জেফরীর নায়ক ও এ কেইস অন করাপ্সন

জেফরীর নায়ক ও এ কেইস অন করাপ্সন

-পড়ে শোনাও এবার

আমি স্পষ্ট উচ্চারণে জোরালো গলায় পড়তে শুরু করলাম। এ ধরনের জরুরী অর্থপূর্ণ তবে প্রায় অর্থ শূন্য কাজে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গেলাম। পণ্ডিত গবেষকদের সঙ্গে মাঝে মাঝে কিছু কাজ করে থাকি। পয়সাও সামান্য জোটে তবে এতে পয়সার চেয়ে বেশি জোটে আনন্দ।

হতাশ পিতা বিরক্ত চোখে চেয়ে আমাকে দেখেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মা বলেন

-না হোক বিদ্বান, না হোক বিত্তবান। কারোর ক্ষতি তো করছে না, গরিবানা সুরতেই জীবনটা ওর না হয় কাটল কি তাতে আসবে যাবে।

বৈষয়িক ব্যাপারে অতি অভিজ্ঞ বাবা বলেন

-যেটুকু গুণ আছে তা দিয়ে ফায়দা তুলতে পারত সেটাও করবে না; গাদা গাদা বই পড়া আর দিস্তা দিস্তা কাগজ ও কালির অপচয় শুধু। লিখে দে একখানা রসালো বই তা থেকে পয়সা কিভাবে বানাতে হয় তা আমি বুঝব।

বাবার বিরক্তি আমার কাজে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। কিছুদিন হলো ক্রাইম আর করাপ্সন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে কিছু তথ্য যোগাড়ে মেতে উঠি। ক্রাইম শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যাদের কথা মনে ভাসে তারা সমাজের নিচুতলার লোক। আর করাপ্সন হচ্ছে ধবল বা সফেদ পোশাকধারীদের বা হোয়াইট কালারদের কর্ম। সুবিধা আদায়, স্বার্থসিদ্ধির জন্য অতি সূক্ষ্মভাবে ভদ্রলকেরা করাপস্ন করে থাকে। মুশকিল হয় কোন দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র বা বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যখন অন্য দেশে ঘুষটুষ নিয়ে কাজ আদায়ে কোমড় বেঁধে নামে। ক্রাইম দমনের আইন আর করাপ্সন বন্ধের আইনী উদ্যোগ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির শুরুতে এই কাজের প্রস্তাব পাই। গল্পটা কাজের অংশ।

“জেফরী আর্চারের গল্পের নায়ক একজন মন্ত্রী। আফ্রিকা মহাদেশের হতদরিদ্র, শিক্ষাদীক্ষা বঞ্চিত এক দেশের সে মন্ত্রী। এমনি এক দেশ যে দেশে যখনই যারা শাসনক্ষমতা পেয়েছে জনগণের সম্পদ লুট করেছে দু’হাত ভরে। সেই সম্পদ তারা অবশ্যই দেশের বাইরে বিদেশের ব্যাংকে নিরাপদে গচ্ছিত রেখেছে। কথিত গল্পের নায়ক মন্ত্রী ক্ষমতা পেয়ে ঘুষ আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করে খুবই সম্মান পান, জনপ্রিয় হন। এমনকি সরকারপ্রধানও তার কর্মকাণ্ডে চমৎকৃত, বিস্মিত, শঙ্কিতও কিছুটা। এর মাঝে সরকারপ্রধানের কাজেরও তথ্যতালাশ করে কিছু গড়বড় বের করে ফেলেন মন্ত্রী। গল্পেতে দেখা যায় বস সরকারপ্রধান কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান করে করে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মন্ত্রী সপরিবারে ছুটি কাটাতে বিদেশ গেলেন। পরিবার-পরিজনকে হোটেলে রেখে সবার অজ্ঞাতে উড়াল দিয়ে পাশের দেশ সুইজারল্যান্ড পৌঁছালেন মন্ত্রীবর। এসেই গেলেন সেই ব্যাংকে যাতে পৃথিবীর যে কোন দেশ থেকে যে কেউ টাকা রাখতে পারে। ঐ ব্যাংক টাকার উৎস কি তা যেমন (চুরি-রাহাজানির টাকা নাকি আয়কর ফাঁকি দেয়া টাকা) কিছুই জানতে চায় না তেমনি তারা টাকার বিষয়ে কোন তথ্য (যেমন কার টাকা, কত টাকা) কাউকে কখনও দেয় না। কর্মবীল আপাত সৎ মন্ত্রী মহোদয় তার পুরনো জীর্ণশীর্ণ ব্রিফকেসটি নিয়ে ব্যাংকে ঢুকলেন। পরিচয় দিতেই তারা তাকে সমাদরে বসালেন। উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা মন্ত্রীর খেদমতে তখনই এসে হাজির হলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জানকোরবান করা মন্ত্রী জানতে চাইলেন তার দেশের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট হোন্ডার অসৎ লোকদের নাম ও ব্যাংক এ্যাকাউন্টের হিসাব। কর্মকর্তা নম্রভাবে অপারগতা প্রকাশ করলেন। মন্ত্রী রুক্ষ্ম হলেন, রুষ্ট হলেন। ব্যাংক কর্মকর্তা আরও বিনয়ে গলে গিয়ে নিজের অক্ষমতা জানিয়ে গেলেন। এবার মন্ত্রী কৌশল খাটালেন। তার কথা হলো যদি সুইস ব্যাংক এই তথ্য তাকে না দেয় তবে তার দেশ সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে। মন্ত্রীর অনুরোধ-উপরোধ, বাকবিতণ্ডা, যুক্তিকৌশল সব অর্থহীন আর্তনাদ মাত্র। দুর্নীতির তথ্য উদ্ধারে ব্যর্থ পরাজিত লোকটি এবার ভয়ানক রেগে গেল। উত্তেজিত হয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করে কর্মকর্তার মাথায় ঠেকিয়ে আবারও সে তথ্য জানতে চাইল। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কর্মকর্তা তথ্য না জানাতে অটল, অনঢ় রইল। শেষে কি ঘটল? জেফরীর গল্পে চমক অভূতপূর্ব তাই পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। এবার দরিদ্র দেশের পরাজিত মন্ত্রীর মুখে স্বস্তির হাসি ফুটল। পিস্তল ফেলে সে এবার জীর্ণ ব্রিফকেস টেনে নিয়ে তার ঢাকনা খুলল। তাতে থরে থরে সাজানো টাকার বান্ডিল। এ টাকা বিষয়ে এরাই তার ভরসা। সে চোখ বুজে নিরাপদে এই ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখবে। কাকপক্ষীও কোনদিন জানবে না তার টাকার খবর।”

-গল্প পড়ে কি বুঝলে? সে মন্ত্রীকে খুঁজেছিলে কি? কালোপনা, নাদুসনুদুস, তেল চক্চকা লোকটি কোথায় গেল? গরিব দেশের জঘন্য এক মন্ত্রীকে দেখানো হয়েছে এতে।

-দরিদ্রলোক মাত্রই অসৎ আর দুর্নীতিবাজ। এদের আত্মমর্যাদা বলে কিছু আছে নাকি? দরিদ্র দেশে এমন চোর-ধাওর-লোভী মন্ত্রীর অভাব নেই। দরিদ্রলোক একবার ক্ষমতায় গেলে তলানিটুকুও চেটে-পুটে খায় এই জন্য গরিবদের ক্ষমতা দিতে নেই।

সমাজবিদ্যার অধ্যাপক গবেষক হাসলেন।

-তুমি এক সরল গবেট।

-কেন এমন কথা বলছেন? গরিব দেশেই তো দুর্নীতির ঘটনা ঘটে চলেছে এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।

-তা বুঝলাম। তবে ঘুষের টোপ কারা ফেলে বলতো? কারা চুরির টাকা নিরাপদে রাখতে সাহায্য করে? অসৎ পথে অর্জিত অর্থের অভয়ারণ্য কোথায় আছে? সুইজারল্যান্ডে তাই না?

-শুনেছি আরব আমিরাতও কালো টাকা গচ্ছিত রাখার স্বর্গপুরী যাকে বলে ট্যাক্স হ্যাভেন।

-আরব আমিরাত কি দরিদ্র? যাক গল্পটা চমৎকার বেছে এনেছ। কোর্স ম্যাটেরিয়াল হিসেবে এটাও কাজে লাগবে। আরও কিছু তথ্য যোগাড় কর তো।

এক টুকরা কাগজে খস্ খস্ করে কিছু লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।

তার পরের কয়দিন তথ্য যোগাড়ে ব্যস্ত রইলাম। দৈনিক পত্রিকার পাতা তন্ন তন্ন করে দুর্নীতির বিষয়ে খবর খুঁজে বের করে সারাৎসার লিখা। বিভিন্ন দেশের সরকারের ও মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির ব্যবসা বাগানোর ফন্দি (পরিশীলিত ভাষায় যাকে বলে বিজনেস এক্সপান্সন বা প্রমোশন স্ট্রাটেজি) জানার ও বোঝার জন্য প্রাণপাত করছি।

কাজে গভীরভাবে বিবেদিত থাকি। বাপ অবহেলায় দেখে আমার মতো অর্বাচীন অপগ-কে। মায়ের আদর অপগ- বাঁদরটিকে আগলে রাখতে সদা সচেষ্ট থাকে।

হলিউডি ছবি ‘সিরিয়ানা’ দেখা হলো। দুর্নীতির জটিল জট চিত্রিত হয়েছে এতে। ‘সিরিয়ানা’তে জর্জ ক্লুনির অভিনয় এমন অসাধারণ যে অস্কারের জন্য নমিনেশন পেয়েছিল সে। শেষ পর্যন্ত ওকে অস্কার দেয়া হয়নি।

অধ্যাপক বললেন

-না দেয়ার কারণটা কি মনে হয়?

-ছবির অস্বস্তিকর বিষয়বস্তু। ঘুষ দিয়ে নানা সুবিধা আদায়ের যে চিত্র ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে তা এক সিআইএ কর্মকর্তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার সত্যিকার বয়ান।

-ঠিক, অস্কার দিলে ছবিটি সম্পর্কে মানুষের আগ্রহকে আরও উস্কে দেয়া হবে ভেবেই হয়তো…

অনুসন্ধান আর অধ্যয়ন একটি বিষয়ে আলো ফেলল তা হলো ঘুষ আর নানা প্রলোভনের বড়শি পেতে গরিব দেশের আমলা-মন্ত্রীদের কৌশলে গেঁথে ফেলা হয়। চাওয়ার আগেই এনভেলপ ভর্তি অর্থ হাজির হয় তাদের কাছে এবং পরবর্তী সময়ে তারা ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ হিসেবে নিন্দিত ও কলঙ্কিত হয়। অথচ যারা নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধা পাওয়ার জন্য ঘুষের উপঢৌকন দিয়েছে তারা প্রায় কখনই চিহ্নিত ও নিন্দিত হয় না। ঘুষ দেয়া ব্যবসা আদায়ের কৌশল মাত্র তেমন মারাত্মক কোন অন্যায্য কাজ এটি নয় এই ধারণাটি চালু রয়েছে ঘুষদাতাদের মাঝে। সুতরাং বিবেক দংশন, নৈতিক যন্ত্রণা নামে কোন অনুভূতিই ওদের নেই।

একদিন অধ্যাপক বললেন

-গরিব দেশের পত্রিকাতে খবর প্রকাশেও থাকে নিজেদের হীনম্মন্যতার ছবি।

যেমন দেখ এখানে লেখা

‘জারদারী অমুক কাজের জন্য শত হাজার ডলার ঘুষ নিয়েছিল’ লিখতে পারতো, ‘অমুক কাজ আদায়ের জন্য তমুক কোম্পানি জারদারীকে শত হাজার ডলার ঘুষ দিয়েছিল।’

আমি বললাম

-গরিব দেশ নাইজেরিয়া এবার অস্ট্রেলিয়ার এক কোম্পানির ঘুষ দেয়ার ঘটনা নিয়ে খুব চেঁচামেচি করছে। খবরটা অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকায় প্রথম পাতায় শিরোনাম সংবাদ হয়েছে।

-সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা থাকলেও সব হয় না সঙ্গে থাকতে হয় সাহস, সততা ও প্রজ্ঞা বুঝেছ।

অধ্যাপকের সৎ ও আন্তরিক ব্যাখ্যায় আমি মুগ্ধ।

কাজ আগাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই অধ্যাপককে কাজের অগ্রগতি অবহিত করে আসি। শেষ দিন গেছি। ভদ্রলোকের কাছে তার একজন প-িত বন্ধু বসেছিলেন। অধ্যাপক আমাকে দেখিয়ে বললেন

-ও আমাদের কোর্স ম্যাটেরিয়াল তৈরিতে সাহায্য করছে; নতুন কোর্স চালুর কথা ভাবছি আমরা

-কি কোর্স হবে?

-করাপ্সন অধ্যয়ন করব আমরা। এ ইতিহাস, সাহিত্য, সিনেমা কোন কিছুই বাদ দেয়নি। বাস্তব ঘটনা তো আছেই। ভারতের কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত ঘুষের কথা থেকে বর্তমানে জেফরী আর্চারের গল্প, হলিউডি মুভি সবকিছুই ওর চোখে ধরা পড়েছে। করাপ্সন বন্ধের জন্য ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন কাজে লাগানোর কথাও এনেছে সে।

ভদ্রলোক শুনতে আগ্রহী হলেন। আমার নাতিদীর্ঘ উপস্থাপনার শেষে দু’জনেই খুশি হলেন। নতুন ভদ্রলোক জানতে চাইলেন

-আচ্ছা, কোর্স চালু না হলে এই ম্যাটেরিয়ালের মালিক কে হবে?

-আমরা পারিশ্রমিক দিচ্ছি ওকে সুতরাং মালিক হবো আমরা

-আমার মনে হয় এটা ওর ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টি, বই হিসেবে ছাপালে কোর্সের কাজে লাগবে আবার যার সম্পত্তি তারই রইল কি বল?

অধ্যাপক ভদ্রলোক জোর গলায় সাতপাঁচ বুঝিয়ে প-িতের কথা উড়িয়ে দিলেন। এবার প-িত আমার দিকে ফিরে জানতে চাইলেন

-এই সময়ে করাপ্সনকে নিয়ে কি ভাবনাচিন্তা চোখে পড়ছে বলতো?

-গরিব দেশ নাইজেরিয়াও যখন করাপ্সন বা ঘুষের উৎস খুঁজে বের করতে চেচাচ্ছে তখন ঘুষকে ব্যবসা পাওয়ার কমিশন আখ্যা দিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা হচ্ছে। একদিন করাপ্সনকে ইনস্টিটিউটশনালাইজ করার সূক্ষ্ম ছলচাতুরী হবে, করাপ্সনকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার কথা বলা মানে করাপ্সনকে কিছুটা সামাজিক স্বীকৃতি দেয়ার মনোবৃত্তি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।

আমার তৈরি দলিল-দস্তাবেজ সব অধ্যাপককে বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে এলাম।

বহুদিন পর ঘুরতে ঘুরতে ঐ পথে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম দেখি অধ্যাপক কোর্সটি চালু করতে পারলেন কিনা। গিয়ে শুনি ভদ্রলোক বেশ আগেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে অন্যদেশে চলে গেছেন। করাপ্সনের উপরে ওরা কোর্স অফার করছে কিনা জানতে চাইলাম। এটাও বললাম যে সেই ভদ্রলোক আমাকে দিয়ে এ বিষয়ে অনেক কাজও করিয়েছিলেন।

উত্তর শুনে স্তম্ভিত।

-ভীষণ করাপটেড লোক ছিল সে। ডিপার্টমেন্টের টাকায় নিজের কাজ করিয়ে নিত। দেখে নিও ওই কাজ সে নিজের নামেই প্রকাশ করবে একদিন।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment