আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং কিছু আত্মসমালোচনা
আমার বাল্যকাল টা কেটেছে অনেকটাই স্যাটেলাইট চ্যানেল ছাড়া। বাবা মা এর কড়াকড়ির কারণে বাসায় ডিশ এর লাইন এর আগমন অনেক দেরিতেই ঘটে। ফলাফলে টিভি মানেই ছিল বিটিভি।আজানের পরে কিছু হাদিস দেখানো হতো সবসময়।তার একটি আমার কেন জানি প্রায়ই মনে পরে। সেটি হল “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম, যে নিজের সমালোচনা করতে পারে” আমার ৪ বছরের প্রবাস জীবনের ঘটে যাওয়া নানা বাস্তব ঘটনা এবং বাল্যকালে জানা উল্লিখিত হাদিস টিই এই লেখাটিকে আপনাদের সামনে তুলে ধরার অন্যতম কারণ তা বলতে দ্বিধা নেই।
যাই হোক এবার আসল কোথায় আসা যাক। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ ভাই বোন ই মনে খুব ব্যথা পান, যখন বাংলাদেশের কথা শুনে একজন ভিনদেশী বলে বসেন, “Is it in India?” কিংবা “where is it?” আমি তাদের মধ্যে এমন কয়েকজনকে পেয়েছি যারা অতি গর্বের সাথে বলেন, “আমিও ভাই উত্তর দিয়া দিছি ওই অসি ব্যাটারে যে তোমার ভৌগলিক জ্ঞান এত কম, পাস করছ কেমনে ইস্কুল।” আর এমন বাংলাদেশী ভাই বোন খুব কমই পাওয়া যাবে যারা তাদের প্রবাস জীবনে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হননি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছ হতে যে, “কেয়া তুম হিন্দী জানতে হো ? / ক্যায়্চা হো ইয়ার ?” মাঝে মাঝে যখন কোন বাংলাদেশী অপারগতা প্রকাশ করেন তাদের হিন্দী কিংবা উর্দু ভাষা জ্ঞান সম্পর্কে তখন তো তারা এত বড় চোখ করে তাকান যেন মনে মনে জিজ্ঞেস করতেছেন, যে তোমারে অস্ট্রেলিয়ার ভিসা দিল কে?
সমস্যা টা কি কেউ বলতে পারেন ?
আমার মতে সমস্যা টা কিন্তু ওই Aussie মেইট কিংবা ভারতীয় / পাকিস্তানি ব্রাদার এর না। সমস্যা আমাদের নিজেদের মধ্যে। সেইদিন গিয়েছিলাম Big W তে, আমার বউ কাজ করে ওখানে। সবসময় ড্রপ করে আসতে হয়। মাঝেমধ্যে অকারণে ঢুকেও পরি। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, Darwin এর সবচেয়ে বড় সপিং কমপ্লেক্স এর Woolworths আর Big W কিন্তু মাশাআল্লাহ্ বাংলাদেশীদের দখলে। Big W তে প্রায় ১০/১২ জন দেশি মানুষ আছেন এখন। যাই হোক ফিরে যাই আগের কথায়। তো দেখা হল এক বড় ভাই এর সাথে, উনিও ওখানেই কাজ করেন। দেখলাম উনি খুব সুন্দর ওনার ভারতীয় কলিগ এর সাথে হা ইয়ার ক্যায়ছে হো / কম ক্যায়্চা চাল্রাহাহে চালিয়ে যাচ্ছেন। দেখে বেশ লজ্জায় পরে গেলাম। কারণ উনি যার সাথে কথা বলছেন, সেই ব্রাদার আবার আমার ই ক্লাছ মেইট। সেই ব্রাদার আবার এটাও জানেন যে আমি উনার ভাষায় কথা বলতে অপারগ।
সমস্যা এটুকুতেই থেমে থাকলেও হত , কিন্তু উপরের ঘটনাটার আরো একটা বড় প্রভাব আছে। সেটা হলো আশে পাশে যেই সাদা চামড়ার ম্যানেজার গুলো আছেন তারা কি এটাই ভাববেননা যে , দুজনই যেহেতু একই ভাষায় কথা বলছেন দুজনের দেশ ও একটাই হবার সম্ভাবনা বেশি। আর খান আর কুমার সাহেব দের ছবির দাপটে এটুকু অন্তত জানেন যে হিন্দী ভাষাটা কোন দেশের। সুতরাং যখন বাংলাদেশ শুনে ওই Aussie মেইট রা জানতে চান যে এটা ইন্ডিয়ার কোন প্রদেশ কিনা সেটাকে আমার উনাদের ভৌগলিক জ্ঞান এর অভাব মনে হয়না, মনে হয় নিজেদের লাজহীন ব্যর্থতা।
চলুন তো একবার কল্পনায় ফিরে যাই বায়ান্ন’র একুশে ফেব্রুয়ারিতে। জিজ্ঞাসা করি , ওহে শফিক তুমি প্রাণ দিচ্ছ ঘাতকের বুলেটে, কেন হে নির্বোধ ? কারণ কি এই যে তোমার নাম নেয়া হবে বছরের একটি দিন কিংবা বড়জোর একটি মাস। তোমার নামে হবে রাস্তা। তোমার নাম চাপা পরে থাকবে বইয়ের মলাটের ভিতর। আর তোমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কথা বলবে হিন্দী বাংলা ইংলিশ এর মিশেল অদ্ভুত এক ভাষায়। আমি কল্পনাতেই দেখতে পাচ্ছি ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে মিছিলের সারি। সবাই ফিরে যাচ্ছে নিজ মায়ের কোলে। কেন মিছিল করবে তারা? কেন ঝরাবে বুকের রক্ত? কেন খালি করবে নিজ মায়ের বুক ? অথচ সেদিন তারা থামেনি। আমরা কি তবে থেমে যাব? আমরা কি হারিয়ে ফেলব আমার অহংকার , মাতৃভাষা বাংলাকে। একটু কান পেতে শুনুন তো পাঠক, শুনতে পারেন কিনা। ………
মাতৃভাষা বাংলা চাই
মাতৃভাষা বাংলা চাই
বি.দ্র. এই লেখাটির অবতারণা কোন ভাবেই কাউকে ছোট করার কিংবা নিজের দেশপ্রেম জাহির এর জন্য করা হয়নি।কেউ যদি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন আমি খুবই লজ্জিত। আপনার মতামত আমার থেকে ভিন্ন হতেই পারে। কমেন্টে জানানোর অনুরোধ রইলো। আগে অন্য কোথাও লিখেছি বলে মনে পরেনা।প্রথম লেখা হিসেবে ভুল ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার অনুরোধ রইলো। সবাইকে একুশের শুভেচ্ছা।
শেখ মোহাম্মদ নাজমুল আহসান
ডারউইন , অস্ট্রেলিয়া