হে ঈশ্বর তুমি ওদের বাংরেজ না করে বাঙ্গালী কর!
আমাদের সময়টা কি হারিয়ে গেল কালের গর্ভে। বিলীন হয়ে গেল রুপকথার মোড়কে মুড়ানোর মত আবেশ করা অনুভুতি গুলি। নুতন বইয়ের গন্ধ এক ঘোর লাগা অনুভুতি। স্বর্গ, মর্ত,পাতাল একটানে কোথায় ঘুড়িয়ে নিয়ে আসে মনে হয় কবে কোথায় এই অপার্থিব গন্ধের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ? এই গন্ধের টানে কি কেউ কখনও ঘর ছেড়ে ছিল? মনে এসে এসে ও মিলিয়ে যায় এ যেন সোনার হরিণ।কেবল পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায় ডাক দিয়ে যায় ইংগিতে। কিছুর সাথেই মিলানো যায় না যার হয় সেই শুধু বুঝে। বার বার জাগরনে ঘুমের আড়ালে প্রতিটি বই খুলে খুলে বিস্ময়ে মুগ্ধ হওয়া।
কেলেন্ডারের পাতা দিয়ে যত্ন করে মলাট লাগিয়ে গুটি গুটি অক্ষরে নিজের নাম ক্লাসের নাম, বিদ্যালয়ের নাম লিখা। পরম যত্নে নিজের সর্বচ্চ দিয়ে সুন্দর করে লিখার আপ্রান চেষ্টা। মা বলেছেন বই খুব যত্ন করে পড়তে । বই কখনও খুলা রেখে গেলে ভুতে পড়ে ফেলবে। তাহলে তার আর বিদ্যার্জন হবে না। তাই ভয়ে ভুল করেও বই খুলা রাখিনি কখনও ।এখনও রাখিনা। বইয়ের পাতা মুড়ানো যাবে না বই নষ্ট হয়ে যাবে। নুতন ক্লাসে উঠার পর বই গুলি বিনামুল্যে দান করতে হবে। বিদ্যা বিক্রি করা যাবে না। তা হলেও বিদ্যা দেবী মুখ ফিরিয়ে নিবেন। হাঁসের মাংস খাওয়া যাবে না । সরস্বতীর বাহন । তাহলে দেবী নাখোশ হবেন। সরস্বতী পুজার পরের দিন ১০৮ বার শ্রীশ্রী সরস্বতী নম লিখে ভোর বেলা জলে ভাসিয়ে আসতাম সবাই মিলে দল বেঁধে। তারপর পড়তে বসা। পড়ার টেবিল পরিস্কার রাখতে হবে। বইয়ের প্রতি এইযে আমাদের সময়ের ভালবাসা রক্তে মিশে গেছে।
সন্ধ্যা হলেই মায়ের হারমোনিয়াম নিয়ে বসা। মায়ের সাথে গান করা ।মায়ের প্রিয় গান এই করেছ ভালো নিঠুর এই করেছ ভালো ,নিঠুর হে, নিঠুর হে এই করেছ ভালো। এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো । মায়ের হাত ধরে একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথ কে চেনা। মুগ্ধ হয়ে মায়ের মুখে আবৃতি শুনা । ‘বীরপুরুষ ” মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দুরে । তুমি যাচ্ছ পাল্কিতে মা চড়ে দরজা একটুকু ফাঁক করে। শুনতে শুনতে চোখে জল । কখনও বা মায়ের মুখে আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিলে প্রাণের পর। অপার বিস্ময়ে চেয়ে থাকা মায়ের দিকে। ছোট থেকে মায়ের কি অক্লান্ত চেষ্টা আমাদের মানুষ করার। অতুলনীয় মা আমার । চোখের জলে লিখি আমি আমার মায়ের নাম। সেই যে শিশু মনে মা রবি ঠাকুর গেঁথে দিলেন আমাদের মনে। আজো আমারা ভাই বোনেরা মায়ের দেখানো পথেই হাঁটি।
আমাদের মায়েরা যেভাবে আমাদের গড়ে তুলেছেন আমরা কি পেরেছি আমাদের সন্তানদের একটা নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসাবে গড়তে । আমাদের বেরথ তা, না কি দিন বদলের সাথে আমাদের মানসিকতাএখন আর মানায় না । আমাদের সন্তানরা বাংলা গান শুনতে চায় না বাংলা বই পড়তে চায় না। ওরা পড়ে চেতন ভাগত, স্তিফেন মেয়ার ,ইংরেজি রাইটারের বই ।ওরা ও পড়ে নিজের মত করে আমার মত করে নয় । গান শুনে হিন্দি ইংলিশ। বাংলা শুনলে নাকি ঘুম আসে। আমার সন্তানদের বাংলা বিমুখ দেখে আমি বেদনায় নীল হই। আমার সন্তানদের এই অপূরণীয় শূন্যতায় আমার চোখে জল আসে। কতটা দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মালে ওরা বিরাট সাহিত্যের রত্ন ভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত হয়। হে ঈশ্বর তুমি আমার সন্তানদের সুমতি দেও। ওদের শিকড় মুখী কর। ওদের বাংলা মুখী কর। ওদের বাংরেজ না করে বাঙ্গালী কর। সব দেখে শুধু মাইকেল মধুসূদনকেই মনে করি……
হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন ,
তা সবে (অবোধ আমি)অবহেলা করি।
পর ধন-লোভে মত্ত ,করিনু ভ্রমন
পরদেশে ভিক্ষা বৃত্তি কুক্ষণে আচারি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।