মেলবোর্নে মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মেলবোর্নে মুহম্মদ জাফর ইকবাল

দুই সপ্তাহ ধরে দিন গুনছিলাম, ১৪ সেপ্টেম্বরে জন্য। প্রিয় লেখককে দেখতে পাব! না জানি কেমন হবে দেখাটা। কথা বলতে পারব তো! ছবি তোলার সুযোগ পাব তো! মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, কী বলব, কীভাবে বলব। সাজানো কথাগুলো এলোমেলো হয়ে গেল লেখককে মুখোমুখি দেখে।

বলছিলাম মেলবোর্নের গ্লেন অয়েভারলি কমিউনিটি সেন্টারে বাংলা সাহিত্য সংসদের আয়োজনে হয়ে যাওয়া সাহিত্যসন্ধ্যার কথা, যেখানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি সংগঠনগুলোর ওয়েবসাইটে মাঝেমধ্যে চোখ রাখি। সংগঠনগুলো দেশ থেকে প্রায়ই গানের শিল্পী, নাটকের শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানায়, জমজমাট অনুষ্ঠানের ছবিও দেখি মাঝেমধ্যে। কখনো সেসব অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি, ইচ্ছেও তেমন একটা হয়নি। কিন্তু জাফর ইকবাল আসছেন মেলবোর্নে, এই খবর দেখে ছকবাঁধা রুটিনের বাইরে যেতে ইচ্ছে করল ভীষণ। প্রবেশমূল্যও নাগালের মধ্যেই। গুগল ম্যাপ আর মেটলিংক দেখে ‘ভ্রমণ পরিকল্পনা’ করে ফেললাম আমার মেয়ে নাজিফার আব্বুসহ। আমার মেয়ে শনিবারের ছুটিটা তার প্রিয় কার্টুন (ডোরা কিংবা ফেয়রি টেল) দেখে কাটাতে ভালোবাসে। ওকে যখন আমাদের বিশেষ ভ্রমণের কথা জানালাম, প্রথমে হতাশ হলো। পরে বলল, ‘হাউ ডাজ হি লুক?’ লেখকের সায়েন্স ফিকশন সমগ্র আছে ঘরে। মলাটের শেষ ভাঁজে তাঁর ছবি। তাই দেখালাম আমার সাত বছরের মেয়েকে।

১৪ তারিখ সকাল। দারুণ সুন্দর ঝকঝকে রোদ। মেলবোর্নে এর দেখা প্রতিদিন মেলে না। বেলা দুইটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। বাস-ট্রেন-বাস—এরপর মিনিট পাঁচেক হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছালাম। সামনের সারিতে আসন গ্রহণ না করে জাফর ইকবাল দর্শকদের মধ্যে মিশে গেলেন। সবাই তাঁকে রীতিমতো ঘিরে ধরেছে। সবার হাতেই তো ক্যামেরা। বিরতিহীন ছবি উঠছিল। আমার পা দুটো যেন নড়ছিল না। নাজিফার বাবা বলছিল, এখনই না গেলে আর সুযোগ পাবে না। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি যদি তুলতে না পারি, তাহলে তো সবই মাটি। বিড়বিড় করে কিছু বলেছিলাম, তিনি শুনতে পেয়েছেন কি না কে জানে। তবে ‘আমার মেয়েকে নিয়ে এসেছি আপনাকে দেখতে’, এ কথা তিনি শুনেছিলেন নিশ্চয়। তিনি আমার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর হাসিমুখে আমার পরিবারের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য পোজ দিলেন।

মনে পড়ে গেল একটি ঐতিহাসিক ছবির কথা—কবিগুরুর পাশে বালক সত্যজিৎ। আমার মেয়ে যদি একদিন বিখ্যাত কেউ হয়, তাহলে এই ছবিটাও তো ইতিহাস হবে। এটা কেবলই একটা ভাবনা, কোনো স্বপ্ন নয়। ও ভালো থাকলেই হলো। বইয়ের নেশা ওর এখনই। আমার স্বপ্ন একটাই—বই পড়ার পাশাপাশি আমার মেয়ে লেখককেও ভালোবাসুক, তার মায়ের মতো করে, বাংলাদেশের লাখোকোটি বইপ্রেমীর মতো করে। এই আবেগ মেলবোর্নে থাকলে ওর মধ্যে আসবে কি? এখানে বড় হয়ে উঠলে ও কি বুঝতে পারবে—কেন জাফর ইকবালের কথা শুনে বড় মানুষগুলো এত মজা পাচ্ছে, আনন্দ পাচ্ছে। লেখক তো ম্যাজিশিয়ান নন, তবু মানুষগুলো কেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে! কতক্ষণ তিনি কথা বললেন, কেন সময় দেখার কেউ প্রয়োজনই মনে করেনি; সঞ্চালকের কাছ থেকে পাওয়া সময়টা পার করে যখন মঞ্চ ছেড়ে নেমে গেলেন, তখন কেন মনে হচ্ছিল, আরও কিছুক্ষণ কেন তিনি কথা বললেন না!

লেখক তাঁর বক্তৃতায় আমাদের দেশের খ্যাপাটে পাঠকদের পাগলামির অনেক গল্পও করছিলেন। মেয়েকে এই ভালোবাসার পাগলামি শেখানোর জন্যই আমরা দেশে ফিরে যাব, কেবল ডিগ্রিটা মেলার অপেক্ষায়। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েও সাহস আর শক্তি নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হাতটা ওঠাতে পারিনি। রাজ্যের জড়তা এসে ভর করেছিল আমার ওপর। আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের পক্ষে এমন আচরণ বেমানান হলেও আবেগপ্রবণ পাঠকের সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায় হয়তো।

সালমা বিনতে শফিক


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment