বইপড়া ও আমার প্রান্তিক জীবন

বইপড়া ও আমার প্রান্তিক জীবন

শিকড় মানেই তো এক প্রান্ত। তবু এই প্রান্তিক শিকড়ই জীবনকে খোরাক জোগায় ও সমৃদ্ধ করে।
১৯৭৯ সালের শরৎকাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে লেখাপড়া করে আমি এসেছি যুক্তরাষ্ট্রের অরেগনের ইউজিন শহরে। চোখে আমার রসায়ন আর জীববিজ্ঞানের মিশ্রণে তৈরি সেই কালের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় মলিকুলার বায়োলজির স্বপ্ন। আমি ছেড়ে এসেছি আমার গ্রামভিত্তিক প্রান্তিক জীবন, যার প্রকৃতির মূর্ছনায়ই সেই স্বপ্নের শুরু। ইউজিন ও সন্নিহিত এলাকাজুড়ে হেমন্তের বিষণ্ন রং ছড়িয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যে ফিকে সবুজ ডগলাস, ফার ও পাইন। বহু জীবন ছেনে জটিল হয়ে ওঠার বহু আগে তারুণ্যের একরাশ স্বপ্ন ও উচ্চাশায় ঘেরা আমার সেই জীবন। প্রান্তিকতা ছেড়ে কেন্দ্রবর্তী বিশাল জীবনের আয়োজনে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা। শরৎ ও শীতের মাঝামাঝি সন্ধ্যায় এই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটল, আমি দেখা পেলাম লাইনাস পলিংয়ের।

লাইনাস পলিং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন। দুবার নোবেল বিজয়ের বিরল সম্মানে ভূষিত ও মলিউকুলার বায়োলজির আদিগুরু। ক্যালটেকে তাঁর সাহচর্যে এই পুরো বিজ্ঞানের নির্মাতা হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ম্যাক্স ডেল ব্রুক। আর অরেগনের এই সন্ধ্যায় যে প্রোগ্রামে নতুন ছাত্র হিসেবে আমি আমন্ত্রিত, সেই করেভালিস শহর তাঁর জন্মভূমি। অতি ক্ষুদ্র, অতি প্রান্তিক, করেভালিস। সেই সন্ধ্যায় তাঁর গুণমুগ্ধ ব্যক্তিদের ভিড়ে লাইনাস তাঁর সেই শৈশব জীবনের স্মৃতিচারণা করলেন। গরীব ঘরে তাঁর জন্ম। বাড়িতে তেমন সাংস্কৃতিক কিংবা লেখাপড়ার পরিবেশ ছিল না। তবু অতিসত্বর বালক লাইনাস ক্ষুদ্র করেভালিসের লাইব্রেরির প্রতিটি বই পড়ে ফেলেন এবং বাবার কাছে বায়না ধরেন নিত্যনতুন বইয়ের। সেই ছোট্ট শহরে থেকেও শুধু বই পড়ার কারণে লাইনাস হয়ে ওঠেন ভিন্নতর একজন। বিজ্ঞান, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি এমনকি রাজনীতি। পুস্তক থেকে পুস্তক, এক পৃথিবী ছেড়ে আরেকটা।
এভাবে জীবনের দূরত্ব ও প্রান্তিকতা ছাপিয়ে লাইনাসের ক্রমাগত মধ্যমণি হয়ে ওঠা। হেমন্তের সেই সন্ধ্যায় ব্যাপারটা আমাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল।

আমি অতিক্ষুদ্র একজন। কিন্তু বিশাল কিছুটা হলেও বোধকরি ক্ষুদ্রকে বদলে দিতে পারে। বিশালের সম্মুখীন হলে ক্ষুদ্রের মধ্যে জাগে বিশাল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আর এই আকাঙ্ক্ষারও শক্তি অনেক। আমি পরবর্তী বছরগুলো লাইনাস পলিংয়ের কথা মনে রাখার চেষ্টা করেছি ও তাঁর বালক বয়সের সীমাহীন উৎসাহের কথা মনে রেখে কিঞ্চিত হলেও উদ্যমী হওয়ার চেষ্টা করেছি।

আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মূলত পাড়াগাঁয়ে প্রাচীন জনপদ কানিহাটিতে। পঞ্চাশের দশকে যখন পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত গ্রামীণ ভূস্বামী, জোতদার, বড় গেরস্থ প্রভৃতি মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন, আমার বাবা গ্রামকে কর্মক্ষেত্র রেখেই তখন তাঁর কাজ করছিলেন। যদিও আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র, তবু সেই কাজ তিনি করতেন গ্রামে বসেই। আমার নিজের জীবন তাই সেভাবেই শুরু হয়েছিল। ঋতুর আনাগোনা, গ্রামীণ সহজ ও দরিদ্র জীবন, বিদ্যুৎ ও চলৎশক্তিশালী পানি (মানে বেসিনের পানি বা রানিং ওয়াটার) এগুলো ছাড়াই আমরা বড় হয়েছিলাম। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র গ্রামের, প্রান্তিক এলাকার শিক্ষকেরা তখন আমাদের শিখিয়েছিলেন সারা বিশ্বের খবর, ব্রতচারী ভাবধারার শিক্ষকেরা কিংবা সুফি মতবাদের প্রাচীন ধারার গুণীজন তাঁরা আমাদের গোটা ব্রহ্মাণ্ডের নিয়মনীতি শিক্ষা দিয়েছিলেন।

পাশের মহকুমা শহর মৌলভীবাজারের পাবলিক লাইব্রেরির ঠাসবুনুনি বইয়ের ভেতর খুঁজে পেয়েছিলাম বৃহত্তর এক জীবনকে, যা বাইরের অনগ্রসর জীবনকে ছাপিয়ে উঠেছিল। বাইরের অনগ্রসর প্রতিক্রিয়াশীল জীবন সেই যুগেও বাইরে পুকুরের পাড়ে স্থাপিত শেক্সপিয়ারের মূর্তির নাক ভেঙে দিয়েছিল। সাত্তার সাহেব নামের একজন শিক্ষাবৎসল মহকুমা হাকিম এই মূর্তিটা লাইব্রেরির পুকুরের পাড়ে স্থাপন করেছিলেন। সাত্তার সাহেবের উদ্দেশে বলতে পারি, সেই ভাঙা নাকের শেক্সপিয়ারও ছিলেন আমাদের জন্য এক প্রেরণা। শিক্ষার ইচ্ছা ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নিরন্তর যে লড়াই তা এখনো চলছে, চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনে, শুনেছি তাতে যুক্ত এমনকি বিজ্ঞানের শিক্ষকেরাও। এত যুগ পেরিয়ে গেল, ভাস্কর্যের শিল্পিত ধারণা শিখতে কেউ কেউ এখনো অপারগ।

২০০২ সালে আমার বাইরের জীবনের কাজ অনেকটা কমিয়ে দিয়ে যখন গ্রামে ফিরে এলাম, তখন পৃথিবী অনেক বদলেছে, কিন্তু কোনো কোনো ব্যাপার একেবারেই বদলায়নি।

সারা দেশে তখন অনেক দালানকোঠা। বড়লোকদের ব্যাংকের টাকা হাজার কোটির ঘরে। শুনে রক্ত শীতল হয়ে যাওয়ার মতো টাকার অঙ্ক। কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও উচ্চবিদ্যালয়ে অধিকাংশ ছাত্র অভুক্ত। আমাদের কালে যেমন বিদ্যালয়ে টিফিন দেওয়া হতো, সেটা আর এখন নেই। আমি নিজে হেঁটে হেঁটে মাইলের পর মাইল গ্রামের বিদ্যালয়গুলো দেখলাম, বিশাল এলাকায় একটাও ডিকশনারি নেই, কাগজের মাঝে যে পেনসিল দিয়ে লিখবে, অধিকাংশ ছাত্রের কাগজ কিংবা পেনসিল কোনোটাই নেই।

মাইলের পর মাইল হেঁটে আমার নিজের এলাকায় এটা আমি স্বচক্ষে দেখলাম। প্রগতিশীলেরা আস্ফাালন করছে যে গ্রাম-গঞ্জে কওমি মাদ্রাসায় ছেয়ে গেছে, কিন্তু প্রগতি ও শিক্ষার পক্ষে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তিকে মাঠে-ময়দানে কাজ করতে দেখলাম না। সারা দেশ ভরে গেছে অজস্র তোরণে, অমুক ভাইয়ের সালাম নিন, তমুক ভাই জিন্দাবাদ। নেতারা নিশ্চয়ই রাস্তায় বেরোলেই নিজেদের ছবি চারদিকে দেখতে দেখতে দিশাহারা। কিন্তু হায়, জনগণের ছবি কোথাও নেই।

জননেতাদের চেহারা গাছের ফুল ও পাতাকে আড়াল করে ফুটে রয়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। কিন্তু সত্যিকারের ফুল ফোটানোর মানুষ আর চোখে পড়ে না। শৈশবে দেখতাম অনেক বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ে ফ্রেম করে একটা কবিতা রাখা হয়েছে।

 

‘মহাজ্ঞানী মহাজন,

যে পথে করে গমন

হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়

সেই পথ লক্ষ্য করে

স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে

আমরাও হব বরণীয়’

নেতা, হাফনেতা, কোয়ার্টার নেতাদের ছবি সরিয়ে এ কবিতায় দেশটা ভরিয়ে দেওয়া যায় না?

আবার লাইনাস পলিংয়ের কথায় ফিরে আসি। কিংবা আসি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথায়। সব বাগিবতণ্ডা-তর্ক পেছনে ফেলে একটা বিষয়ে আমরা একমত হতে পারি। আর তা হলো বইপড়া। পড়া মানুষকে বদলে দেয়, মহৎ করে তোলে। আমাদের দেশে বড় ও মাঝারি শহরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এই ব্যাপারটা করেছে, তা নিয়ে যেতে হবে ৮৭ হাজার গ্রামে। মহৎ চিন্তা ছড়িয়ে দিতে বইয়ের বিকল্প নেই। আমি আমার নিজের গ্রামে এই কাজটা শুরু করেছি। কাজটা সহজ। এমন একটা বাড়ি যেখানে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী আছে, সেখানে একটা বইয়ের সেলফ ও ১০০টি অত্যাবশ্যকীয় বইয়ের ব্যবস্থা করা। পুরো গ্রামে হয়তো চারটি এ রকম বাড়ি থাকল। বাড়িগুলো হয়ে উঠল খুদে গ্রন্থাগার। এক গ্রাম, চার খুদে গ্রন্থাগার।

মাঝেমধ্যে শহরের কেউ মুঠোফোনের মাধ্যমে এদের খোঁজখবর নেবেন, তাদের বন্ধু হবেন। ব্যাপারটা এভাবে শুরু হতে পারে। প্রগতিশীলদের কাজ বাড়ল। আর অতিসত্বর আসবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ই-বুক। আমার জীবনে সর্বদাই অনুভব করেছি প্রান্তিকতার হাত। প্রান্তিকতায় আছে শিকড়ের ছোঁয়া। শিকড় কিছুটা মাটি, কিছুটা জৈব প্রাণের নির্যাস, কিছুটা ইতিহাস আর বাকিটা ভবিষ্যৎ। বৃক্ষের সত্যিকারের শিকড় আর জীবনের শিকড়ের রূপকল্প তাই অনেকটা কাছাকাছি। আমাদের প্রান্তিক মানুষেরা তাঁদের জীবন দিয়ে নিরন্তর যে ইতিহাস ধরে রাখছেন, তা-ই সত্যিকারের আবহমান বাংলা। সেই ধারাকে, সেই সহস্র ধারাকে, সে ধারার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের আসল কাজ। বইয়ের মাধ্যমে গ্রামকে জাগিয়ে তোলা যেন সেই শিকড়ে জল সিঞ্চন করা।

আবেদ চৌধুরী

Abed Chaudhury

Abed Chaudhury

আবেদ চৌধুরী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি জিনবিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক এবং কবি। তিনি ক্যানবেরা শহরে বসবাস করেন। আবেদ চৌধুরী আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রথম সারির গবেষকদের একজন। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে, যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন স্টেট ইনস্টিটিউট অব মলিক্যুলার বায়োলজি এবং ওয়াশিংটনের ফ্রেড হাচিনসন ক্যানসার রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। ১৯৮৩ সালে পিএইচডি গবেষণাকালে তিনি রেকডি নামক জেনেটিক রিকম্বিনেশনের একটি নতুন জিন আবিষ্কার করেন, যা নিয়ে সে সময় আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যাপক গবেষণা হয়। তিনি অযৌন বীজ উৎপাদন-সংক্রান্ত (এফআইএস) তিনটি নতুন জিন আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে এই জিনবিশিষ্ট মিউটেন্ট নিষেক ছাড়াই আংশিক বীজ উৎপাদনে সক্ষম হয়। তাঁর এই আবিষ্কার অ্যাপোমিক্সিসের সূচনা করেছে, যার মাধ্যমে পিতৃবিহীন বীজ উৎপাদন সম্ভব হয়। ১৯৯১ সালে তিনি শৈবাল ও অন্তরীক্ষ নামে কবিতার বই লেখেন।


Place your ads here!

Related Articles

ভার্চুয়াল চিঠি (পর্ব – এক)

একটা নতুন বইয়ের কাজে হাত দিয়েছি … কাজটা একটু অন্যরকম , ইনবক্সে আজকাল ভার্চুয়াল প্রেমের চিঠি ফেসবুক কিম্বা হুয়াটসআপস এ

একুশ মানে

একুশ মানে শুধু নয় ভাষা অথবা বর্ণমালা একুশ মানে একলা পথে চলার সাহস একুশ মানে মিনার শুধু নয় কিংবা কোন

ক্যানবেরার “আপেল” কাহিনী

কিছু শুভানুধ্যায়ীর কাছে শুনলাম ১৯৭৫ এর ভোরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রেডিও বেতারে সাহায্যকারী (আমরা ফেসবুক এবং বিভিন্ন পত্রিকায় পড়েছি) আপেল মাহমুদ

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment