মিস ইউ বাংলাদেশ!

মিস ইউ বাংলাদেশ!

নানুবাড়ি যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে প্রস্তুতি শুরু করতেন আম্মা। প্রতিদিন আমার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান, ‘তোর পরীক্ষা শেষ হইতে আর কয়দিন বাকি?’

আমি তখন ক্লাস টু বা থ্রীতে পড়ি। ৩ টা মাত্র পরীক্ষা! সেবার পরীক্ষার মাঝখানে শুক্রবার আর একদিন কিসের যেন ছুটি গেল! আমি ঘাড় বাকিয়ে বললাম, ‘৩ দিন বাকী!’

আম্মা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘কি ছাতার পরীক্ষাযে হয়! শেষ হইতে বছর লাগে!’

– ‘এইগুলা কি কন আম্মা? পরীক্ষাতো হেইদিন শুরু হইলো?’

আম্মা এই কথার জবাব দেন না। তার বুকের ভেতর তৃষ্ণার পাখি ডানা ঝাপটায়, কতদিন বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখেন না! সময় যেন আর কাটে না।

শুধু আম্মার একার না, অপেক্ষা আমাদেরও। নানুবাড়ি গেলে অফুরন্ত স্বাধীনতা। পড়াশোনা নেই। বাড়িভর্তি আম, কাঁঠাল, জামরুল, পেয়ারা, লটকন, ডেউয়া, ডালিম, জাম, ডাব, তাল আরও কতকি গাছ! সেইসব গাছভরতি ফল। নানু সেইসব ফল যত্ন করে রেখে দেন, ‘তার নাতীরা আসবে! আহা! কত আনন্দ করেই না খাবে!!’

আর নানার আফসোস ভরা মুখ, ‘এতো কষ্ট করে তিনি বাড়ি করেছেন, এতো ফলের গাছ লাগিয়েছেন, অথচ আমরা কিনা নানাবাড়ি না বলে বলি নানুবাড়ি!’

নানু বাড়ি যাওয়ার দীর্ঘ পথ। তার পুরোটাই পায়ে হাঁটা। আব্বার দুই হাতে ভারি দুই ব্যাগ। আম্মারও। তার মধ্যে উল্টেপাল্টে আমাদের দুই ভাইকে কোলে নিতে হয়! এতো পথ আমরা হাঁটতে চাই না।

আম্মা আর আব্বার অবশ্য আমাদের হাঁটানোর নানান বুদ্ধি ছিল। আব্বা চেঁচিয়ে বলতেন, ‘ওই যে দূরে একটা শালিক, দেখিতো আমার দুই আব্বুর মধ্যে কে আগে গিয়ে ওই শালিকটা ধরতে পারে?’

আমাদের দুই ভাইকে আর কে পায়! আমরা তখন পুরোদস্তুর উসাইন বোল্ট। কে আগে শালিক ধরতে পারে? শালিকের কাছে পৌছাতে না পৌছাতেই শালিক হাওয়া। আমাদের জন্য তখন নতুন টার্গেট, দূরে ধবধবে সাদা কাশফুল! কে ছুঁতে পারবে সবার আগে সেই কাশফুল? আমরা আবার ছুটি। দুই পুচকা উসাইন বোল্ট… ভোরের আলোয় চকচকে মেঠো পথ। তার দুইধারে স্বপ্নের মতন আদিগন্ত হলুদ সর্ষে ফুল। গভীর নীল আকাশ। সেখানে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় সবুজ টিয়ে… টি… টি…

আমরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে যাই। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যায়। পথের ধারে ছোট্ট এক বাড়ি। ঝা চকচকে উঠোন। যেন এই মাত্র কেউ সোনার মাটিতে লেপে দিয়েছে। একপাশে ছোট্ট ছনের ঘর। সেই বাড়িতে আমরা ঢুকে পড়ি। আব্বা কয়েকবার গলা খাকড়ি দিয়ে শব্দ করেন! বাড়িতে ‘মেয়ে-ছেলে’ কি অবস্থায় আছে কে জানে!!

আম্মা গলা তুলে ডাকেন, ‘আছেন কেউ বাড়িতে? একটু পানি খাওয়াইবেন নি?’

ভেতর থেকে কেউ একজন বের হন। ৩৫-৪০ বছরের এক স্নিগ্ধ চেহারার নারী। তিনি উঠোনের কোনায় কাঁঠাল গাছের নিচে পিড়ি পেতে দেন। আমরা সেই পিড়িতে বসি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কই যাইবেন আপনেরা?’

– ‘সাহেবরামপুর।’ আম্মা জবাব দেন।

– ‘সাব্রামপুর?’ তিনি আবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে চান।

আম্মা জানেন, সাহেবরামপুরকেই সবাই সাব্রামপুর বলে। আম্মা বলেন, ‘হয়, সাব্রামপুরই, তয় আমরা যামু আরেকটু নামার দিকে, আমার বাপের দ্যাশ, কুরবিরচর?’

মহিলা আম্মার কাছে ঘন হয়ে আসেন, ‘এতদুর পথ এই পোলাপান লইয়া ক্যামনে হাইট্টা যাইবেন?’

আম্মা হাসেন কথা বলেন না। তিনিও না। তিনি চুপচাপ ঘরের ভেতর চলে যান। খানিকবাদে বের হয়ে আসেন। হাতে পানিভর্তি জগ, একটা মগ, আর একটা বেতের বড় বাটি। এইবাটিকে বলে জামবাটি। সেই বাটিভর্তি ঘরে ভাজা মোটা চালের লাল মুড়ি। আখের গুঁড়। তিনি আমাদের দুই ভাইয়ের হাতে সেই মুড়ি আর গুঁড় দিতে দিতে আম্মাকে বলেন, ‘অতদূর যাইবেন ভাউজ (ভাবী), দুইডা উরুম (মুড়ি) মোহে দিয়া যান। পোলা দুইডারও কষ্ট হইব। দুইডা উরুম খাইয়া এক মগ পানি খাইলে হাঁটতে একটু তাগত পাইবেন’।

আমরা দুইভাই ততক্ষণে মুড়ির বাটির উপর হামলে পড়েছি! আমাদের অবস্থা দেখে আম্মা যেন খানিকটা বিব্রত হন। আড়চোখে কটমট করে আমাদের শাসনও করেন। কিন্তু আমরা তখন তার থোড়াই কেয়ার করি!

বাড়ির কর্তা ভেতর থেকে হেঁকে বলেন, ‘তুমি খালি উরুমই দিলা? কত্তগুলা পথ হাইটটা যাইব হেরা, ঘরে আর কিছু আছে নাকি দ্যাহো’।

– ‘আর কি থাকবো? আরতো কিছু নাই’।

– ‘ক্যা? কাইল না হাটেরতন পাটালির গুঁড় আনলাম! দুইখান দুইভাইর হাতে দিয়া দেও। যাইতে যাইতে খাইব।’

আমরা গুঁড়-মুড়ি খেয়ে, পাটালির গুঁড় হাতে আবার নানুবাড়ির পথ ধরি। এবার নদীর পার ধরে দৌড়াই। দূরে পাল তুলে নৌকা যাচ্ছে। এবার ওই নৌকা পেড়িয়ে যেতে হবে আগে!

আমাদের পেছনে আম্মা আব্বা হাঁটেন। গুটুর গুটুর গল্প করেন। শীতের সোনারোদ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের শরীর। পায়ের ডগায় শিশির ছুঁয়ে হলদে সরিষার ফুল। নদীর জলে টুপটাপ লাফায় খলশে কিংবা পুঁটিমাছের দল। লাঙলের ফলায় জেগে ওঠে ঝরঝরে মাটি। সেই মাটি ছুঁয়ে কৃষকের দল যেন ডুবে যায় প্রাণে…

খানিক আগের সেই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের মানুষগুলার অপার মমতা নিয়ে আব্বা-আম্মা আর আলাদা করে কিছু ভাবেন না! ভাবার আছেটাই বা কি! অস্বাভাবিক কিছুতো ঘটে নি। এমন করে সবাই করে। আব্বা আম্মাও করেন। এই পথের ধারের প্রতিটি মানুষ এমন। ওই দূরের গ্রামগুলোর মানুষগুলোও এমন। ওই শিমুল গাছের নিচের মানুষটাও অমন। ওই নৌকার মাঝিও অমন। ওই গরুর পাল নিয়ে ছুটে চলা বৃদ্ধ মানুষটাও অমন। কলসি কাঁখে ছুটে চলা কিষাণ বঁধুটাও অমন। বুকের সবটা জুড়ে অপার মমতা, অদ্ভুত মায়া। এই মাটির মতই। এই মাটির মানুষগুলোই এমন। এমনই।

এরাই বাংলাদেশ!

সত্যিকারের বাংলাদেশ…

মিস ইউ বাংলাদেশ!

সত্যিকারের বাংলাদেশ।

সেই মাটি আর মানুষের বাংলাদেশ! বাংলাদেশ…

মিস ইউ…


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment