা যায় না, কারন সত্য একটাই; ইতিহাস বা সত্য ঘটনা অবশ্য বিকৃত করা যায়।

মুল তথ্যসূত্রঃ

১। মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস, গোলাম মুরশিদ

২। অন্তর্ঘাত ১৯৭১, মানিক চৌধুরী, উন্মেস প্রকাশনী, সেক্টর ৩ উত্তরা ঢাকা

৩। একাত্তর এবং আমার বাবা, হুমায়ুন আহমেদ

৪। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বেলাল মোহম্মদ

৫। প্রত্যক্ষ দর্শীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ, হারুন হাবীব সম্পাদিত

৬। একাত্তুর স্মরনে, ডা বেলায়েত হুসাইন

৭। স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন, বেগম মুশতারী শফি

৮। নক্ষত্রের রাজারবাগ, মোশতাক আহমেদ

৯। লক্ষ প্রানের বিনিময়ে, মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম

১০। Pakistan Crisis, David Loshak

১১। তাজউদ্দিন আহমেদ নেতা ও পিতা; শারমিন আহমেদ

১২। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন, এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস, আর মির্জা

১৩। নিয়াজীর অত্মসমর্পনের দলিল, সিদ্দিক সালিক/ ভাষান্তর, মাসুদুল হক

১৪। একাত্তুরের জীবন যুদ্ধ, শামসুল ইসলাম সাইদ

১৫। The Last Days Of United Pakistan জি ডব্লিউ চৌধুরী

১৬। Bangladesh Unchained, গাজিউল হক

১৭। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল

১৮। HERBERT FELDMAN, The End And The Beginning

১৯। বিদ্রোহী মার্চ ১৯৭১, মেজর রফিকুল ইসলাম (অব) পি এস সি

২০। একাত্তর আমার; মোহম্মদ নুরুল কাদের

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জিঃ

২১। কর্নেল হুদা এবং আমার যুদ্ধ’ নীলুফার হুদা

২২। একাত্তুরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম

২৩। গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে, মাহবুব আলম

২৪। জনযুদ্ধের গনযোদ্ধা’, মেজর কামরুল ইসলাম ভুইয়া

২৫। একাত্তুরের গেরিলা, জহিরুল ইসলাম

২৬। একাত্তুরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা’, মেজর হামিদুল হোসেন তারেক, বীর বিক্রম

২৭। যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা, মেজর নাসিরউদ্দীন

২৮। স্বাধীনতা ৭১, কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম

২৯। একাত্তরের বীরযোদ্ধা, প্রথম খন্ড সম্পাদক মতিউর রহমান

৩০। মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস, মেজর এম, এস ভুইয়া

নাজমুল আহসান শেখ, সিডনী ১৯ নভেম্বর, victory1971@gmail.com


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment