মৃত্যুর দুয়ারে নারী: কার গালে চড় মারি!

মৃত্যুর দুয়ারে নারী: কার গালে চড় মারি!

মৃত্যুর দুয়ারে নারী: কার গালে চড় মারি!

দিলরুবা শাহানা

মনটা যখন খুশীর ধারায় স্নাত ছিল তখনি ঘটনাটায় ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হলাম। আমি মানুষটা সহজে অন্যের কষ্টে নিজেও কষ্ট পাই আবার অন্যের আনন্দেও আনন্দিত হই। আমার পর্যবেক্ষণ বলে আনন্দ ক্ষনকালীন, উধাও হয়ে যায় পলকে। দুঃখকষ্ট ছাপ রেখে যায়, অন্তত ভুলতে দেয় না বা ভোলা যায় না সহজে। সমব্যাথী হওয়া ও সহমর্মিতা আছে বলেই মানুষ শ্রেষ্ঠ। কবি-সাহিত্যিকেরা দুঃখের আরেক মাত্রাও অনুভব করতে পারেন। যেমন কবি Shelley র উপলব্ধি হল “Our sweetest songs are those that tell of saddest thought”, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেন “দুখেরও মাধুরীতে করিল দিশেহারা”।

তবে যে ঘটনা জানলাম, টিভিতে দেখলাম যা এখানে উপস্থাপিত হবে তাতে কোন মাধুরী নেই, মিষ্টত্ব নেই আছে শুধু তিতা আর তিতা অনুভব।

একজন মা। ছোট ছোট তিনটি সন্তান। ছোটটির বয়স সবে একবছর। আপাতঃ দৃষ্টিতে সুস্বাস্থ্য ও পরিপাটি বেশবাশ। দেখে কিছুই বোঝা যায় না। টিভির পর্দায় দেখা গেল একবছরের সন্তানটিকে দুধ খাওয়াচ্ছে সে নারী। বুক খুলে নয় বোতলে। প্রকৃতি মাকে ধন্য করেছে বক্ষ সম্পদে অথচ এই হতভাগী তার সন্তানের মুখে তুলে দিতে পারছেনা বুকের অমৃতধারা। কারন কঠিন অসুখ তার। জটীল ধরনের ক্যান্সার। অপারেশন ছাড়া আর কোনো বাঁচোয়া নেই। জরুরী অপারেশনের জন্য সে তালিকাভুক্ত। ছয়মাস হয়েছে সে অপারেশনের সারিতে দাড়িয়ে। যদি এখনই অপারেশন না হয় তবে সে বড়জোর ছয় সপ্তাহ আর বাঁচবে! উন্নত ও ধনী দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও অপারেশন করা যাচ্ছে না। কারন সরকার স্বাস্থ্যখাতে খরচ সংকুচিত করেছে। এই বিষয়ে একমাত্র সার্জন যিনি তিনিও কুনিচত কপাল, হতাশ ও ঘর্মাক্ত মুখে টিভির ক্যামেরার সামনে বিরক্তি ঢাললেন। মনে হচ্ছিল ভয়ে ঘামতে ঘামতে ও অসহায় রাগে দমবন্ধ হতে হতে মাইকেল মুরের ছবি ‘সিকো’ বা অস্কার পাওয়া অভিনেতা ডেনজল ওয়াশিংটন অভিনীত ছবি ‘জন কিউ’ দেখছি। প্রশ্ন জাগলো ঐ নারী যার তিনটি অবুঝ শিশু রয়েছে তার বেঁচে থাকাটা কি জরুরী নয়? ক্যান্সার তাকে কেড়ে নেবে? ক্যান্সার রোধে কত রকম গবেষণা যে চলছে তবুও এই রোগকে বাগে আনা যাচ্ছে না। তবে চিকিৎসার নানা ব্যবস’া রয়েছে। রোগটা শুরুতে ধরা পড়লে ও তক্ষুণি ব্যয়বহুল চিকিৎসা শুরু করতে পারলে ভালও হয়ে যায়। সমস্যা হল ক্যান্সার অসুখটা ধরা পড়ে না সহজে। আবার কারও যদি শুরুতে ধরা পড়েও চিকিৎসার খরচ মেটানোর সাধ্য না থাকলে মৃত্যুই হয় তার চূড়ান্ত গতি। কিন্তু ধনাড্য কল্যাণকামী(ওয়েলফেয়ার) রাষ্ট্রে এমনতো হওয়া উচিত নয়? কেউ কেউ হয়তো বলবেন হেলথ্‌ ইন্স্যুরেন্স করা থাকলে সমস্যাটা হতো না। আসলে স্বাস’্য চিকিৎসা ও শিক্ষাকে যখন বানিজ্যিক পন্য করা হয়েছে এবং দিনে দিনে আরও করা হচ্ছে তখন হেলথ্‌ ইন্স্যুরেন্সতো থাকতেই হবে। তবে হেলথ্‌ ইন্স্যুরেন্সের ভয়ংকর দিক দেখিয়ে মাইকেল মুরের ছবি ‘সিকো’ বিরাট নাড়া দিয়েছে।

একবার মনে হল ঐ স্পেসালিস্ট সার্জনতো অপারেশনটা করে দিলে পারে? মেয়েটা হয়তো বেঁচে যেতো। ভদ্রলোকের কথা শুনেও মনে হয়েছে অপারেশন করতে পারলেই সে খুশী হতো। তবে অনেকের সাথে কথা বলে বুঝেছি ব্যাপারটা একলা স্পেসালিস্ট সার্জনের সাধ্য নয়। উপযোগী পরিবেশ, দক্ষ সহযোগী সহকর্মি দরকার তা না হলে মহৎ ডাক্তার বিনা পয়সায় নিজ ড্রইংরুমে কত অপারেশন করতে পারতো। দুঃখজনক ভাবে যা কখনই সম্ভব নয়।

এক ডাক্তারের আন্তরিকতার ঘটনা মনে পড়লো। এক মা তার কিশোরী মেয়ের শরীরে চামড়ার নীচে একটু গভীরে ‘এ্যালিয়েন’ বাসা বানিয়েছে শুনে পাগলপারা। ছোট্ট মাংশপিন্ড। তাতেই যত অশান্তি, যত আশংকা। ডাক্তার থেকে স্পেশালিষ্ট সার্জন। তারপর নানা পরীক্ষানীরিক্ষা। পরীক্ষানীরিক্ষা শেষে দেখা গেল ছোট্ট মাংশপিন্ড বা টিউমারটি বিনাইন, ম্যালিগন্যাণ্ট নয়। অর্থাৎ ক্যান্সারাস নয়। স্পেসালিস্ট সার্জন জানালেন যে অপারেশন করা জরম্নরী নয়। তবে একসময়ে অপারেশন করিয়ে নেওয়াই ভাল। ভদ্রলোক আরও জানালেন সরকারী হাসপাতালে করাতে চাইলে বছর দুই অপেক্ষা করতে হবে। হেলথ্‌ ইন্সুরেন্স আছে শুনে অপারেশন করানোর সিদ্ধানত্ম নেওয়া হল। মেলবোর্নের মেলভার্ন এলাকায় অভিজাত প্রাইভেট হসপিটাল ক্যাবরিনি। মা গেলেন সেখানে। হসপিটাল হেলথ্‌ ইন্সুরেন্সের হাই ক্লাস কভারেজ দেখে চট্‌ করে অপারেশনের তারিখ দিয়ে দিল। মাত্র দশমিনিট লাগবে অপারেশনে। তবে প্রাইভেট হসপিটাল তাই ব্যাপার স্যাপার রাজকীয়। ডে সার্জারী তবুও রুম, নার্স, টিভি, বেডসাইড টেবিলে তাজা ফুল সব কিছুর সুন্দর বন্দবস্ত থাকবে। অপারেশন মাত্র দশমিনিটের। তিন চিকিৎসক সেবা দেবেন। প্রথমজন হাইপার টেনশন স্পেশালিষ্ট প্রথমে প্রেসার ঠিক আছে কিনা যাচাই করবেন। প্রেসার ঠিক থাকলেই অপারেশন শুরু করা যাবে। তারপর আনেসথেসিস্ট। অজ্ঞান করা ও অবশ করা ইনার কাজ। সবশেষে কাটাছেড়া করবেন স্পেশালিষ্ট সার্জন। সার্জনের নাম দেখে মায়ের মনে ভয় ধরলো। প্রশড়ব করলেন যে সার্জন তাদের এই হসপিটালে পাঠালেন তিনি কই। হসপিটাল জানালো ঐ স্পেশালিষ্ট সার্জন এই হসপিটালে যুক্ত নন। ইন্সুরেন্স কোম্পানী ঐ স্পেশালিষ্ট সার্জনের খরচ বহন করবে না। তাকে দিয়ে অপারেশন করাতে হলে নিজের পকেট থেকে পয়সা দিতে হবে। ভদ্রমহিলা ইন্সুরেন্স কোম্পানীর মারপ্যাঁচ দেখে হতভম্ব। ছুটে গেলেন ঐ ভদ্রলোকের কাছে যার উপর তার অগাধ আস্থা সেই সার্জনও ইন্সুরেন্স কোম্পানীর লিস্টে তার নাম নেই জানালেন। যে কারনে হসপিটাল তাকে ডাকবে না। ভদ্রমহিলার হতাশ অবস্থা দেখে সার্জন অপারেশন করবেন বলে রাজী হলেন। তার অপারেশন চার্জটাও কয়েক কিস্তিতে কয়েক মাসে শোধ করার উপায় মহিলাকে বাতলে দিলেন। হেলথ্‌ ইন্সুরেন্স থাকা সত্ত্বেও দশমিনিটের সামান্য অপারেশনের জন্য হসপিটালের একসেস ফি ও নিজস্ব পছন্দের সার্জনের জন্য ভদ্রমহিলাকে হাজার ডলারের উপর খরচ করতে হয়েছিল। অবাক কান্ড হল হেলথ্‌ ইন্সুরেন্স বছর শেষে চিঠি পাঠাল যে তারা হসপিটালকে দিয়েছে ৩৫০০ডলার ঐ অপারেশনের খরচ বাবদ। তারপরও ভদ্রমহিলা ঐ স্পেশালিষ্ট সার্জনের প্রতি কৃতজ্ঞ নগদ পয়সা হাতে না পেয়েও অপারেশনটা করেছিলেন বলে।

শুনেছি আমেরিকায় হোমলেস ভবঘুরেরও হেলথ্‌ ইন্সুরেন্স আছে। না থাকলে উপায় নেই। তবে ইমারজেন্সি বিভাগে যদি কেউ গুরম্নতর খারাপ অবস্থায় যায় এবং হসপিটাল তাকে ভর্তি করতে বাধ্য হয় তখন হসপিটালে তার চিকিৎসা করা আইনী ও নৈতিক দায়িত্ব। প্রশ্ন হল কয়জন ইমারজেন্সি বিভাগে যায়? চিকিৎসা বানিজ্য(প্রাইভেট হেল্‌ কেয়ার, ইন্সুরেন্স ইত্যাদি মোড়কে) মুনাফা আনে প্রচুর তাই আমেরিকার এফোর্ডেবল কেয়ার এ্যাক্ট যার আরেক নাম ওবামা কেয়ার পাস হলনা!


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment