স্মৃতি হারিয়ে ফেলার কষ্ট

স্মৃতি হারিয়ে ফেলার কষ্ট

দীর্ঘ ২৮ বছর পর মাটির টানে গিয়েছিলাম নিজের গ্রামে । মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে মাটির গন্ধ নিব বলে । কিন্তু গ্রামে যেয়ে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। গ্রামে যে শহরের গন্ধ লেগে আছে।গাড়ি এখন আমাদের বাড়ির দরজায় চলে যায় । বাড়িতে ঢোকার পথেই সুন্দর একটা একতলা বাড়ি দেখে আমি মুগ্ধ। আমার জেঠতুত ভাইকে বলছি দেখছিস বাড়িটা কি সুন্দর বানিয়েছে? ও মুচকি মুচকি হেসে বলে আসলেই সুন্দর । নুতন বাড়িটার সামনে দিয়েই আমাদের আসল বাড়িতে যেতে হয়। নুতন বাড়িটার সামনে আসতেই দেখি আমার একমাত্র পিসি দরজায় দাঁড়িয়ে। আমার বাবারা আবার আট ভাই। পিসির এই বাড়ি দেখে আমি আরেক দফা টাস্কিত।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল । মিশ্র অনুভুতি । শহরের বাড়ির আমেজে গ্রামের নয়ন ভুলানো দৃশ্য। সবুজের সমারোহ , পুকুরে হাঁসেদের জলকেলি, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কচুরি ফুলের বেগুনী রঙয়ের বিশাল বিছানা। মনে হয় এক্ষনি ঘুমিয়ে পড়ি ফুলের উপর গা এলিয়ে।

দূরে বটগাছ টা শুধু আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে সব কিছু পাল্টে যাওয়ার নিরব সাক্ষী হয়ে। আগের মানুষ গুলি অনেকেই দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে । আমাদের পারিবারিক শ্মশানেই দীর্ঘ একটা লাইন। দাদু,ঠাকুরমা,বাবা,মা,জেঠু , বড় কাকু সবাই ঘুমিয়ে আছে পাশাপাশি। হয়ত ওদের কথা হয়। দেখা হয় আমরা দেখতে পারি না। সব কিছু ভেবে দেখে দুচোখ ভরে জল এলো। আমারা সবাই একদিন ঘুমিয়ে যাব আর জাগব না। ফিরব না আর মান ,অভিমান,সুখ,দুক্ষের এই ভুবনে।

সব কিছু পাল্টে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা, ঘরবাড়ি, পরিবেশ, রাস্তা ঘাট সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমার দেখা সেই হারিকেনের মৃদু আলোর আলো আঁধারির গ্রাম টা এখন বিদ্যুৎ এর আলোতে রাত্রিতেও ঝলমল করে উঠে। চারিদিকে এতো আলো গ্রামের ভূত গুলি কোথায় গেছে কে জানে? ভুতেদের জন্য আমার একটু মায়া লাগলো ওরা থাকবে কোথায় ? ওদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন । বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ওদের আরও যুদ্ধ করতে হবে। করতে হবে সভা, সমাবেশ, হরতাল, মিটিং ।ওদের পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে।

সকাল হলে গ্রামের মেয়েরা স্কুল ড্রেস পড়ে বেণী দুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। যাদের পূর্ব পুরুষের ছেলেরা স্কুলে যাওয়া তো দুরের কথা অ, আ, পড়ে নাই। গ্রামের বউরা আবার পার্লারেও যায় ফেসিয়াল করতে। কোন কোন মেয়ে বা বউ চুলে হাইলাইট ও করিয়েছে। আমার তো মুগ্ধ হতে হতে মুগ্ধতার শর্ট পড়ে গেল । প্রতিটি বাড়িতে টেলিভিশন । মোবাইল তো পান্তাভাত। অবশ্য গ্রামের মানুষ এখন সকালে উঠে আর এক থাল পান্তা ভাত খায় না । সকালে ওরা রুটি ,ভাজি, ডিম খায়। এক বাড়িতে বেড়াতে গেলাম ,আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি ঘরে এয়ার ফ্রেসনার স্প্রে করে দিল। চা দেওয়ার পর টিসু বক্স এগিয়ে দিল । আমার তো আর একটু হলে আনন্দে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত। আসলে আমি চিরটাকাল বোকাই রয়ে গেলাম । বুকের ভিতর আমার দেখা ২৮ বছর আগের সহজ সরল গ্রামের ছবিটাই খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। চেনা জায়গাটা হারিয়ে গেছে দেখে কষ্ট পাচ্ছিলাম । এ এক অন্য রকম কষ্ট স্মৃতি হারিয়ে ফেলার কষ্ট।সব কিছু বদলে যাওয়ার হাহাকার। আসলে কিছু জিনিষ নিজের মত করে রেখে দিতে হয় আজীবন । পিছন ফিরে দেখতে হয় না। তাই আমি শুধু পায়ে পায়ে হোঁচট খাচ্ছিলাম উন্নয়নের জোয়ার দেখে। সত্যি গ্রামগুলি এখন অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে রুপান্তরিত হয়েছে। একসময় গ্রাম “ঠাকুরমার ঝুলি”গল্পের বই তে ও ইতিহাসে জায়গা করে নিবে। গ্রাম দেখতে জাদুঘরে যাবে আগামী কালের শিশুরা । স্বপ্নের মত মনে হলেও সত্যি হল সেইদিন আর বেশী দূরে নয়।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment