মার্কিন বিভ্রমের খপ্পরে অস্ট্রেলিয়া

মার্কিন বিভ্রমের খপ্পরে অস্ট্রেলিয়া

ভালো হোক বা মন্দ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি দুনিয়ার অন্যান্য জায়গায় অনুসরণের একটি চল আছে। তা সেটা প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক। অস্ট্রেলিয়ার নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবটের সরকারও সম্প্রতি সে রকম একটি নজির স্থাপন করেছে।

পৃথিবীর নানা দেশের মতো রক্ষণশীল সরকারগুলো সরকারি ব্যয় কমানোর ওপর জোর দিচ্ছে। কারণ হচ্ছে, আর্থিক ঘাটতি নাকি তাদের ভবিষ্যতের ওপর কালো ছায়া ফেলছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের ক্ষেত্রে এটার কোনো বাস্তবতা নেই, তবু এই অ্যাবট সরকার মার্কিন এই নীতি আমদানির জন্য মুখিয়ে আছে।

এখন কথা হচ্ছে, কেউ যদি হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ কারমেন রেইনহার্ট এবং কেনেথ রগঅফের তত্ত্ব মেনেও নেন যে সরকারি ঋণ বেশি থাকলে প্রবৃদ্ধি কমে যায়, তাহলেও অস্ট্রেলিয়ার এই পথে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তদুপরি, এই তত্ত্ব এখনো প্রমাণিত নয় এবং বাজারে এটা সমালোচিতও বটে। অস্ট্রেলিয়ার ঋণ/জিডিপির অনুপাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভগ্নাংশেরও কম। আর ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তা সর্বনিম্ন।

দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ একটি বড় চিন্তার বিষয়। এর মধ্যে জনগণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগও রয়েছে: শিক্ষা, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো। এ ধরনের বিনিয়োগে সর্বস্তরের জনগণের প্রতিভা বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়।

মার্কিন নীতির আদলে অ্যাবটের সরকারের প্রস্তাবিত ‘সংস্কার’-এ কিছু বৈপরীত্য রয়েছে। সর্বোপরি, মার্কিন নীতি সে দেশের অধিকাংশ জনগণের কোনো কাজে আসছে না। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য আয়ের মানুষের আয় ২৫ বছর আগের তুলনায় কমে গেছে। তার মানে এই নয় যে উৎপাদনশীলতা এক জায়গায় এসে থমকে গেছে, বরং এটা হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মজুরি না বাড়া।

অস্ট্রেলীয় মডেল অনেক কার্যকর। বাস্তবে পণ্যনির্ভর অর্থনীতিগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াই অন্যতম দেশ, যার প্রাকৃতিক সম্পদের কোনো ঘাটতি নেই। সে দেশের সমৃদ্ধির ভাগীদার অনেকেই। গত এক দশকে সে দেশের মধ্য আয়ের মানুষের বার্ষিক আয় বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশেরও বেশি। ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় তা প্রায় দ্বিগুণ।

তবে অস্ট্রেলিয়ার যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তাতে সেখানকার জনগণের আয়ের বৈষম্য আরও কম হওয়া উচিত। প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ, আর এই সম্পদ থেকে যে ‘ভাড়া’ আসে তা সে দেশের অসমতা কমাতে ব্যবহার করা উচিত। আর প্রাকৃতিক সম্পদের ভাড়ার ওপর উচ্চ হারের কর বসানো সঞ্চয় ও কাজের ওপর কর বসানোর মতো নয় (কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে লোহার আকরিক ও প্রাকৃতিক গ্যাস এক দেশ থেকে আরেক দেশে নেওয়া যায় না)। কিন্তু অসমতা পরিমাপক গিনি কো-এফিসিয়েন্ট-এর বিচারে অস্ট্রেলিয়ায় অসমতার অবস্থা নরওয়ের চেয়ে তিন গুণ খারাপ। নরওয়ে তার সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অনেকাংশে গণতান্ত্রিক, দেশের বেশির ভাগ মানুষ সেখানকার সম্পদের সুবিধাভোগী।

অনেকেই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কী ঘটছে অ্যাবটের সরকার সে বিষয়ে আসলেই অবগত কি না? তিনি কি জানেন, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০-এর দশকে নিয়মনীতি শিথিল ও উদারীকরণ শুরু হলে দেশটির প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করে? আর যেটুকু প্রবৃদ্ধি হয়, তার সুফল সমাজের উচ্চকোটির অল্প কিছু মানুষের ঘরেই পৌঁছায়। তিনি কি জানেন, এই ‘সংস্কার’ শুরু হওয়ার আগে ৫০ বছর যুক্তরাষ্ট্রে কোনো আর্থিক সংকট ছিল না। অথচ সারা দুনিয়ায়ই এটা এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই শিথিলকরণের ফলে সে দেশের আর্থিক খাত ফুলে–ফেঁপে ওঠে। বহু প্রতিভাবান তরুণ এই আর্থিক খাতের প্রতি আকৃষ্ট হন, অন্যথায় তাঁরা এর চেয়ে অনেক উৎপাদনশীল কাজে নিজেদের সৃজনশীলতা ও শক্তি নিয়োগ করতে পারতেন। আর্থিক খাতে তাঁরা নিত্যনতুন উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন, এতে তাঁরা ব্যাপক টাকা বানাতে পেরেছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ও বৈশ্বিক অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার সরকারি সেবার ব্যাপারে দুনিয়ার অনেক দেশই ঈর্ষাকাতর। এর স্বাস্থ্যসেবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো, খরচও সামান্য। সেখানে আয়নির্ভর শিক্ষাঋণ-সুবিধা রয়েছে।এতে ঋণগ্রহীতারা দীর্ঘ সময় ধরে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারে। আর তাদের আয় যদি খুবই কমে যায় (তারা সাধারণত নিম্ন বেতনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ বেছে নেয়, যেমন শিক্ষা ও ধর্মীয় খাতে), তাহলে সরকার ক্ষেত্রবিশেষে ঋণ মওকুফও করে দেয়।

দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তফাত চোখধাঁধানো। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ছাত্রদের ঋণের পরিমাণ ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি, যেটা ক্রেডিট কার্ডের সম্মিলিত ঋণকেও ছাড়িয়ে গেছে। এটা যেমন ছাত্রদের জন্য, তেমনি মার্কিন অর্থনীতির জন্যও বোঝা হয়ে উঠছে। উচ্চশিক্ষায় মার্কিন মডেল ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের ক্ষেত্রে সমসুযোগ সবচেয়ে কম। সে দেশের তরুণেরা তাদের বাবা-মায়ের আয় ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, অন্য যেকোনো উন্নত দেশের তুলনায়।

অ্যাবটের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত ধারণা থেকে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সফলতার কারণ সম্পর্কে তাঁর বোঝাপড়া নেই বললেই চলে। প্রতিযোগিতামূলক ফি বা মুনাফামুখিনতার কারণে হার্ভার্ড, ইয়েল বা স্ট্যানফোর্ডের প্রতিষ্ঠানগুলো মহান বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়নি। সেখানকার এই মহান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনোটিই মুনাফামুখী নয়। সেগুলো সবই অলাভজনক, এগুলো চলে সরকারি অনুদানে বা বৃত্তিতে বা প্রাক্তন ছাত্রদের ও ফাউন্ডেশনগুলোর অর্থানুকূল্যে।

এখানে ভিন্ন ধরনের এক প্রতিযোগিতা আছে। তারা অন্তর্ভুক্তি ও বৈচিত্র্য অর্জনের প্রয়াস পায়। তারা গবেষণায় সরকারি বরাদ্দের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যুক্তরাষ্ট্রের লাভজনক ও স্বল্প নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুই ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জন করেছে: দরিদ্র পরিবার থেকে আসা তরুণদের শোষণ করা, কোনো মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত না করেই অতি উচ্চ ফি ধার্য করা, সরকারি অর্থপ্রাপ্তির জন্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা এবং শোষণের সংস্কৃতি বজায় রাখা।

অস্ট্রেলিয়া যে সফলতা লাভ করেছে তার জন্য দেশটি গর্ব করতেই পারে। দুনিয়ার অন্যদেরও উচিত, তার কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুল পাঠ ও আদর্শের কড়া মিশেল ঘটিয়ে সেখানকার নেতৃত্ব যদি এমন কোনো রোগের চিকিৎসা করতে নেমে যান, যার কোনো অস্তিত্বই নেই, তাহলে সেটা চরম লজ্জারই বিষয় হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।

সুত্রঃ প্রথম আলো


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment