হাউস ওয়াইফ

হাউস ওয়াইফ

করিম আলী’র ডুব সাঁতার: হাউস ওয়াইফ

[করিম আলী’র ডুব সাঁতার – আমার নামে লেখা হলেও, কথা গুলো আমার নয়। করিমের অনুরোধেই তাঁর কথা গুলো আমার নামে লেখা। দয়া করে কারো সাথে কোন মিল খোজার অপচেষ্টা করবেন না।]

হাউস ওয়াইফ (housewife) কে সরাসরি বাংলা করলে যা দাড়ায় তা হল “গৃহিনী” বা “গৃহ কর্ত্রী”। “গৃহিনী” বা “গৃহ কর্ত্রী” এমন একজন মহিলা, যিনি তাঁর প্রধান পেশা হিসেবে, তাঁর নিজের পরিবার পরিচালনার দ্বায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইংরেজি উইকিপিডিয়ার মতে – একজন গৃহিণীর প্রধান কাজ হল তাঁর পরিবারকে যত্নের সাথে পরিচালনা করা এবং বাচ্চাদের আচার আচরণ শিক্ষা, পরিবারের প্রয়োজনীয় নানান বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা। পরিবারের জন্যে যিনি রান্না থেকে শুরু করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, প্রয়োজন মাফিক দৈনন্দিন জিনিষ পত্র কেনা, সংরক্ষণ, পরিকল্পনা করেন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সংসারের দেখা শুনা করেন। গৃহিনী পদে সাধারণত পরিবারের বাইরের কাউকে দেয়া হয় না, বিবাহিত স্ত্রী’ই গৃহিণীর পদটি পেয়ে, পরিবারের দায়িত্বে থাকেন।

গৃহিনী, পেশা হিসাবে কেমন? আমার মতে, পেশা হিসাবে গৃহিনী অন্য যে কোন সম্মানী শীর্ষ পেশার চেয়ে কম নয় বরং চিন্তা, দক্ষতা, পরিচালনায় ক্ষেত্রে অপ্রতিদন্ধীয়। ভাবছেন কি ভাবে? আসুন একজন গৃহিনী পেশার দৈনন্দিন কাজের বিবরণ, দায়িত্ব, কর্তব্য বা সীমা রেখা খুঁজে দেখা যাক। একজন গৃহিনী হতে হলে কি কি বিশেষ যোগ্যতা বা দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে তাও একটু দেখি। যদিও এগুলোই একজন গৃহিণীর নিরেট মাপকাঠি নয়।

পেশা হিসেবে গৃহিনী একটি পূর্ণ সময়ের (full time) কাজ, অবিশ্বাস্য রকমের নিঃস্বার্থ হওয়ার সাথে সাথে প্রয়োজন, ধৈর্য, অধ্যবসায়, সামাজিক পারিবারিক অবস্থার উঠা নামার সাথে খাপ খাওয়ানো, যা সেরা পাছ, সর্বোচ্চ বেতনের পেশার চেয়েও বেশী দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে। একজন গৃহিণীকে হতে হয় পরিবারের

# প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
# শিক্ষক
# পরামর্শদাতা/মনোবিজ্ঞানী
# পাচক
# প্রাথমিক চিকিৎসক
# গাড়িচালক (প্রয়োজনে)
# গৃহস্হালী ব্যবস্থাপক/পরিচালক (গৃহস্হালী, লন্ড্রি, বাগান নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি)
# দীর্ঘ সময় (long hours) কাজ করায় অভিজ্ঞ
# আর্থিক টানা পোড়ন, দু:খ সুখের চির সাথী
# আরও অনেক কিছু

এই পেশায়, অন্য সকল পেশার মত নেই সাপ্তাহিক/বাৎসরিক ছুটি বা আর্থিক সুযোগ সুবিধা, না আছে বিশ্রাম নেবার মত পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা কিন্তু তার পরেও একজন গৃহিণীর থাকে পরিবারের প্রতি সারা জীবনের নিরলস প্রতিশ্রুতি। এমন মহান পেশা, পৃথিবীর কোথাও কি আছে?

আমার মতে ‘গৃহিনী’ পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত, সবচেয়ে কঠিন পেশা এবং বৈষয়িক টাকার অংক দিয়ে এ পেশার পারিশ্রমিক বিচার বা মূল্যায়ন একেবারেই অসম্ভব। আর একবার যদি এ পদটি কোন কারণে খালি হয় – প্রায় অসম্ভব পদটি পুনরায় পূরণ করা।

একটি পরিবার, একটি দেশের ক্ষুদ্র সংস্করণ এবং একজন গৃহিনী’ই সেই পরিবারের পরিচালক কর্ণধার।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মেয়ে শিক্ষার হার ৭০ থেকে ৮৫%, যা পুরুষ শিক্ষার তুলনায় ৫ থেকে ২০% বেশি। বাংলাদেশ অনেক ভাগ্যবান এই জন্যে যে অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এ দেশের মেয়ে শিক্ষার হার তুলনামূলক বেশি। নেপোলিয়ন বলেছিলেন – তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।

কমপক্ষে ৭০% শিক্ষিত মা আমরা পেয়েছি বাংলাদেশে। আমরা কি সে তুলনায় শিক্ষিত একটি জাতি পেয়েছি? যদি উত্তর “হা” হয়, তা হলে সে জাতি আজ কোথায়? আর যদি “না” হয় উত্তর, তবে প্রশ্ন – কেন পাইনি? আমাদের সমাজে এমন সামাজিক মানবিক অবক্ষয় কেন? কোথায় আমাদের শিক্ষিত মায়েরা?(প্রশ্ন গুলো মা’দের দায়ী করে নয়, অনেক কারণের একটি কারণকে প্রশ্ন করা মাত্র)

আমার মনে হয় নেপোলিয়ন শিক্ষিত মা বলতে শিক্ষিত (full time) গৃহিণীকে বুঝিয়েছিলেন।

এক মায়ের কোলে পিঠে বেড়ে উঠা যুবক ছেলে, পূর্ণের নামে নিজের মাকেই খুন করেছে নির্দ্বিধায়। আত্মতৃপ্তিতে ধরা না পড়া পর্যন্ত করেছে স্বাভাবিক জীবন যাপন। এক যুবতী মেয়ে বন্ধুদের সাথে করে খুন করেছে নিজ মা, বাবাকে। তাঁদের অপরাধ? অপরাধ, মেয়েকে বহির্মুখী হতে নিষেধ করেছে। এক যুবতী স্ত্রী পরকীয়া প্রেমিক কে খুন করার পরেও ছিল স্বাভাবিক। খুন করা যে বেশ বড় অপরাধ এই ধারনা টুকুই তার ছিল না। এই হল আমাদের সমাজ, আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থার মানসিক স্থির চিত্র।

আমাদের অনেক শিক্ষিত মায়েরা আজকাল “গৃহিনী” একটা পেশা, এটা কোন ভাবেই মেনে নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন,এটা পুরুষ শাসিত সমাজের চেপে দেয়া, আরোপিত বাড়িয়ে বলা পেশা, পক্ষান্তরে শিক্ষিত মায়েদের পায়ে সেঁকল দেয়ার গোপন ষড়যন্ত্র। পেশা হবে, ন’টা পাঁচ’টা অফিস, পেশাদারী পোশাক আশাক, সাপ্তাহিক, বাৎসরিক ছুটি, বিশ্রাম। “গৃহিনী”? তা আসতে পারে সমসাময়িক গৌণ ভূমিকায় (secondary), কোন ভাবেই মুল পেশা হিসেবে নয়। আমাদের সমাজে আজকাল অনেকেই নিজেকে “গৃহিনী” ভাবতে লজ্জা বোধ করেন। কেউ কেউ আবার ভীষণ বিষণ্ণতায়ও ভোগেন এ নিয়ে।

আপনি কি আপনার শিক্ষিত মা, দাদি/নানী বা তাদের মা, বোনদের কথা কখনো ভেবেছেন? ভেবেছেন তাঁদের জীবন ত্যাগী অবদানের কথা? উনারা যদি “গৃহিনী” না হতেন, কি হতো তাঁদের পারিবারিক অবস্থার, সংসারের? ধারাবাহিক ভাবে আপনার?

আমি আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করি যদি আমরা একজন গৃহিণীর সম্মান, মূল্যবোধকে সঠিক ভাবে ফিরিয়ে আনতে পারি, তবে কোন অবক্ষয়ই কোন সমাজকে একক ভাবে গ্রাস করতে পারবে না। পেশা হিসেবে গৃহিনী, সৃষ্টিকর্তার সেরা উপহার মেয়েদের জন্যে। স্বভাব সুলভ কারণেই যে কোন ছেলের যোগ্যতার অনেক বাইরে এই পেশা।

পরিশেষে, এটুকুই বলতে পারি, গৃহিনী (housewife) একটি মহা মূল্যবান স্থায়ী (full time) পেশা। এ পেশাকে স্বল্প সময়ের (part time) পেশা হিসাবে নিয়ে সফলতার পাবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। দেশ, সমাজ, পরিবার’কে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে হলে আমাদের শিক্ষিত মায়েদের দৃষ্টি ভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।

শিশুর জন্যে যেমন মায়ের বুকের দুধের কোন বিকল্প নেই, তেমনি একটি বিবেকবান জাতির জন্যে, একজন শিক্ষিত গৃহিণীর কোন বিকল্প নেই।

করিম আলি
০৪ মার্চ ২০১৪


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment