মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন?

মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন?

শহরের প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত বিশালাকার স্থাপত্য শিল্প নিদর্শন মেলবোর্ন একজিভিশন কেন্দ্রে বসে যখন দেশের কথা ভাবছি তখন ফেসবুকে চোখ রাখতেই নজরে এল আবার হরতালের হুমকি। এ হরতাল হবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ আরও সম্পদ ধ্বংস ও মানুষ পুড়িয়ে মারা! নিজের কাছে প্রশ্ন রাখলাম: মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন?

মেলবোর্ন একজিভিশন ১৮৮০-৮১ সালে নির্মিত। এখানে একটি আন্তর্জাতিক একটি শিল্পমেলা আয়োজনে নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রায় দশ লক্ষ দর্শক সেই মেলা দেখতে এসছিলেন। এখানে আমি এসেছি পরীক্ষার ইনভিজিলেশান দিতে। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সেমিষ্টারের পরীক্ষা চলছে। এক সঙ্গে একই ছাদের নিচে তিন হাজার ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষা দিচ্ছে এই হলটিতে। আমি ছাড়া সবাই দেশের সিনিয়র সিটিজেন। তারা তাঁদের ৩য় ও ৪র্থ জেনারেশানের ছেলে-মেয়েদের সেবা করতে এসেছে। দারুণ এক ভালবাসার সম্পর্ক। দক্ষিণ পাশে আছে মেলবোর্ন মিঊজিয়াম ও আইম্যাক্স সিনেমা হল। এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। এক নিখুঁত পরিকল্পনার ছাপ। মুগ্ধ হয়ে ভাবি আর মনে মনে বলি কি হতভাগ্য আমরা।

ছোট বেলায় মাইকেল মধুসুদনের কবিতাটি পড়েও আমার এই দশা। বিদেশে বসে দেশকে নিয়ে ভাবা কি তবে একধরণের বিলাসিতা? গুরুজনের অভিমত, বিশ্ব এখন বিশ্বায়িত। তাই পৃথিবীর যেকোন জায়গা থেকে দেশের সেবা করা যায়। তাই শত কষ্টেও বিদেশে পড়ে থাকা। কিনতু মনতো মানে না। মনে হয় আরেকবার লড়াই করতে হবে। এভাবে হরতাল দিয়ে জাতির ভবিষ্যত নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। কোন বিবেকবান মানুষ স্থির থাকতে পারে না যদিও জাতির বিবেক বলে পরিচিত সুশীল সমাজ সরকারকেই দোষারোপ করে চলেছেন ।

সামরিক শাসক এরশাদ আমাদের জেনারেশানের যৌবনের তিনটি বছর কেঁড়ে নিয়েছে । তাই আমি চেয়েছি কারো জীবন থেকে যেন এভাবে বিষাক্ত রাজনীতি মূল্যবান সময় না কেড়ে নিতে পারে। ১৯৯০ তে গণঅভ্যুথানের পর মুক্তির নি:শ্বাস ফেললাম। ১৯৯১ সালে দেশে গণতন্ত্র এল। কিনতু হায় কপালে আবার ফিরে এল হরতাল। আজও সেই হরতালের রাজত্বে বাঙালির বসবাস। দেশ যেন হাসফাস করছে এই জগ্গদল হরতাল থেকে মুক্তির জন্য। কেঊ কি নেই ওদের শাসন করবার?

আমার দু:খ হল- মেলবোর্ন একজিভিশন কেন্দ্রর মতন একটি জায়গা আজও আমরা নির্মাণ করতে পারিনি। অথচ ১২৩ বছর আগে এই বিশাল স্থাপনা নির্মিত বৃটিশ শাসকদের চেষ্টায় যখন এই মহাদেশে জনসংখ্যা খুবই কম ছিল। আমরা কেন পারিনি তা অনুসন্ধান করলে এক বাক্যে বলা যাবে – এজন্য আমাদের আত্মঘাতী রাজনীতি দায়ী। আমরা সিরাজদৌলাকে হত্যা করে এনেছি বৃটিশ শাসন, আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাজাকার এনে মুক্তিযুদ্ধর সব নিশানা মুছে ফেলেছি। আজ যখন সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুন:প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে তখন হতভাগা জনতা আগুনে পুড়ে মরছে। কি বর্বরতা!

আমার লেখা পড়ে হয়তো পাঠক মনে করবেন প্রবাসে আমরা যারা আছি তারা বাস্তবতাকে হয়তো উপলব্ধি করতে পারছিনা বলেই একটি পক্ষকে অন্ধ সমর্থন করে লিখেছি। কিনতু এ কথাতো মিথ্যে নয়- যে সময়ে আমি অষ্ট্রেলিযায় সেমিষ্টার শষে পরীক্ষা চলছে ঠিক সেই সময় আমার দেশের লক্ষ লক্ষ শিশু- কিশোর-কিশোরী- তরুণ-তরুণী হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে রাজনীতিবিদদের শুভ বুদ্ধির কামনায়। আপোষহীন শিরোপা অক্ষুন্ন রাখতে বা পুণ: উদ্ধারে বিরোধীদলীয় নেত্রী মরিয়া। প্রতিয়মান হয় হরতাল আর মানুষ পোঁড়াও নীতি হল বিরোধীদলীয় বর্তমান রাজনীতি! মা ধরিত্রি তুমি দ্বিধান্বিত হও।

একান্ত এক সাক্ষাৎকারে ১৯৮৭ সালে প্রায়ত রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী উপাচার্য জীবনে একটি ঘটঁনা বলতে গিয়ে বলেছিলেন বিখ্যাত এক ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধার কথা। ওই মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের নিয়ে উপাচার্য চৌধুরীর কাছে এসেছিলেন পরীক্ষা পেছানোর অনুরোধ নিয়ে। উওরে তিনি বলেছিলেন মা যেমন সন্তানের মুখে বিষ তুলে দিতে পারে না, তেমনি আমি পরীক্ষা পেছাতে পারি না। আজ কি বলবেন বেগম জিয়া সম্পর্কে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি? কেমন মা তিনি? তিনি জানবেন না সরকার-জনগণ-মিডিয়া আকুল আবেদন করেও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে দমাতে পারেনি। ৮৪ ঘন্টা হরতাল হয়েছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। পরীক্ষা দেওয়া হয়নি কারোও। তবে তিনি ধনীদের পরীক্ষা হরতালমুক্ত রেখে ছিলেন।

হযরত ইব্রাহীম নিজের সন্তানকে কোরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন আল্লাহকে খুশি করতে। বিরোধীদলীয় নেত্রী জাতিকে সেবার কথা বলেন তবে জাতিকে খুশি করতে হরতাল প্রত্যাহার করতে পারলেন না। অথচ তারই পদতলে ইসলাম কায়েমের স্বপ্ন নিয়ে হেফাজত ও জামায়ত বন্দনা করে। আর তিনি নিজ পুত্রদের পবিত্রতা রক্ষা করতে জাতি মুখে নোংরা রাজনীতির নোংরা হরতাল ছুড়ে দিচ্ছেন। কারণ আদালত রাজপুত্রের রায় দিয়েছে। আর শুধু হরতালই দিয়েই ক্ষান্ত হননি, হরতাল সফল করতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারছে মানুষ দলের সন্ত্রাসীরা। এই নিষ্ঠুর মানুষ হত্যার দায় কি তিনি এড়াতে পারবেন? এঁটাই কি জনগণের প্রতি ভালবাসা ও দেশপ্রেম?

পত্রিকা ও ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আলী রিয়াজের ফেসবুক থেকে জেনেছি মার্কিনীরা মনে করছে দেশ একটি দীর্ঘ মেয়াদী অন্তবরতিকালিন সরকারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কারণ যেভাবে ধবংশের রাজনীতি শুরু হয়েছে সে সময় বিবেকবান মানুষ অলস বসে আনন্দ করবে না। কদিন আগে বিডিআর হত্যাকান্ডের রায় হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় এক অকুতোভয়ী সৈনিক মৃত্যুর আগে সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “মানুষতো একবারই মরে। তোমরা কেন ভয় পাচ্ছ।” সেই বীরের লাশ কাঁধে নিয়ে শপথ করেছেন দেশের লক্ষ সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হবে দেশ পরিচালনার শক্তি। তারা গণতন্ত্র ও শান্তির অতন্দ্র প্রহরী। তাই কিভাবে ওনারা প্রত্যাশা করেন সেই বীর সৈনিকরা আবার রাজাকার ও তাদের দোসদের স্যালুট দেবে?

বঙ্গবন্ধু যেমন জীবন দিয়ে দেশকে রক্ষা করেছেন জাতিকে, যেভাবে লক্ষ শহীদ জীবন দিয়ে মুক্তি ছিনিয়ে এনেছে, সেই ভাবেই জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় প্রতিজ্ঞা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জীবন দেবেন তবু রাজাকারের গাড়ীতে পতাকা দেবেন না- যে জঘন্য কাজটি বিরোধীদলীয় নেত্রী অবিরত করছেন। আমরা মনে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেবল একলা নন। সারা বিশ্বই আজ তার সাথে। কারণ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক চেতনায় বিপরীতে একটি সেকুলার বিশ্ব সবার প্রত্যাশা। আফগানিস্থান, পাকিস্থান, ইরাক, সিরিয়া এসবের উৎকৃষ্ট প্রমাণ। বিরোধীদলীয় উপদেষ্টারা সেই সত্য কতদিন উপেক্ষা করবেন? পতনের সময় কি ঘনিয়ে আসছে না।

যখন চলমান সমস্যা সমাধানের একের পর এক বিকল্প শেষ হয়ে যায় তখন সহজেই অনুমান করা যায় দেশ নি:সন্দেহে একটি দীর্ঘমেয়াদী অনর্বর্তীকালীন সরকারের দিকেই যাচ্ছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন। সবার সম্মতি পেলে একটি সর্বদলীয় সরকার হবে। আর সেই সরকারই দেশ চালাবে যতদিন বিরোদীদলীয় নেত্রীর জেদ ও অহঙ্কার চূর্ণ বিচুর্ণ না হয় এবং বাংলাদেশর রাজনীতি রাজাকার মুক্ত না হয়।

সমপ্রতি মিডিয়া ও রাজনীতিবিদরা অভিযোগ করেছেন সরকার জাতিকে বিভক্ত করে ফেলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গণজাগরণ মঞ্চ সমর্থন করে ও হেফাজতকে মাঠে নামতে দিয়ে। ভেবেছিলাম সেই অভিযোগ অসত্য প্রমাণে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখবার জন্য বুঝি সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তা্ব এসেছে। আমরা আশা করেছিলাম বিরোধীদল এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেবে এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখবে। কারণ তারাও নিজেদেরকে দাবি করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে। কিনতু সেই সম্ভাবনা হয়তো রুদ্ধ হয়ে গেছে লাগাতার হরতালে।

সরকারের সামনে এখন দু”টি পথ খোলা। একটি হল: যেভাবে সরকার বর্তমান উপদেষ্টাদের নিয়োগ দিয়েছেন সেই ভাবে নতুন ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত: বর্তমান মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিতে পারেন। বিরোধীদল তাতে সন’ষ্ট হবে কি? এরপর তাদের আরোও হাজারোও দাবি আসবে। তাই বর্তমান সরকার শেষ অবলম্বন হিসেবে বেছে নেবে একটি দীর্ঘমেয়াদী অনর্বর্তীকালীন সরকার। কারণ একক নির্বাচন গস্খহণযোগ্য হবে না। আর তাতে কারোও সম্মানও বাড়ছে না। আরও দু:ভাগ্যেও বিষয় হল শত ত্যাগ তিতিক্ষা ও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন একটি দেশের বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেস আলোচনা করতে যাচ্ছে যেখানে আমাদের এক বিজ্ঞ অধ্যাপকও থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন যেখানে মানুষ এখন পুড়ে মরছে? আর এভাবে আর আমরা কত অপমানিত হব বিশ্বের দরবারে? দেশে কি কেঊ নেই যারা পারে এই অপমান থেকে জাতিকে রক্ষা করতে?


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment