সম্প্রচার নীতিমালাঃ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সরকারের করণীয়

সম্প্রচার নীতিমালাঃ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সরকারের করণীয়

সরকার যেসময়ে, যেকারনে, যে অবস্থায় এ নাজুক সম্প্রচার নীতিমালার বিষয়টি নিয়ে এগুচ্ছে এতে করে স্পষ্টতঃই গণমাধ্যমের সাথে সরকারের সংঘাত সৃষ্টির আশংকা রয়েছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো থেকে সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে বর্তমান সরকারের মনোভাব ফুটে উঠেছে। এ সম্প্রচার নীতিমালাটি গত ৪ঠা আগষ্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত হয়েছে । ওখানে সম্প্রচারে যাতে কোন বিভ্রান্তি, বিদ্বেষ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি না হয়, এবং সশস্ত্র বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, অথবা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ায়, এমনসব বিষয় প্রচার না করা হয়, এর উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে টেলিভিশন ও রেডিওর জন্য একটি নীতিমালা অনুমোদন করেছে সরকার।

তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার বৈঠকে দ্রুত আইন প্রণয়ন করে একটি কমিশন গঠন করতে ও নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রচার নীতিমালা মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বিএনপি তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, সুধীমহল এ বিষয়ে সতর্ক পর্যবেক্ষণে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ হবে না এ মর্মে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে! এ নীতিমালার আওতায় একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়েছে, যা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয় ওই দায়িত্ব পালন করবে।

সরকারের অবস্থান এব্যাপারে খুবই স্পষ্ট যেখানে বলা হয়েছে কোনো জনগোষ্ঠী বা জাতির জন্য ক্ষতিকর কোন দৃশ্য প্রচার করা যাবে না, বিদ্রোহ, নৈরাজ্য, হিংসাত্মক ঘটনা দেখানো হলে তা এমনভাবে প্রচার করতে হবে, যাতে কেউ তাতে উৎসাহিত না হয়, এছাড়াও এমন কিছু প্রচার করা যাবে না, যাতে দুনীতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত হয়। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৪’ এর গেজেট প্রকাশ এর পর আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে। তথ্যানুযায়ী দেশে বর্তমানে অনুমোদিত বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলের সংখ্যা ৪১ এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় তিনটি ও বেসরকারি ২৩টি টিভি চ্যানেল সম্প্রচারে রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সাম্প্রতিক ভাষ্য অনুযায়ী এ নীতিমালাটি তৈরিতে বিবিসির অনুসৃত নীতিমালাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে- বিবিসির দীর্ঘ দিনের স্বাধীন দায়িত্বশীল সম্প্রচারের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। এ কমিশন গঠন হওয়ার পর এর কোড অব গাইডেন্স তৈরি করা হবে এবং সেখানে এবিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে। আইন হওয়ার পর এই কমিশনের চেয়ারম্যান ও আইনের দ্বারা নির্ধারিত সদস্য নিয়োগ করা হবে এবং সার্চ কমিটির মাধ্যমে একটি কমিশন গঠন করা হবে। সদস্যদের মধ্যে সিনিয়র সাংবাদিক, সম্প্রচার মাধ্যমের ব্যক্তিত্ব ও বিশেষজ্ঞসহ অন্যান্যরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। এ বিষয়টি নিয়ে আবেগ প্রবনতা বিবর্জিত হয়ে একাডেমিক আলোচনার স্বার্থে কানাডার মতো উন্নত একটি দেশের সরকারের কমিউনিকেশনস নীতিমালার আলোকে বিষয়টির আলোচনা করা যৌক্তিক।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল নামে ১৯৭৯ সালে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্য নিয়ে এবং সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার মান উন্নয়নে একটি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে. কাউন্সিল এর – বিচার বিভাগীয় শরীর ও প্রেস কাউন্সিল আইন রয়েছে । কিন্তু তা সত্বে ও একজন সন্মানিত বিচারপতির নেতৃত্ব পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটিকে দীর্ঘদিন যাবত অকার্য্যকর করে রাখা হয়েছে। সেখানে ‘কার্যকর’একটি সম্প্রচার কমিশন আশা করা কতটা সঙ্গত? বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক প্রক্ষাপটে। তাই এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠা খুবই স্বাভাবিক। আবার যখন প্রশ্নগুলো উস্কে দেন খোদ কোন মন্ত্রী মহোদয়, যাদেরকে কোন সভ্য দেশে সরকারের মুখপাত্র হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তাদের প্রতিটি কাজ, এমনকি প্রতিটি শব্দ প্রয়োগের ও জবাবদিহিতা রয়েছে। জবাবদিহিতা রয়েছে সরকার এবং জনগন উভয়ের কাছে।

সরকার যে সম্প্রচার নীতি গ্রহণ করেছে, এর আলোকে আইন প্রণীত হবে সম্প্রচারের বিষয়ে বিভ্রান্তি, বিদ্বেষ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি সহ যেসকল বিষয়ের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে প্রচলিত আইনেই এগুলোর সুষ্পষ্ট প্রতিকার রয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন যেন না হয়, অথবা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ না ছড়ায়, এমনসব বিষয় প্রচার এর উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে টেলিভিশন ও রেডিওর জন্য একটি খড়গ তৈরী করা হয়েছে মাত্র।

নিরপেক্ষভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে সরকার ও বিরোধীদল উভয়ের কিছু নেতা-নেত্রীর বক্তব্য, বাকবিতন্ডা, আক্রমন, পাল্টা আক্রমন এগুলো কি গণমাধ্যমে সম্প্রচারযোগ্য? এ নিয়ে জনগণ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে? এটা হলফ করে বলা যায় যে আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য সংঘাতপূর্ণ, বিদ্বেষমূলক, ও নৈরাজ্যকর এক অবস্থা সৃষ্টির সকল উপাদান আমরাই তাদের মনন ও কৃষ্টিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। যার নৈতিক দায়ভার কেউই এড়াতে পারবে না এবং এর ভবিষ্যৎ পরিণতি হবে ভয়ংকর।

দেশে সরকারের জন্য সর্বাগ্র প্রয়োজন একটি কমিউনিকেশনস নীতিমালা যেখানে সরকারের কর্মসূচী, পরিষেবা এবং উদ্যোগ সম্পর্কে সময়োপযোগী, সঠিক, স্পষ্ট, ও উদ্দেশ্য সম্বলিত এবং সম্পূর্ণ তথ্য জনগণকে জানান দেয়ার বাধ্যবাদকতা থাকবে, সংসদীয় গণতন্ত্র এবং সরকারের দায়ীত্বশীলতা, পদ্ধতি, সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা, এবং দেশের জন্য তার অগ্রাধিকার জনগণকে অবহিত করার দায়িত্ব এর বর্ণনা থাকবে. তথা বাংলাদেশীদের জন্য প্রয়োজনীয় – পৃথকভাবে বা প্রতিনিধি দল বা সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে – গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ও অর্থপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের অঙ্গীকার এবং কর্মসূচি থাকবে. থাকবে সরকারের সকল কর্মসূচী এবং পরিষেবায় প্রবেশাধিকার, থাকবে জনগণের অবাধ তথ্যের অধিকার।

থাকবে মতবিনিময়. অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগে মাতৃভাষা বাংলার পূর্ণ স্বীকৃতি এবং এর ব্যবহার। সকল সরকারী প্রতিষ্ঠান এ দৃশ্যমান প্রবেশাধিকার এবং পরিষেবা পরিবেশন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে. সরকারের প্রতিষ্ঠান যেখানেই থাকুক তাতে প্রবেশাধিকার ও দায়বদ্ধতা থাকবে । সরকার ও এর সকল প্রতিষ্ঠান, দৃশ্যমান এবং স্বীকৃত হতে হবে. এর কর্মসূচী, পরিষেবা সনাক্তকারী হবে জনগণ, এবং তার কার্যক্রম মূল্যায়ণ করা হবে সম্ভব্য অনেক যোগাযোগ চ্যানেলের মাধ্যমে – সেবা কেন্দ্র থেকে, টেলিফোন, প্রিন্ট ও ব্রডকাস্ট মিডিয়া, ই- মেইল, ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব – সরকার ও পাবলিক সব পরিস্থিতিতে সনাক্ত করতে পারে এমন একটি স্বতন্ত্র, সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রয়োজন. যোগাযোগের সমস্ত উপায় যেমন- প্রথাগত পদ্ধতি থেকে নতুন প্রযুক্তিতে উন্নীত করার পর্যায় – এ পৌঁছানো এবং তা রক্ষিত হতে পারে । যেখানে বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগের জন্য যা ব্যবহার করা আবশ্যক. আধুনিক সরকার ২৪ ঘন্টা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ পরিবেশে একাধিক চ্যানেলের মাধ্যমে কার্যকরভাবে সাড়া প্রদানের ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিবে. সরকার একটি কার্যকর অংশীদারিত্বের উপর নির্ভর করে সার্বজনীন, এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদানের পেশাদারী সরঞ্জাম ও সম্পদ ব্যবহার এবং কার্যকর, জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনা নেয়া প্রয়োজন. অভ্যন্তরীণ ও বর্হি যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তাকে চিহ্নিত করে পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা বা নীতি, কর্মসূচি, পরিষেবা বা উদ্যোগ পর্যালোচনা পূর্বক পূরণ করা আবশ্যক. করদাতা ও বিনিয়োগের জন্য সর্বোচ্চমান প্রাপ্ত পাবলিক তহবিলের ব্যবহারের সব যোগাযোগ কর্মকান্ডে মৌলিক প্রয়োজন.

জনগণের পরামর্শ গ্রহণ, অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ জনগণের স্বার্থে উন্নয়নশীল, কর্মসূচির পরিকল্পনা এবং পরিষেবা বাড়ানো এবং নাগরিকদের সাথে যোগাযোগের জন্য সরকারের বাধ্যবাধকতা মোকাবেলায় নাগরিকদের অধিকারের সঙ্গে সহগামী হয় এবং তাদের সাথে সরকার কর্তৃক নানাবিধ শুনানি হবে. গণতন্ত্র এ, পাবলিককে শোনা ও এর উপর গবেষণা, মূল্যায়ন এবং নাগরিকদের চাহিদা মোকাবেলা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ. সরকার জনগণের চাহিদা ও কার্যকরভাবে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী যতটা সম্ভব সাড়া দেবে. নাগরিক ও সরকারের মধ্যে সংলাপ হবে, একটানা খোলা, প্রাসঙ্গিক, পরিষ্কার, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য! যোগাযোগ প্রক্রিয়া থাকবে, যা হবে দ্বিপথ প্রক্রিয়া. তা যেন কোন সংবেদনশীল নীতিমালার নামে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন না করে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের যেকোন প্রচেষ্টা হবে আত্মঘাত মূলক। উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারের জন্য একটি যোগাযোগ নীতিমালা প্রণয়ন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

লেখকঃ দেলোয়ার জাহিদ, সভাপতি, বাংলাদেশ প্রেসক্লাব অব আলবার্টা ও সম্পাদক, সমাজকন্ঠ, কানাডা।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment