বিরোধীধলীয় নেত্রী একবার বলেই দেখুন আর হরতাল বা সহিংসতা নয়

বিরোধীধলীয় নেত্রী একবার বলেই দেখুন আর হরতাল বা সহিংসতা নয়

গণজাগরণ মঞ্চ মুক্তিকামী বাঙালি জাতির অহিংস আন্দোলনের একটি নতুন অধ্যায়। আজ রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে গণজাগরণ মঞ্চে সমবেত হয়েছেন দেশের আপমার ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক-জনতা, নারী ও শিশু। দাবী একটিই: ন্যায় বিচার। এর প্রতি সমর্থন না দিয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রীর বলেছেন: মঞ্চ টঞ্চ বন্দ না হলে জনগণের মঞ্চ হবে। বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়তো জানেন না আজকের তরুণ সমাজ ওই হুংকারে ভীত নয়। কারণ তাঁদের চেতনায় জ্বল জ্বল করছে মুক্তিযুদ্ধ ও ৩০ লক্ষ শহীদের স্বপ্ন: রাজাকার ও শোষণ মুক্ত একটি স্বাধীন সুখী বাংলাদেশ। আপনি এ ধরণের বক্তব্য দিয়ে নিজের রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে আপনি যে সম্মান পেতেন সেই সম্মানের জায়গাটি হারাতে কেন কুন্ঠিত নন তা আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন তা কি আপনি বুঝতে পারছেন না?

মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী আপনি কি ভুলে গেছেন, এমনি একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সূচিত হয়েছিল আমাদের মহান স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেদিন এদেশের মানুষ ৬ দফায় ও ১১ দফায় কেবল স্বাধিকার চেয়েছিল। কিন্তু সেই চাওয়া যখন পশ্চিমা শাসকদের ভাল লাগলো না তখন ফুঁসে ঊঠল বাঙালি। স্বাধিকারের সংগ্রাম থেকে মুক্তি সংগ্রাম। আর মুক্তি সংগ্রাম থেকে অর্জিত হল আমাদের স্বাধীনতা। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী আপনি কি দেখেন নি মুক্তিযুদ্ধের এই মাসে আজ জামায়ত শিবির নীরিহ জনগণসহ হিন্দুদের ওপর কিভাবে হামলা করছে? যেভাবে হামলা করছে তা জনগণকে স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে কি ভয়াবহ ভুমিকায় ১৯৭১ ও ২০০১ সালে রাজাকার ও পাকহানাদাররা অবতীর্ণ হয়েছিল। আপনি নিশ্চয়ই সেই বিভিষীকাময় দিনগুলির কথা ভুলে যাননি? ১৯৯১ সালে আপনি জিতেছিলেন, তখন কি আপনার প্রয়োজন ছিল দেশের জনগণের উপর হামলা করা? রাজনীতি হয় জনগণের তবে কি জনগণের বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোইতো কর্তব্য নয় কি?

বিরোধীদলীয় গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধীতা করলেও নিজেই একটি জনগণের মঞ্চ গড়ার হুমকি দিয়েছেন। এর আগে আরব বসন্তর সফলতা দেখে অনেকবার আপনি পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে তাহারী স্কয়ার বানাবার স্বপ্ন দেখেছেন। এবার আপনি মঞ্চর স্বপ্নও দেখলেন। জনগণের মঞ্চ আপনি গড়তেই পারেন। কিন্তু বিরোদীদলীয় নেত্রী এই শাহবাগের মহৎ আন্দোলনকে বন্ধ করবার হুমকি দিয়ে আপনি ৭১ এর রাজাকাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজের অবস্থান স্পষ্টতর করলেন কি? আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনেক তরুণ কিন্তু ওই জাগরণ মঞ্চে আছেন। তাদের সমর্থন ও জাময়ত-শিবিরকে সমর্থন কোন টি আপনার সেরা তা ভাববেন কি? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আছে আর্ন্তজাতিকতা ও ইসলামী মূল্যবোধ। আর তাই যুদ্ধাপরাদীদের বিচার সকলেরই কাম্য।

আজ খুবই খারাপ লাগছে কি ভুলই করেছিলাম সেদিন! ২০০৮ সালে তিনি নির্বাাচনে অংশ না নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছিলেন, এবং যখন তাকে বিদেশ ডাম্প করার সিদ্ধান্ত তৎকালীন সরকার নিয়েছিল তখন ৯০ এর গণআন্দোলনের এই নেত্রীর প্রতি কিছুটা মমতাবোধ দেখিয়েছিলাম ও তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। ৯০ এর গণ আন্দোলনের অর্জন তিনি আজ শেষ করে দিলেন বোধহয়!

আপনি যে আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী তা সহজেই অনুমান করা যায়। আপনি আদর করে জামায়ত শিবিরকে মাথায় তুলেছেন। আবার মঞ্চে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সাফাই গেয়েছেন। আপনি এও অভিযোগ করেছেন যে বর্তমান সরকার নাকি জামায়তের সঙ্গে আতাঁত করেছে। আপনি যদি এসব কাজ না করতেন বা ওই সব কথা না বলতেন তাহলে কি আজ জাগরণমঞ্চ হতো?

জাগরণ মঞ্চ হয়তো হতো তবে তা দেশ থেকে দূর্নীত ও বৈষম্য দূর করবার জন্য। আজ আপনি যদি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় হরতাল ভাংচুর ও নেতিবাচক রাজনীতি বেছে না নিতেন এবং যদি বলতে যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আপনিও একমত তাহলে বাংলাদেশ এগিয়ে যেত শত বছর। জনতা এখন সামাজিক অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে মাঠে নামতো। দেশে যে আজ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আগামী নির্বাচনও হুমকির মুখে। কারণ নির্বাচনের জন্য যে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি প্রয়োজন তা বোধহয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না এত অল্প সময়ে। কারণ সামনে জামায়ত আরোও ধংশ্বাতক্ব কাজে লিপ্ত হতে পারে। দেশের সংবিধান অনুসারে দেশ না চললে যে সংকট দেখা দেবে তার জন্যও আপনি দায়ী থাকবেন। হরতাল, অসহযোগ বর্তমান সরকারীদলও করেছে। কিন্তু নির্বাচনই কেবল ক্ষমতায় নিতে পেরেছে। নির্বাচনের অনুকুল পরিবেশ কি আমাদের এখনকার লক্ষ্য হতে পারে না?

এভাবে যদি চ্যালেঞ্জ করে চলেন তাহলে কি নিশ্চিত আপনি আবার ক্ষমতায় আসতে পারবেন? আপনার রাজনৈতিক জীবনের পরিসম্পাতি যেমন সম্ভাবনাময় তেমনি গণতন্ত্রও হুমকির মধ্যে থাকবে এ ধরণের চ্যালেঞ্জ করলে। ১/১১-ও অভিজ্ঞতা আমরা আবার চাই না। আপনিও নিশ্চয়ই এ বিষয়ে একমত? এভাবে অগ্রসর হলে মানুষের জীবন আরও দূর্বিসহ হবে। ক্ষমতায় গিয়ে আপনিও একই ধরণের চ্যালেঞ্জর মুখোমুখি হবে।

আমরা কি রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আশা করতে পারি না? বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৩ বছর পর ক্ষমতায় এসেছিল। ৪২ বছরের মাঝে আপনার দল ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল। জনগণের প্রতি ভালবাসা থাকলে, তাদের দাবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে আপনি যে আবার ক্ষমতায় আসবেন না বা আপনার দল নির্বাচিত হবে না তা আপনি কেন অনুমান করছেন? সংসদের বর্তমান দলগুলির মধ্য থেকে ১১ জন এমপি নিয়ে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার হলে কি আপনিই লাভবান হবে না? দুটি চ্যালেঞ্জ নিয়েই দেখুন। এক. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হবে আপনার দলের আদর্শ ও দুই. অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনেই আপনি নির্বাচন করবেন। আপনার সাহস ও সহযোগিতা আপনার হারানো ইমেজ ফিরে পেতে কাজে লাগবে। দেশও হবে ধন্য। জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আপনি অতীতে কুন্ঠাবোধ করেন নি। জাতির জনকের জম্মদিনে আপনিও আজ অংশ নিতে পারতেন। ২৬ শে মার্চ আমাদো স্বাধীনতা দিবস। দিনটিকে বেছে নিতে পারেন নতুন অভিযাত্রার শুভদিন। বলতে পারেন আর নয় হরতাল। একবার বলে দেখুন।

সত্য উপলব্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রর রাষ্ট্রদূত নতুন প্রজম্মের গণজাগরণ মঞ্চকে দাবী আদায়ের শান্তিপূর্ণ পথ হিসেবে প্রশংসা করছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি সমর্থন দিয়েছেন। নতুন প্রজম্মের এই অহিংস আন্দোলনকে সমর্থন করে দিনরাত লিখে যাচ্ছেন একদল সত্যপ্রিয় সাংবাদিকরা। তাদের যারা আক্রমণ করছে আজ আপনি কেন সেই আক্রমলকারীদের কাতারে নামবেন? আপনি কি তবে সমর্থন দিচ্ছেন রাজীব ও ত্বকির হত্যাকারীদেরকে? আপনি কি পারেন না সন্তান হারানো পিতা নারায়ণগঞ্জের ফজলে রাব্বি পাশে দাঁড়াতে? আপনি ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে সরকারকে দায়ী করতে পারতেন নানা ব্যর্থতার কথা তুলে ধরতে। অথচ আপনি বেছে নিলেন নেতিবাচক এক ধ্বংশের রাজনীতিকে। আপনি কিন্তু এজন্য দু:খ পর্যন্তও প্রকাশ করেন নি? অতিথিকে অপমান করে কি নিজেকে সম্মানিত করা যায়?

দেশে জাময়ত শিবির যা করছে তা থেকে জাতি মুক্তি পেতে পারে আপনার বলিষ্ঠ ঘোষণায়। আপনাকে বলতে হবে আর জামায়ত নয়। এই চ্যালেঞ্জ না নিয়ে আপনি যতই দেনদরবার করেন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য, যতই হরতাল দেন না কেন, জনতা দিনে দিনে আপনার দলকে বর্জন করে চলবে। আজ যদি জামায়ত জাতির কাছে ক্ষমা চায়, আজ যদি সাঈদী তার অপরাধ স্বীকার করে নেয় তাহলে কি ভয়ানক পরিণতি আপনার দলের হতে পারে ভেবে দেখেছিন কি? জামায়ত যে এমন একটি কাজ করবে না তার নিশ্চয়তা কি আপনার আছে? আপনাকে আবারও কোথাও থামতে হবে। দুই দফা প্রধানমন্ত্রীত্বই কি যথেষ্ট নয়? আমরা সরকারের ভুমিকাও পুরোপুরি সমর্থন করি না। তাদেরও দায়িত্ব আছে রাজনৈতিক সাংস্কৃতি গড়ার। বিরোধীদলকে সংসদে আনার দায়িত্ব তারা এড়িয়ে যেতে পারে না। দীর্ঘস্থায়ী জাগরণমঞ্চ সমাধানের একমাত্র পথ হিসেবে বিবেচনা করলেও তারাও ভুল করবেন। জনগণের মাঝে স্বস্থি ফিরিয়ে আনতে নানামুখী প্রচেষ্টা আমাদের কাম্য। সরকারকেও থামতে হবে, ভাবতে হবে এবং নতুন পথ অনুসরণ করতে হবে। সংসদের সবাইকে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হতে হবে যে তারা দেশকে শান্তির দেশে পরিণত করবেন। আসুন আমার সবাই একমঞ্চে আসি। সবাই জাগরণ মঞ্চে সমবেত হই এবং জতির মুক্তির সনদ রচনা করি। ১৯৭১ সালে জিয়া যে ভুল করেছিলেন আজ আলাদা মঞ্চ করে আপনি সেই ভুল আশা করি করবেন না। জাতির স্বপ্ন হোক আপনার লক্ষ্য।

ড. ফরিদ আহমেদ, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment