ছোট্ট ছোট্ট দুঃখব্যথা ছোট্ট সব সুখের কথা

ছোট্ট ছোট্ট দুঃখব্যথা  ছোট্ট সব সুখের কথা

বই দু’টো গভীর আবেগে আঁকড়ে ধরে ভাবছিল। একসময়ে মন বর্তমান সময় ও স’স্থান ফেলে দূরে কোথাও অন্য এক প্রহরে বিচরণ শুরু করলো।

শিউলি ফুলের সুবাস নিয়ে শরতের সোনালী সকাল। শিউলির গন্ধ মানুষকে উন্মনা করে দেয় থেকে থেকে। তবে মেয়েটির শিউলি ফুল কুড়ানো বা গন্ধ শুকার উপায় নেই। বড়ভাই শান্ত ও নিচু স্বরে ছোট বোনকে বকছেন। এমন মিষ্টি সকালে মাথা নিচু করে বালিকা বকুনি শুনছে।

অপরাধ সে করেছে। বইয়ের আলমারির তালা খোলা পেয়ে গোপনে বইটা বের করে নিয়েছিল। আবার রেখেও দিয়েছিল চুপিসারে। সমস্যা একটা হয়েছে। বইয়ের একটি পাতা মুড়ে রেখেছিল। এই বাড়ীতে বইয়ের পাতা মুড়া নিষেধ আর এটাতো রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’। অপরাধ আরও গুরুতর। সে ভেবেছিল আবার কখনো সুযোগ পেলে পাতাটা খুলেই ঐ পাতার কবিতাটা খাতায় টুকে নেবে, তখন কবিতা খোঁজে বের করার জন্য সময়ও নষ্ট করতে হবে না। সেই অপরাধের শাস্তি কঠিন তিরষ্কার। চোখের পানি টপটপ করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ভিজলো, তারপর সিমেন্টের মেঝেও যখন কান্নায় ভিজলো তখন বকুনির শেষ বাক্য ছিল

-বইয়ের যত্ন জান না আর রবীন্দ্রনাথ ধরার সাহস কর! যখন বুঝবে তখন এই বই পড়বে। মিথ্যা না বলে দোষ স্বীকার করেছ তাই আর কানতে হবে না, যাও এখন।

মেয়েটির দুঃখ হল। খুব দুঃখ হল। কবে সে বুঝবে, কবে তার নিজের একখানা রবীন্দ্রনাথ হবে ভেবে কূল পেল না।

তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। এখন সে কিছুটা বড়ও হয়েছে। দেশে টেলিভিশন চালু হল একসময়ে, এমন কি পাড়াতে কারও কারও বাড়ীতে টিভি এসেছে, দু’একজন আত্মীয়স্বজনও টিভি কিনেছেন। তবে এই বাড়ীর ছেলেমেয়েরা কখনোই দলবেঁধে অন্যের বাড়ী টিভি দেখার জন্য যায়নি। এরা অন্য কিছুতে আনন্দ খুঁজে পায় ও আনন্দ খুঁজে নিতে জানে। দাবা খেলা, নিজেদের তৈরী word making খেলা। যেমন একটি ইংরেজী শব্দ বেছে নিয়ে(intention ev consideraition) এতে যে অক্ষরগুলো তা ব্যবহার করে কে কত বেশী শব্দ তৈরী করতে পারে তা নিয়ে মেতে থেকে কেটে যেতো কত আনন্দময় প্রহর। সবাই মিলে দল বেঁধে বসে বড়বোনের পড়ে শোনানো বইয়ের গল্পে মত্ত হওয়া। এসব ছিল সময় কাটানোর মজার পন্থা। নানা বইয়ের মাঝে ছড়িয়ে থাকা সুখ দুঃখের মাঝে ডুবে যেতেও ওরা ভালবাসে, তার মাঝে লুকানো সুখ আনন্দে দুলতে ভালবাসে। বাচ্চাদের মজার সব বই পড়তে পড়তে মেয়েটি কখনো কখনো উদাস হয়ে ভাবে কবে তার নিজের একখানা রবীন্দ্রনাথের বই হবে।

তারপর এক সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখে তার বালিশের নীচে বড়সড়ো হালকা হলুদ রঙ্গা এক প্যাকেট। ছোটবোন বললো

-ভাইয়া চাটগাঁ থেকে এসেছে, এটা তোর জন্য এনেছে

-ভাইয়া এরমাঝে এসে পড়েছে?

-গতরাতেই এসেছে।

তাড়াহুড়া করে প্যাকেট খুলে জিনিসটা হাতে নিয়েই ও আনন্দে থ হয়ে গেল। ভাবতেই পারে নি, না চাইতেই তার অনেকদিনের মনের সাধ মিটবে। তার জীবনে প্রথম একান্ত নিজস্ব রবীন্দ্রনাথ। কিশোরদের জন্য লেখা রবীন্দ্রনাথের জীবনী। উচ্ছ্বাস প্রকাশ এদের স্বভাবের অঙ্গ নয় তাই হৈ চৈ করে স্বরবে গম্ভীর বড়ভাইকে ‘খুব খুশী হয়েছি’ ‘খুব খুশী হয়েছি’ বলা হয়নি। তবে দশকের পর দশক ঐ খুশীর উৎসটি সে সযত্নে রক্ষা করে চলেছে। বাঁধাই ছিঁড়ে গেছে, পাতাগুলোও বিবর্ণ হয়ে গেছে তবুও স্মৃতি মাখা মূল্যবান দু’একটি টুকিটাকি জিনিসের সাথে বইটিও আছে। তার নিজের রবীন্দ্রনাথ বইটিও তার সাথে সাথে কত দেশে ঘুরেছে বলা বাহুল্য।

প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথের কত লেখা পড়েছে তারও ইয়ত্তা নেই। রবীন্দ্রনাথের নিজের রচনাই এত্তো, এত্তো। সব পড়া হয়ে উঠেনি। ষাটবছর ধরে কলম চলেছে তার অন্যতম প্রিয় লেখকের। তবে অন্যরাও তাকে নিয়ে লিখেছেন অজস্র। সেগুলোরও কিছু চোখে পড়লে পড়েছে, এখনও পড়েই যাচ্ছে।

হঠাৎ করেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা একটা বইয়ের কথা পড়ে চম্‌কে গেল। বইটির লেখক একজন বিচারপতি। বিচারপতি কি লিখেছেন তা জানার জন্য খুব ইচ্ছে হলো। বাংলাদেশে একবার কাকে যেন লিখলোও বইটা পাঠাতে। বইটা আসলো না। এরমাঝে ঐ বইয়ের লেখকও পৃথিবীর বাস গুটিয়ে অন্য ভুবনে চলে গেলেন। পত্রপত্রিকায় আবার লেখকের কথা প্রসঙ্গে বইয়ের কথাও উঠলো।

এবার সে বইটি পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে উঠলো। শেষ পর্যন্ত অনেককেই বইটি জোগাড় করে পাঠানোর জন্য তাগাদা দিল। শোনা গেল বইটা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। নিউমার্কেট, সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডী কোন এলাকার বইয়ের দোকানেই বইখানা নাই। এবার সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ব্যস্ত ভাইয়ার কাছেই বইটা পাঠাতে অনুরোধ করলো।

বইমেলা ২০১৪ উৎসর্গ করা হয়েছে যে দু’জন সম্প্রতি প্রয়াত লেখকের নামে, একজন হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ ও আরেক জন এই বইয়ের লেখক। বইমেলাতেও তাঁর এই বইখানা ছিল না।

ভাইয়া প্রকাশকের নাম জোগাড় করলেন। বাংলা একাডেমী। দেখা গেল ঐ সংস্থাতে ‘াতে কাজ করেন ভাইয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর এক ভাগনি। ঐ মায়াবতী মেয়েটি সংসার’ার গোদামঘর থেকে মলাট ধূলায় মাখামাখি, ভিতরের পাতা ফাঙ্গাসে আকীর্ণ বইটি শেষ পর্যন্ত সংগ্রহ করে। অনেক মূল্যবান এই উপহার বিদেশের মাটিতে এসে পৌঁছল।

বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠা উলটে উলটে টিস্যুতে ডিজইনফেক্‌ট্যাণ্ট মাখিয়ে ফাঙ্গাস মুছে পরিষ্কার করতে হয়েছে। বইটি মূল্যবান অথচ কেন এটি বিপণনের জন্য উদ্যোগ নেই তা বোধের অগম্য।

পরবাসী জীবনে ছোট্ট ছোট্ট দুঃখ, ছোট্ট নানান কষ্ট ভুলিয়ে ছোট্ট ছোট্ট সুখের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় বই দু’টি।

বইগুলো নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করলো। প্রথম বই “রবীন্দ্রনাথ কিশোর জীবনী”। কিশোরদের জন্য লেখা। প্রথম প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে বাংলা ১৩৭৪সালে। বইটির দাম ছিল পাঁচ টাকা। বইয়ের লেখক হায়াৎ মাহমুদ।

শেষ পৃষ্ঠায় শেষ কটি লাইন।“তোমাদের জন্যে এই বই আমি ভালোবাসা থেকেই লিখলাম।…..তোমরাও তাঁকে ভালোবেসে পড়বে, বড় হ’লে তাঁর উপরে লিখবে- তাও ভালোবেসে।” বইটা সত্যিই ভালোবাসা কেড়ে নেয়।

দ্বিতীয় বইটিও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান লিখেছেন “মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ”। প্রথম প্রকাশ বৈশাখ ১৩৯০সাল/মে ১৯৮৩সাল। বইটির পুনর্মুদ্রণ পৌষ ১৪০২/ডিসেম্বর ১৯৯৫। মূল্য চুয়ান্ন টাকা। বিচারপতি হাবিবুর রহমান রবীন্দ্রনাথের কথা মিশিয়ে লিখছেন

“‘যখন বঙ্গভাষা রাজভাষা নহে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা নহে, সম্মান লাভের ভাষা নহে, অর্থোপার্জনের ভাষা নহে, কেবলমাত্র মাতৃভাষা’, তখন তার প্রতি ‘একান্ত অনুরাগ ও অটল ভরসা’ রেখে রবীন্দ্রনাথ তার নিজের কর্তব্য, সাধনার পথ ও জীবনের লক্ষ্য সি’র করলেন তরুণ বয়সেই:…”

বইখানা বড় মূল্যবান। বইটি বাজার থেকে কেনা যায়নি। ছিলই না দোকানে কিনবে কিভাবে? বাংলা একাডেমীর স্তূপীকৃত বইয়ের পাজা থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এটিকে সংগ্রহ করেছেন এক স্নেহ কাতর ভাই তাঁর বই বুভুক্ষা বোনের জন্য। ভাইয়ার স্নেহমমতায় মাখামাখি বইটি হাতে নিয়ে সেই দিনের বালিকা আজ যে পরিণত বয়সী একজন বা বলা যায় সেদিনের ছুড়ি আজ যে প্রায় বুড়ি সে তার দৃষ্টিশক্তিক্ষীন ভাইয়ার প্রতি নীরব শ্রদ্ধা ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে কাঁদলও।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment