গল্পকনিকা

গল্পকনিকা

১. আকাশের অলিন্দে রবি

চাঁদ ছিল আর ছিল নীল নীলিমায় সাদা মেঘের উড়াউড়ি। এখন শীত তবুও জানলার কাঁচের ওপারে আকাশের অপার যাদু হাতছানি দিল। মনটা ভাল না। এক লেখার কারনে মানুষের বর্ষিত বাক্যে পুরস্কার তিরস্কার দু’টোই জুটেছে। তবে আসল কথাটা কেউ বলে নি, মন খারাপ তাই। মেঘগুলো থিতু হয়ে বসেছে। হঠাৎ দেখি মেঘের বাড়ীর অলিন্দে বরাভয় জাগানো রবির আবির্ভাব। নিস্পাপ চেহারার কিশোর রবি, অপূর্বদর্শন তরুণ রবি নন আমাকে ভুলিয়েছে দীর্ঘ চুলদাড়িঅলা ঋষি রবি বা তার বানী। তার মানে কম বয়সের কোন কথা বা লেখা কি আমাকে টানে না। আসলে ঐ ঋষি তার মনে বাস করতো বরাবরই। ঐ ঋষিই বলিয়েছে সবকথা।

তাঁর সঙ্গে শুরু করি গল্প।

-মন ভাল নেই!

-কেন? এমন আবছা চাঁদের আলোতে অজানা আনন্দে মন ভেসে যাওয়ার কথা তাই না?

-আপনি কবি আপনার সবতাতে আনন্দ ও সবতাতে দুঃখ খুঁজে পান, আমার মন খারাপের কারন আপনি।

-ওমা কেন?

-ঐ যে হতচ্ছাড়া রুমি বলেছিল রবীন্দ্রনাথ তার মতো আশ্রয়দাতার কষ্ট, অপমান-হেনসত্মার কথা লিখেন নি, লিখেছেন আশ্রিত ফটিকের দুঃখকষ্টের কথা।

-আমিই সব কিছু বলে ফেললে অন্য সবাই কি করতো তখন? এমন কি আমি নিজেও অন্যকে বলেছি কোন বিষয়ে লিখতে।

-তাইতো; আপনি কথাটা ঠিক বলেছেন। একটা বইয়ে পড়লাম কবি বন্দে আলি মিয়াকে আপনার জমিদারীর একঘর মুসলমান প্রজার কথা লিখেছিলেন তাকে বলেছিলেন তাদের জীবনযাপন উনি নিয়ে লিখলে ভাল হতো। রুমির কথা লিখে প্রশংসা-নিন্দা দুইই শুন্ছি…

-কি রকম?

-যেমন কেউ বলেছে ‘বাহবা্! রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে গেছে এমন বিষয় নিয়ে লিখেছ দারুণ হয়েছে’ আবার কেউ বলছে ‘সাহসতো কম না রবীন্দ্রনাথ দেখেন নি বা দেখতে ভুলে গেছেন এই কথা বলা!’ তবে…

-তবে কি? খুলে বলতো

-আসল কথাটাই কেউ বলতে পারলো না।

-আসল কথাটা কি শুনি?

-একবারও কেউ এতোটুকু ভাবলোনা, ভেবে বলতে পারলো না যে ‘আহা! রুমির গল্প যদি রবীন্দ্রনাথ শুনাতেন কি অপূর্বই না হতো বা ফটিকের কষ্টতো শুধু মামাবাড়ীর অনাদর-অবহেলা নয়, ওর ফেলে আসা বন্ধনহীন সরল গ্রামের জীবনের জন্যও ছিল অনত্মহীন আর্তি’

মৃদু হাসির রেখা ফুটলো কবির মুখে সাথে সাথে মেঘের রাজ্যে অদৃশ্যমান হলেন রবি।

২. মিথ্যা না বলার অপরাধে

ঘটনা সত্যি। মিথ্যা বলতে পারে নি বলেই শাস্তিটা পেয়েছে। বড়ই অপদার্থ। সামান্য একটা মিথ্যা মুখে জোগালো না। থাকুক আজীবন দেশছাড়া হয়ে।

গল্পটা করছিলেন তেরঙ্গা চুলের দারুণ স্মার্ট মহিলাটি। দশ নখে দশরকম নখশা। হাত নেড়ে কথা বলার কারনে নখশাগুলো মানুষের নজর কাড়ছিলো।

-মিথ্যা কেন বলতে হবে কোন ক্রাইমএ জড়িয়ে…

-ক্রাইম ট্রাইমে জড়াইনি ভাই।

-তবে ?

-গাড়ি ড্রাইভ করতে পারি বিদেশ থেকে গেছি বাহাদুরি দেখানোর জন্য বাবাকে না বলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম।

-তারপর তারপর কি হল?

-ইস্কাটন থেকে রাজারবাগ পুলিশলাইনের কাছাকাছি যেতে না যেতেই ধাক্কায় রিকশাওয়ালার কান বেয়ে রক্ত রক্ত! বাসা থেকে বেরনোর পাঁচসাত মিনিটের মাঝে এই বিপদ!

-যানজটে পড়েন নি?

-আগে এতো ভীড় ছিল না। তবে পুলিশে-মানুষে সয়লাব নিমেষে। মেয়েড্রাইভার এক্সিডেণ্ট করেছে দেখে উৎসাহ দ্বিগুণ। বাবার ফোন নম্বর চাইলো পুলিশ। বললাম বাবা বিদেশে মাকে ফোন করুন। ততক্ষণে রিকশাওয়ালাকে ক্ষতিপূরন দিয়ে ডাক্তারের কাছে পাঠালাম। আমার ড্রাইভার্স লাইসেন্স সাথে ছিল না। পুলিশ ধরে নিয়েছে আমি গাড়ীটা চুরি করে এনেছি।

-আপনার মাকে ফোন করেছিল পুলিশ?

-হ্যা করেছিল। আরেক কান্ড।

-কি কান্ড বলুন

-পুলিশ জিজ্ঞেস করলো অমুক নাম্বারের গাড়ি এক্সিডেণ্ট করেছে এটা কি আপনার গাড়ি? মা বললো জানিনা গাড়ীর নম্বরতো মুখস্ত নাই, যে গাড়ীতে আছে তাকে দিন তাইলেই বুঝবো। বলেই লাইন কেটে দিল।

-তারপরে কি ঘটলো?

-তার পরেই আবার মাকে ফোন করে আমাকে কথা বলতে দিল। মা আমাকে বললো থানায় মামার পরিচিত এক চালিয়াত বসে আছে সে যা বলবে আমি যেন মাথা দুলিয়ে সায় দেই তাতেই পুলিশ বাপ বাপ বলে আমাকে ছেড়ে দিবে।

থানায় গেলাম। গারফিসের মতো চিকনা, পান খাওয়া লালমুখো সাদা পায়জামা শার্ট পরা একলোক আমাকে দেখে বিরাট একহাসি দিয়ে বললো ‘আরে ভাগনী তুমি কুনখান থন, তা খবর ভালাতো?’ আমি মাথা উপরনীচ দুলিয়ে বুঝালাম ‘হ্যা’। তারপরেই দারোগাবাবুর দিকে ফিরে জিব কেটে বললো ‘স্যার করছেন কি সেতো বরিশালের জনাবের ছাওয়াল তারে আনছেন কিয়ারতে?

পিনপতনের শব্দ নাই গল্প জমে উঠেছে। তারপর মহিলা ভয়ার্ত স্বরে বললেন…

– চালিয়াত আমার দিকে ফিরে যা বললো তাতে আক্কেল গুড়ুম ‘তুমি বরিশালের নাস্রুল্লাহ চৌধুরীর মাইয়া, মনু তোমাগো কত নুন-নিমক খাইছি ঠিক না?’ এবার আমি দুইপাশে মাথা ঝাকিয়ে বললাম ‘না’। মিথ্যাটা বলিনি তাই মা মামার অসংখ্য বকুনিঝাকুনি খেয়ে সমস্যা মিটমাট করলাম। তাদের হুকুম ‘আর কখনও দেশ আসবি না’।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment