অপেক্ষা

অপেক্ষা

.

ঘরের ছোট্ট জানালায় দুপুর পেরিয়ে বিকেলের আলো ঢুকেছে অনেকক্ষণ। বিকেলের মরে আসা রোদে ধুলোরা ছায়াপথ তৈরি করেছে জানালার গ্রীল থেকে বন্ধ চোখের পাতায়। তবুও তার ঘুম ভাঙে নি। নিনার চোখের পাতা কাঁপছে। স্বপ্ন দেখলে চোখের পাতা কাঁপে। যদিও তার ধারণা, সে স্বপ্ন দেখে না। প্রতিবার ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর সে অনেকবার মনে করার চেষ্টা করেছে গত রাতের স্বপ্নের কথা। নিনার কিছু মনে আসে না।

বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে নিনা। সবকিছু কেমন অচেনা মনে হচ্ছে তার কাছে। এখন তো এরকম রোদ থাকার কথা না। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে? তার শুধু মনে হচ্ছে, ঘুমানোর আগে সে একটা বই পড়ছিল। বইটার প্রথম লাইন ছিল,

“ট্রেন সবসময় প্রতীক্ষা নিয়ে আসে।”

কিন্তু বইটার নাম মনে পড়ছে না তার। চারপাশে ছড়ানো জিনিসপত্রের ভেতরে একটা বই খুঁজে বেড়াচ্ছে নিনা। কোথাও এরকম কোন বই নেই। অস্থির লাগছে তার, খুব অস্থির লাগছে। বিছানার ওপাশে মোবাইলে রিং হচ্ছে অনেকক্ষণ। তার ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। কখনো কখনো আবীর খুব অবুঝের মতো আচরণ করে।

“হ্যালো!”

“হ্যা, বল!”

“তুই ফোন করেছিস আবীর! কী বলবি বল!”

“তোর মন খারাপ?”

“বুঝিস যখন, তখন প্রশ্ন করছিস কেন?”

“চল বিয়ে করে ফেলি।”

“উফ! আবীর! আবার শুরু করেছিস!”

হা হা করে হেসে উঠলো আবীর।

“ঠিক আছে! বিয়েতে তোকে নীল শাড়ি পরতে হবে না!”

“আবীর! সবসময় ভাল্লাগে না কিন্তু…”

“আহা! বললাম তো! লাল শাড়িই পরিস!”

“কখনো তো একটু সিরিয়াস থাক! প্লিজ!”

“আমি একদম সিরিয়াস! এবার কে দেখতে এসেছিল?”

“অসহ্য! আমি ফোন রাখছি!”

“এখন ফোন রেখে দিলে তোর মন কিন্তু আরও খারাপ হয়ে যাবে।”

“কেন?”

“রাতে তাহলে আমি আর ফোন ধরবো না!”

“তুই একটা! তুই একটা… যা-তা!”

“হা! হা! হা!”

বিকেল পড়ে আসে একটু একটু করে। নিনার ঘরের সাথে ছোট্ট বারান্দায় লাগানো অর্কিড গাছটায় আজ পানি দেয়া হয় নি। রাস্তার ধুলোয় কেমন রঙহীন হয়ে গেছে গাছটা। নিনার এখন আর অস্থির লাগছে না। তবুও ফোন রাখতে চায় না সে। যেন ফোন রাখলেই খুব খারাপ কিছু একটা হয়ে যাবে।

.

প্রতিদিন রাত দশটার পর এই বাসার পরিবেশটা কেমন গুমোট হয়ে ওঠে। সবার ভেতরেই কেমন যেন একটা চাপা আশঙ্কা ঘুরতে থাকে। এসময় তৃণার খুব কান্না পায় আজকাল। কেন কান্না পায়, সেটা সে নিজেও ভালো করে জানে না। আগে আপাকে সে সব বলতো। কিন্তু, আজকাল আপাও খুব মেজাজ দেখায়। তৃণার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে। তার মনে হয়, কেউ তাকে বোঝে না। অন্যদিন সাজেদা বেগম এসময়টায় বিছানায় বসে কোরআন-শরীফ পড়েন। আজ তার শরীরটা ভালো নেই। মাথার বামপাশে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও তিনি কাউকে ডাকেন নি। শুধু নিনাকে বলেছেন, তার বাবা এলে দরজাটা যেন খুলে দেয়। এটুকু শুনেই নিনার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল। সে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে, কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। তৃণার ঘরে উঁকি দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল সে। মোবাইলের স্ক্রিন জ্বলছে নিভছে। দূর থেকে একটা ছেলে হেঁটে আসছে। অন্ধকারে ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। নিনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। বাইরের দরজায় শব্দ হচ্ছে। নিনা শুনতে পাচ্ছে না। শব্দ বাড়ছে একটু একটু করে।

“নিনা! নিনা!”

মায়ের চিৎকারে হঠাৎ নিনার মনে পড়লো, বাইরে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল সে। জামাল সাহেব তাকে একবার দেখে ঘোৎ ঘোৎ জাতীয় একটা শব্দ করে ভেতরে ঢুকে গেলেন। জুতা খুলতে তিনি বললেন,

“দরজা খুলতে দেরী হয় কেন এতো? পড়ছিলে তো না! কী করো বাসায় বসে?”

নিনা মিনমিন করে বলল,

“না বাবা! পড়ছিলাম!”

“হুহ! জানি! তোমার মা কোথায়? বাথরুমে পানি দিতে বল! এশার নামাজ কাজা হয়ে গেছে। এখনি নামাজ পড়বো।”

“মা’র শরীরটা ভালো নেই বাবা, শুয়ে আছে। আমি পানি দিচ্ছি।”

জামাল সাহেব বিড়বিড় করে বললেন,

“সারাদিন বাসাতেই থাকে! এতো শরীর খারাপ কিসের?”

“কিছু বললে বাবা?”

“যাও যাও! পানি দাও বাথরুমে! তারপর গিয়ে পড়তে বসো! শুধু পড়াশোনার কথা শুনি! রেজাল্ট তো কিছু দেখি না!”

কবরের মতো নিস্তব্ধ ডাইনিং টেবিলে একমাত্র শব্দ শুধু চামচের সাথে বাটির টুংটাং। রাতের এই একটিমাত্র সময়ে বাসার সবাই একসাথে হয়। কেউ ডাইনিং টেবিলে না থাকলে খুব বিরক্ত হন জামাল সাহেব। সাজেদা বেগম স্বামীর প্লেটে আরেকটা মাছ তুলে দিলেন। জামাল সাহেব রুই মাছ খুব পছন্দ করেন। খুব শীতল গলায় জামাল সাহেব বললেন,

“তোমাকে কি আমি মাছ দিতে বলেছি? যখন যেটা বলবো, সেটা করবা। বেশি বোঝার কোনো প্রয়োজন নাই। মাছ ওদের দাও। পড়াশোনা করতেছে। বেশি করে মাছ খাওয়া দরকার।”

“ওরা তো খাইতেছে। তুমি এই মাছটা খাও।”

“টাকা এতো বেশি হয় নি যে একবেলায় দুটা মাছ খেতে হবে! মাছের কেজি ৩০০ টাকা! রোজগার তো করোনা! তাই এইসবের হুশ নাই! নীতু, তুমি মাছ নিচ্ছ না কেন?”

বাবার সামনে থাকলে নীতুর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতে চায় না। তবুও সে কষ্ট করে বলল,

“নিচ্ছি বাবা!”

“এতো দাম দিয়ে কেনা মাছ, আর তোমাদের খাওয়ার কোন আগ্রহ নাই! জীবনটা দেখো নাই তো এখনো! টাকার কষ্ট কী সেটাও জানো না!”

নিনার খুব ইচ্ছে করে বাবাকে জিজ্ঞেস করতে, কেন বাবা সবসময় টাকা নিয়ে খোঁটা দেয়। একেকদিন তার ভেতরটা বিদ্রোহ করে বসে। সে ভাবে, আজ বলেই ফেলবে। কিন্তু, বাবার সামনে মুখ ফুটে কথাটা কখনো বলতে পারে নি সে। গত সপ্তাহেও বাবার কাছে এক্সকারশনের টাকার জন্য বলতেই বাবা বলেছিলেন,

“এতো ঘন ঘন বেড়াতে যাওয়া কিসের? টিচারদের যত্তসব টাকা খাওয়ার ধান্দা! কই! আমাদের সময় তো এতো ঘোরাঘুরি ছিল না!”

নিনার খুব ইচ্ছে করছিল বলতে,

“বাবা! এটা ভার্সিটি থেকে আমার প্রথম এক্সকারশন।”

নিনার বলা হয় নি। সে শুধু মাথা নিচু করে চলে এসেছিল। নিজেকে মাঝে মাঝে তার খুব অক্ষম মনে হয়। কেন যেন এখন খুব কান্না পাচ্ছে। কোনমতে ভাতের শেষ নলাটা গিলে নিনা টেবিল থেকে উঠে যায়। মোবাইলটা এখন তার খুব বেশি প্রয়োজন।

.

ক্লাস থেকে বের হয়ে এসে আবীর দেখলো- রিফাত, শাহেদ, ঝুমুর, রাসেল সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে কী নিয়ে যেন খুব হাসছে। ওদের দেখে খুব ভালো লাগলো আবীরের। গতকাল বিকেলে মধু’র ক্যান্টিনে ওদের সাথে প্রথম ভালোভাবে কথা হলো তার। রাসেলের কাছে তার একটা বই ছিল। রাসেল বলেছিল, ওর বাইকে করে ওদের বাসায় নিয়ে গিয়ে বইটা দেবে আবীরকে। তারপরই হঠাৎ সবাই চলে এলো। হৈ হৈ করতে করতে মধুর ক্যান্টিনে বসে আর ওঠা হয় নি। হাঁটতে হাঁটতে কাছে যেতেই আবীর শুনলো সিনেপ্লেক্সে নতুন আসা সিনেমাটা নিয়ে কথা বলছে ওরা।

“অ্যাই, ঝুমুর! তুই কিন্তু আমার পাশে বসবি!”

“যা ভাগ! আচ্ছা শাহেদ! এইরকম নোংরা কেন রে তোরা? তাও তুই আজকে দুই দিন পর একটা ধোয়া শার্ট পরে এসেছিস! আর ওই শালা পাঁচ দিন ধরে একটা শার্ট পরতে পরতে গন্ধ বানিয়ে ফেলল! একসঙ্গে থেকে টাকা বাচাচ্ছিস! আর একটা কাপড় ধোয়ার টাকা হয় না তোদের? আবার আমাকে নাকি উনার পাশে বসতে হবে!

রিফাত চেঁচিয়ে উঠলো,

“আরে! পাঁচ দিন কই পাইলি? চার দিন মাত্র!”

“দূরে যা! তোকে দেখলেই গন্ধ লাগে!”

এবার রাসেল হো হো করে হেসে ফেলল।

“তুই তাহলে আজকাল চোখ দিয়ে গন্ধ পাস?”

ওদের হাসির বিকট আওয়াজে আশেপাশের ছেলেমেয়েগুলো বিরক্ত হয়ে ফিরে তাকাচ্ছিল। সেটা নিয়ে ওদের কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। আবীর হাসিমুখে ওদের পাশে এসে বলল,

“কিরে কেমন আছিস তোরা?”

“এইতো! ক্লাসে তো ফাটায়ে দিলি!”

আবীর একটু লজ্জা পেয়ে গেল।

“আরে! ওইটা কিছু না! গতকাল ঘুম আসছিল না! ভাবলাম, একটু পড়ি! স্যার আজকে ওইটা নিয়েই কথা বলবে, জানতাম নাকি?”

“তুই পড়া শুরু করে দিছিস এর মধ্যেই! খাইসে! তোকে দিয়েই হবে! পড়! পড়! ভালো করে পড়! পরীক্ষার আগে তোর কাছেই কয়েকদিন পড়ে নিবো নি!”

সবাই হেসে ফেলল একটু। কিন্তু, কেউ যেন আর কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ শাহেদ বলল,

“এই থাক রে আবীর! আমাদের একটু কাজ আছে। পরে কথা বলবো।”

আবীর হাসি হাসি মুখে বলল,

“মুভি দেখতে যাচ্ছিস?”

“অ্যা- মানে- হ্যা! সিনেপ্লেক্সে অ্যাভাটার আসছে। যাই, ঘুরে আসি।”

“চল! আমিও যাই! আমিও ভাবতেছিলাম, যাবো। তোদের সঙ্গেই যাই তাহলে।“

রিফাত একটু আমতা আমতা করে বলল,

“তুই যাবি? ইয়ে মানে… আসলে…”

রাসেল বলল,

“ইশ! আর আধঘন্টা আগে বলতি। টিকেট কনফার্ম করে ফেললাম তখনি। এখন মনে হয় এই শো-এর আর টিকিট পাওয়া যাবে না। যাহ! আগে বলবি না!”

“ও! এখন গেলেও টিকিট পাওয়া যাবে মনে হয়! একটা ফোন দিয়ে দেখবো নাকি?”

“না রে! খামোখা ফোন দিস না! আমরা তখনি ফোন করে শুনেছি, আর টিকেট নেই! অ্যাই, নেক্সট টাইম সিওর যাবো একসাথে! তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল!”

সবাই তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ তুলে রওনা দিল। দাঁড়িয়ে থাকা আবীরের পাশ দিয়ে ছায়াগুলো সরে যাচ্ছিল দ্রুত। আবীরের মনে হচ্ছিল, তার খুব জরুরী একটা কাজ আছে কোথায় যেন। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছিল না কী সেই কাজ। হঠাৎ ঝুমুর দৌড়ে এলো পেছন দিকে। আবীর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

“আবীর! শোন!”

একটু একটু হাঁপাচ্ছে ঝুমুর; আবীর অপেক্ষা করছে।

“তুই… তুই কী কাল ফরিদ স্যারের ক্লাস লেকচারটা নিয়ে আসতে পারবি? গত দিন আমি ছিলাম না রে! আর তোর মতো এতো ভালো করে ক্লাস লেকচার আর কে তোলে বল!”

ঝুমুর আবীরের চোখে তাকালো।

“নিয়ে আসবি প্লিজ?”

একটু হাসলো আবীর।

“আমি নিয়ে আসবো।”

ঝুমুরের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ক্লান্ত লাগছিল আবীরের। খুব ঘুম পাচ্ছে তার, গাঢ় ঘুম! আবীর হাঁটতে থাকে সামনের দিকে। আর্টস বিল্ডিঙের পাশের খোলা জায়গায় কড়ই গাছটার নিচে কেউ নেই। ধুলো মাখানো ঘাসে শুয়ে পড়ে সে। অনেক ওপরে দুপুরের গাঢ় রোদ ম্লান হয়ে আসছিল দমকা বাতাসে উড়ে আসা পাতার ফাঁকে ফাঁকে। ঝুম দুপুরের ঝকঝকে আকাশে উড়তে থাকা পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে আবীরের মনে হচ্ছিল, সে যেন তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ অন্ধকারের পর, অতল অন্ধকারে।

রাতগুলো মাঝে মাঝে খুব দীর্ঘ মনে হয় নিনার। গরমের এই রাতগুলোয় দখিনের একটা খোলা বারান্দায় দাঁড়াতে খুব ইচ্ছে হয় তার। কখনো কখনো পৃথিবীর শেষ মানবীর মতো সুতোহীন শরীরে চাঁদের তীব্র আলোতে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, নিনার শখ পূরণ হয় না কখনো। সে বন্ধ জানালার এপাশে তার ঘামে ভেজা শরীরে সঙ্গ দেয় নিজেকে। বাবার কড়া নিষেধ, রাতে জানালা খুলে রাখা যাবে না। পাশের হোস্টেলের ছেলেগুলোকে খুব অপছন্দ জামাল সাহেবের। নিনা তার ভেতরে কীরকম একটা অদ্ভুত অনুভূতি টের পায়। বিছানার এলোমেলো চাদরে হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। মাঝরাতে অপরিচিত নাম্বারের অর্থ বোঝে নিনা। কিন্তু আজ তার কিছু ভাললাগছে না। নিনা ফোন তুলে নেয়।

“হ্যালো!”

ওপাশে নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায় শুধু। নিনা অপেক্ষা করে। কোনো কোনো রাতে ফোনের ওপাশে থাকা অপরিচিত মানুষটিকেই কেন যেন খুব পরিচিত মনে হয়। দুটি মানুষ নিশ্বাসের শব্দে পরস্পরকে চিনে নেয় একটু একটু করে। ছেলেটি বলে,

“আপনি রূমীর কবিতা পড়েছেন কখনো?”

নিনার জিজ্ঞেস করার কথা ছিল, “আপনি কে বলছেন?” কিন্তু তার ইচ্ছে করে না কিছু জানতে। সে শুধু বলে,

“না।”

“আমি পড়েছি। আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে। শুনবেন?”

নিনা উত্তর দেয় না। শুধু ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলে।

To praise is to praise

how one surrenders

to the emptiness.”

ভরাট কণ্ঠ ছেলেটির। তার উদ্ভট কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগছিল না নিনার। সে প্রশ্ন করে,

“এর মানে কী?”

“আমি নিজেও খুব ভালো করে বুঝিনি। মনে হয়েছে- When we praise, we praise those things which have come from nothingness and one day will be lost into nothingness again. Yet we, who came from dust and dust will be one day, praise those things with all our heart. Though we know, that we are praising the objects of nothingness, we barely can resist. We just surrender to our desire and nothingness…”

“আপনি কী সবসময় এরকম উদ্ভটভাবে কথা বলেন, নাকি এখন ভাব নেয়ার জন্য বলছেন?”

“আজকে কাউকে এই লাইনগুলো শোনাতে খুব ইচ্ছে করছিল।”

“একটা ছেলে ফোন ধরলেও কী আপনি এই লাইনগুলো শোনাতেন?”

ছেলেটি একটু হাসে।

“আপনার আগে আরও তিনজনকে ফোন করেছি। কাউকে কবিতা বলিনি।”

“আপনি তো দারুণ নির্লজ্জ!”

“আপনার কি কখনো ইচ্ছে করে নি, কোন রাতে হুট করে অচেনা কারো সাথে কথা বলতে, যাকে কখনো দেখেন নি, যে জানে না আপনি কে, যার সাথে কোন কিছু না ভেবে, কোনো হিসেব না করে কিছুক্ষণ কথা বলা যায়? শুধু কথা বলা যায়?”

নিনা চুপ করে থাকে। তার ভাললাগে। নিজেকে মনে মনে শাসন করে সে। এভাবে ভাললাগা অন্যায়। তবুও ভাললাগে। কেন, কে জানে। ছেলেটি চুপ করে আছে। নিনা বলে,

“আপনি এখনো আপনার নাম বলেন নি।”

“আমার নাম আবীর।”

হঠাৎ আবীরের মনে হতে থাকে, কোথায় থেকে যেন অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের আওয়াজ আসছে… খুব দ্রুত কাছে চলে আসছে শব্দটা, যেন তার বিছানার পাশেই প্রচণ্ড শব্দে বেজে উঠছে সাইরেন। ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আসছে ঘর, নিশ্বাস নিতে পারছে না আবীরবুক চেপে ধরে বিছানা থেকে পড়ে যাচ্ছে সে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে তার ঘুম ভেঙে যায়। …চোখ খুলে চারপাশটা কেমন অন্ধকার লাগে, ধুলোয় ভর্তি চারিদিক মাঠের ঘাসে শুয়ে আছে আবীর। একটা অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যাচ্ছে মাঠের ভেতর দিয়েই। আর্টস বিল্ডিঙের পাশের গলিতে দ্রুতগতিতে ঢুকে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সটার দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে সে। কিছুক্ষণ তার মনে পড়ে না, সে কোথায়। মুখ তুলে ওপরে তাকিয়ে দেখে, কড়ই গাছটার পাতার ফাঁকে বিকেলের রোদ নরম হয়ে এসেছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে? এতদিন আগের সেই রাত আজ কেন স্বপ্নে দেখলো আবীর, সেটা সে বুঝতে পারে না । গাছের পাতাগুলো নড়ছে না একটুও, বাতাস থেমে গেছে অনেকক্ষণ। কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গরম। আকাশে তাকিয়ে দেখে, মেঘ জমছে দূরে। মেঘের ডাকের অপেক্ষা করছে আবীর। পকেটের ভেতর থেকে ফোন বের করে নিনার নাম্বারটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে।

“ঝড় আসছে।”

“দেখেছি। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।”

“তোর জন্য আমি খোলা মাঠে বসে আছিতুই আসবি?”

“প্রথম দিনের মতো?”

আবীর হাসে।

“হ্যা। প্রথম দিনের মতো।”

“তুই তো সবসময় লেট করিস!”

“আজকে আমি অপেক্ষা করছি।”

“একটা শাড়ি কিনে দিবি আমাকে? নীল শাড়ি?”

“তুই না লাল শাড়ি পরবি?”

“তুই তো নীল ভালবাসিস!”

“আর তুই?”

নিনা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,

“আমি তোকে ভালবাসি আবীর।”

আবীর চুপ করে থাকে। নিনার নিশ্বাস গাঢ় হয়ে আসছে।

“কি রে? ভয় পেলি?”

আবীর বলে,

“তুই-”

নিনা হেসে ফেলে, ও হাসতেই থাকে। কোনরকমে বলে,

“তুই এতো বোকা কেন আবীর? দেখ ঝড় শুরু হয়েছে!”

ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে নিনার হাসি শোনা যায়; সে সমস্ত শরীর দিয়ে হাসছে।

এভাবেই কথা বলে যায় দুজন। ঝড়ের আগে, বৃষ্টির পর। প্রথমদিন কথা বলার পর ওদের মনে হয়েছিল, অচেনা কারো সাথে এভাবে কথা বলাটা খুব মন্দ নয়। কেউ কাউকে জানে না, কেউ কাউকে দেখে নি, ওদের প্রতিদিনের ধুলোমাটির জীবনে একজনের কাছে আরেকজনের অস্তিত্ব নেই। একজনের কাছে বলা কথা আরেকজনের জীবনের কোন তারে কখনো টোকা দিতে আসবে না। বাইরের পৃথিবী যখন ওদের দম বন্ধ করে দেয়, তখন ওরা একজন আরেকজনের কাছে নিশ্বাস নেয়, নিজেদের গড়া পৃথিবীতে। একজন আরেকজনকে কখনো দেখতে চায় নি, কেউ কারো বন্ধন হতে চায় নি। শুধু প্রতিদিনের অসংখ্য না পাওয়ার মাঝে দিন শেষে ফিরতে চেয়েছে সুখের কাছে, হোক না সেটা কল্পনায়। ওরা ভেবেছিল, ধুলোমাটির জীবনে ওপাশের মানুষটাকে টেনে আনলে একদিন হয়তো প্রচণ্ড বৃষ্টির পর ধুয়ে মুছে যাবে সব। ওরা তাই বাঁচতে চেয়েছিল নিজেদের নিয়মে।

.

দরজা খুলে প্রায় অন্ধকার ঘরটায় পা রাখে আবীর। বাইরে মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। অফিস থেকে ফেরার এই সময়টায় খুব ভীড় থাকে বাসে। জ্যামে বসে ঘুমিয়ে কেন যেন আরও ক্লান্ত লাগে আবীরের। ক্লান্ত হাতে টাইয়ের নটটা খুলতে খুলতে ওয়ারড্রোবের দিকে এগিয়ে যায় সে। আকাশী নীল রঙের কার্ডটার গায়ে ধুলো জমেছে। আজ নিনার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার কথা তার। এতদিন পর, অবশেষে। অপেক্ষা শেষ হবে একটু পরই। আবীর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়, ঘরে ফেরা পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে তৃষ্ণার্তের মতো। পাখা ঝাপটানোর শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ফোনের ওপাশে নিনার গলা খুব উত্তেজিত শোনায়। মনে হয়, অনেক ভীড়ে দাঁড়িয়ে আছে নিনা।

“কী রে? কখন রওনা দিচ্ছিস? রাস্তায় কিন্তু অনেক জ্যাম। একটু আগে রওনা দে।”

আবীর হাসে। নিনা বলে,

“হাসছিস কেন? তোর কি মনে হচ্ছে আমি এমনি এমনি বলছি? ঠিক আছে! আমার কী? দেরী করে আসলে খাবার পাবি না। আমার গিফটটা কিন্তু আনতে ভুলিস না।”

“আমি মনে হয় আসবো না রে।”

খুব তীক্ষ্ণ শোনায় নিনার কণ্ঠস্বর,

“কেন?”

“এমনি! ভাললাগছে না।”

ফোনের দুপাশে একজনের আরেকজনের নিশ্বাসের শব্দ শোনে। ঘরে ফেরা পাখিদের ডাক থেমে আসছে একটু একটু করে। নিনা ফিসফিস করে বলে,

“আমার বিয়েতে আসতে যে তোর ইচ্ছে করবে না, সেটা তুই আগে কেন বুঝিস নি আবীর?”

বাতি জ্বালিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে শহরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরটা আর দেখতে পায় না আবীর। অন্ধকার ছড়িয়েছে ক্রমশ এঘর থেকে ওঘরে। খুব চেনা একটা সুর বাজছে কাছেই কোথাও। সে কান পেতে থাকে সন্ধ্যার বাতাসে।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment