বাসযোগ্যতার মাপকাঠিঃ মেলবোর্ন-১, ঢাকা-১৪০ নাকি ঢাকা-১, মেলবোর্ন-১৪০?

বাসযোগ্যতার মাপকাঠিঃ মেলবোর্ন-১, ঢাকা-১৪০ নাকি ঢাকা-১, মেলবোর্ন-১৪০?

আশরাফুল আলম

‘বাসযোগ্য’ কথাটি এলেই আমার কেন জানি না সুকান্তের কথা মনে পড়ে যায় – পৃথিবীকে যেমনটা পেয়েছিলেন, তার চেয়ে আরো একটু বেশী বাসযোগ্য করে রেখে যাবার এক অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি এক নবজাতকের কাছে। একুশেই পরপারে যাত্রা করা সুকান্তের দেখা হয়নি সেই অধিকতর বাসযোগ্য দুনিয়া – দেখা হয়নি তার স্বপ্নের স্বাধীন ভারতবর্ষ, দেখা হয়নি ঔপনিবেশিকতার অবসান ও গণতন্ত্রের জয়জয়কার, দেখা হয়নি আজকের এই তথ্যপ্রযুক্তিবিপ্লব। কিন্তু পৃথিবী কি আসলে আগের চেয়ে বাসযোগ্য হয়েছে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর যদি আজকে আমরা তাকে দিতে যাই, আমরা ইতস্তত বোধ করব। পৃথিবীর কথা বাদ দিই, আমাদের নিজেদের দেশ, নিজেদের এলাকা ও নিজেদের গন্ডীর কথাই বলি – কি দিয়ে বাসযোগ্যতা মাপি আমরা? সেই মাপকাঠিতে কতটুকু এগিয়েছি আমরা বিগত পঞ্চাশ, একশ বা দুশো বছরে, তার হিসেব কে রাখে? পৌরাণিক যুগে রাজারা নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি দাবী করে বংশানুক্রমে শাসন/শোষন চালিয়ে যেতেন, আজকে আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে বংশানুক্রমিক পীরবাদ চালু করেছি। সেই সময়ের মন্ত্রী আমলা কোটালদের জায়গা নিয়েছেন আজকের এমপি এসপি সচিবেরা। একসময় মানুষ বিক্রয় হতো হাটে বাজারে, আজ মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকার তাতে কিছুটা বাধ সেধেছে বলে দেখা যাচ্ছে, তবুও বেচাবিক্রী থেমে নেই। রানা প্লাজায় চাপা পরা সেই সহস্রজনের সঙ্গে আফ্রিকার উপকুল থেকে আমেরিকায় চালান হওয়া জাহাজবোঝাই মানবপণ্যের কতটুকু তফাত? বড় ঘোলাটে আর ধোঁয়াটে এই মাপামাপির কারবার। কে মাপছে, কেন মাপছে আর কিভাবে মাপা হচ্ছে, সেটাই বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় অনেকসময়, কি মাপা হচ্ছে তার চেয়ে।

আজকাল পত্র-পত্রিকায় অনলাইনে পৃথিবীর বড় শহরগুলির বাসযোগ্যতার র্যাং্কিং দেখি হরহামেশাই। তালিকাগুলো আমি না চাইলেও আমার চোখে পড়ে, কারণ তালিকার উপরের এবং নীচের দুদিকের মানুষজনের সঙ্গেই আমার পরিচয় আছে। একদিকে মেলবোর্ন, সিডনী, পার্থ, টরেন্টো – আরেকদিকে ঢাকা, খার্তুম, ত্রিপলি কিম্বা হারারে। মেলবোর্নে আমার আপাতত বসবাস, আর বন্ধু বা আপরিচিতজনদের অনেকেই থাকেন সিডনী, পার্থ, টরেন্টোতে। মেলবোর্নে আজকাল আফ্রিকার নানান দেশের মানুষ এসেছে রিফিউজি হয়ে, সেই সুবাদে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। আমি অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে; “লাল-লাল নীল-নীল বাত্তি দেইখা নয়ন জুড়াইসে, ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে” কলেজে পড়ার সময়। ঢাকার ব্যাপারে আমার একটা মোহ ছিল আমি যখন হাইস্কুল পড়ুয়া সেই সময়। তার অন্যতম কারণ, আমার ঢাকায় যাওয়ার কোন ক্ষীণতম সম্ভাবনাও ছিল না তখন পর্যন্ত। ক্লাসমেটদের কেউ ঢাকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলে হা করে শুনতাম, আর ভেতরে ভেতরে ঈর্ষান্বিত বোধ করতাম। এর পরে ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল, তবে তার জন্য অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। গ্রাম থেকে পদব্রজে পাকা রাস্তায়, সেখান থেকে ভ্যানগাড়ীতে করে নিকটস্থ ছোট শহরে। লোকাল বাসে করে বগুড়া গমন, এবং তারপর হানিফ এন্টারপ্রাইজের সৌজন্যে ঢাকার গাবতলী, মাঝে ফেরীতে যমুনা অতিক্রম। পাক্কা ১৮ ঘন্টার ব্যাপার। গাবতলী থেকে আট নাম্বার বাসে করে চানখাঁর পুলের উদ্দেশ্যে যে যাত্রা করেছিলাম, সেই যাত্রায় প্রথম ঢাকার যানজটের সঙ্গে পরিচয় হয়, এবং তখন সন্ধ্যা হয়ে আসায় সাধের লাল-নীল বাতি দেখতে হয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। এর পরে লেখাপড়া ও কাজের সুবাদে ঢাকায় ছিলাম দেড় দশক, তারপরে মেলবোর্নে এলাম বছর কয়েক আগে। আসার আগেই জানা ছিল যে মেলবোর্ন বিশ্বের অন্যতম সেরা বাসযোগ্য শহর – মেলবোর্নে এসে সে কথার সত্যতাও মেলে। আমি ফার্মগেইট থেকে ৬ নম্বর বাসে চড়া পাবলিক; মেলবোর্নের সময়ানুবর্তী ও সর্বগামী পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক, এখানকার পরিচ্ছন্ন, সুপরিকল্পিত ও মাল্টিকালচারাল নগরকেন্দ্র, পার্ক, খেলার মাঠ, রাস্তাঘাট, কেনাকাটার ও বিনোদনের সুযোগ সম্বলিত ছিমছাম আবাসিক এলাকায় এক টুকরা ব্যাকইয়ার্ড সমেত বাড়ি, ট্যাপে পানযোগ্য পানি, সবার জন্য ফ্রি চিকিৎসা সেবা, লোডশেডিং নেই, নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয় না – এগুলো দেখে ভালই লেগেছে। আমার বউ তো মুগ্ধ। আমার শুরু থেকেই একটু অকারণ পক্ষপাতিত্ব ছিল ঢাকার প্রতি, তবে সেটা উচ্চকন্ঠে বলতাম না বউয়ের সামনে। ভেতরে ভেতরে আমি এইসব তালিকাকে পাত্তা দিতাম অল্পই।

আমার পাত্তা দেওয়া না-দেওয়াটা অবশ্য কোন উল্লেখযোগ্য বিষয় নয়। আমার পরিচিতমহলের অনেকেই মেলবোর্নবাসী হওয়ায় যে আত্নশ্লাঘা বোধ করতেন, ফেসবুকে এবং অফলাইনে সেটা প্রকাশ করতেন। আমার বউও সেই দলের লোক। কাজেই, ফেসবুকে ঢুকি আর না ঢুকি, পত্রিকা পড়ি আর না পড়ি, প্রতিবছরই মেলবোর্ন-সিডনী-ঢাকার র্যাংবকিং আমার কানে চলে আসে। বছরে একবার আমাদের নিরানন্দ প্রবাসজীবনে কিছুটা চাপা আনন্দের কিম্বা অহংকারের উপলক্ষ আসে। বাংলাদেশীরা ছাড়া মেলবোর্নের স্থানীয় মানুষজনও ব্যাপারটা নিয়ে গর্ব করে, তবে সেটা একারনে নয় যে মেলবোর্ন সবার উপরে; মেলবোর্নবাসীর গর্ব এই যে, মেলবোর্নের অবস্থান সিডনীর উপরে। অস্ট্রেলিয়াতে শুরু থেকেই মেলবোর্ন আর সিডনীর মধ্যে প্রতিযোগীতামূলক একটা ব্যাপার চলে আসছে – যে কারণে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী করতে হয়েছে এই দুই প্রধান শহরের মাঝামাঝি আরেকটা নতুন শহর বানিয়ে। মেলবোর্নের মেয়র মহাশয় বাণী দেন এই তালিকা-শীর্ষ দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে; মেলবোর্নের ট্যুরিস্ট আকর্ষণী সকল প্রচার প্রচারনায় এই তথ্য কাজে লাগানো হয়। যা হোক, এবছর ঢাকার অবস্থান সবার শেষে নয়, শেষের একটু উপরে। মাঝে কোন এক বছর মেলবোর্ন ছিল তালিকায় এক নম্বর, আর ঢাকা ছিল শেষ নম্বর, সম্ভবত ১৪০তম। তালিকার মাঝামাঝি থাকলে কোন সমস্যা ছিল না – কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘাঁটায় না, কিন্তু তালিকার প্রথম দশে কিম্বা শেষ দশে থাকলে মানুষ সেই নামগুলি পত্রিকায় পড়ে, মনে রাখে। রাস্তাঘাটে বা কাজের ফাঁকে কেউ যখন শোনে যে আমি বাংলাদেশের, তখন এই প্রসংগ আপনা আপনি চলে আসে। অনেকে কৌতুহলি হয়ে জানতে চায়, ঢাকার জীবনযাত্রা কেমন। আমি শুরুতেই ভয় পাইয়ে দেই – বলি, মেলবোর্নের পাঁচ ভাগের এক ভাগ জায়গায় পুরো মেলবোর্নের তিনগুণ মানুষ বাস করে। কথাটা সত্য, তবে এদেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না। মিডিয়ার সুবাদে আজকাল অনেকেই রানা প্লাজা কিম্বা তাজরীনের ঘটনা জানে। অনেকে মনে করে, ঢাকা আসলে একটা জঙ্গল, যেখানে রোগ-দারিদ্র-ক্ষুধা-অপরাধ-দুর্নীতি জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ। সেকথা পুরোটা মিথ্যাও নয়। এদেশের মানুষজন অনেকেই নানান দেশে বেড়াতে যায়, যার মধ্যে নেপাল-ভারতেরও নাম আছে, অথচ বাংলাদেশে কেউ বেড়াতে গেছে এটা প্রায় বিরল ঘটনা। দু’একজন এমনও পেয়েছি, যারা ঢাকাকে আফ্রিকার কোন শহর মনে করে। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই দুই শহরে বাস করে আমার অনুভুতি কি? একলাফে র্যাং কিং এর তলানী থেকে চুড়ায় উঠার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য সবার হয় না, আমি সেই বিরল মানুষদের একজন। এমন একজনকে এই প্রশ্ন করাই যায়। তারা হয়তো আশা করে যে আমি মেলবোর্নের প্রশংসা করে কিছু বলব; আমি তাদেরকে হতাশ করে বলি, আই মিস ঢাকা। মনে মনে অবশ্য আমি ফার্মগেটের সঙ্গে মেলবোর্নের নিউক্লিয়াসরুপী ফ্লিন্ডার্স স্ট্রীটের তুলনা করতে থাকি, এবং আমাদের রাজনীতি-জনসংখ্যানীতি-দুর্নীতি-বর্ণবাদনীতিসহ যাবতীয় নীতি কিম্বা নীতির অভাবকে গালি দিতে থাকি। বাংলাদেশের গোটা পনের বিশেক শহর নিয়ে বাসযোগ্যতার র্যাং কিং হলে, ঢাকা সবার শেষে যে থাকবে, তাতে আমি নিশ্চিত। আমার জেলাশহর বা গ্রামের চেয়েও পেছায়ে থাকতে পারে, বলা যায় না।

এবছর র‍্যাংকিং বের বের হওয়ার পর কথা হচ্ছিল এক অস্ট্রেলিয়ান সহকর্মীর সঙ্গে, যাকে আমি ঢাকায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য মোটিভেট করে আসছি তিন বছর ধরে। আমার এই তরুন কলীগ চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, নেপাল, ঘানা, এমনকি সুদানেও বেড়াতে গিয়েছিল। আমি বললাম, ঢাকার অবস্থা একটু উন্নতির দিকে, তালিকার শেষে নয় -এবারে ঢাকার অবস্থান শেষ থেকে ২ নম্বরে। সে যা বলল, তার সারমর্ম হলঃ যে লাউ, সেই কদু। আমি একটু আহত হলাম। পরিচিত দুএকজন বাংলাদেশীকে জিজ্ঞেস করলাম, তালিকায় ১ ধাপ উন্নতি আশাপ্রদ ব্যাপার কি-না? নানা জনের নানা মত। শেষে এই তালিকা প্রণয়নকারী Economist Intelligence Unit এর ওয়েবসাইটের শরনাপন্ন হলাম। ওখানে দেখলাম লেখা আছে যে ওরা পাঁচটি বিষয়ে স্কোরিং করে – Stability, Healthcare, Culture and environment, Education, Infrastructure। এদের মেথডলজি আরেকটু ঘেঁটে যেটা পেলাম, তা হলঃ এই ধরনের বেঞ্চমার্কিং বা স্কোরিং এর একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলিকে ধারনা দেওয়া যে, কোন শহরের জীবনযাত্রার মান কেমন, এবং সেখানে যদি কোন এমপ্লয়ীকে পাঠানো হয়, তাকে কেমন পরিমানে রিলোকেশান বোনাস দেওয়া দরকার। বিশেষ করে বিভিন্ন শহরের মধ্যে তুলনা করার সুবিধা এবং এসব শহরে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে একজন ভিনদেশীকে, তাকে সংখ্যার মাপে মাপা এই তালিকার একটা প্রধান উদ্দেশ্য। (assigning a hardship allowance as part of expatriate relocation packages, quantifying the challenges that might be presented to an individual’s lifestyle in any given location) এর বেশী তথ্য বিনামূল্যে তারা দেয় নি, আপনি চাইলে মেথডলজি কিনে নিতে পারেন, অথবা পুরো তালিকা কিনে নিতে পারেন, যেখানে পাবেন উপরোক্ত পাঁচটি ক্রাইটেরিয়ার বিভিন্ন সাব-ক্রাইটেরিয়ায় প্রতিটি শহরের স্কোর থাকবে, সঙ্গে আরো নানান তথ্য এবং কিছু দরকারী লোকাল টিপস বা “ডুজ এন্ড ডোন্টজ” থাকবে।

Category 1: Stability (weight: 25% of total)

Prevalence of petty crime

Prevalence of violent crime

Threat of terror

Threat of military conflict

Threat of civil unrest/conflict

Category 2: Healthcare (weight: 20% of total)

Availability of private healthcare

Quality of private healthcare

Availability of public healthcare

Quality of public healthcare

Availability of over-the-counter drugs

General healthcare indicators

Category 3: Culture & Environment (weight: 25% of total)

Humidity/temperature rating

Discomfort of climate to travellers

Level of corruption

Social or religious restrictions

Level of censorship

Sporting availability

Cultural availability

Food and drink

Consumer goods and services

Category 4: Education (weight: 10% of total)

Availability of private education

Quality of private education

Public education indicators

Category 5: Infrastructure (weight: 20% of total)

Quality of road network

Quality of public transport

Quality of international links

Availability of good quality housing

Quality of energy provision

Quality of water provision

Quality of telecommunications

স্কোরিং এর ক্রাইটেরিয়া এবং বিভিন্ন সাব-ক্রাইটেরিয়ার দিকে চোখ বুলালে ঢাকার এই র্যাংরকিং খুব একটা অযৌক্তিক নয়। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সুচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম। ওয়াসার পানির খারাপ মান কিম্বা ঢাকার বাতাসে সীসার আতংকজনক মাত্রার কথা আমরা আগে থেকেই জানি। অপরাধের মাত্রা – বিশেষ করে খুন-ধর্ষন-ছিনতাইয়ের মতন বড় অপরাধ – আমাদের জানা। পত্রপত্রিকায় চোখ বুলালেই সেটা যে কেউ দেখে নিতে পারে। সরকারের ও আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের বেহাল অবস্থা, দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও বিশুদ্ধ পানির অপ্রতুলতা, কিছুই অস্বীকার করি না। কিন্তু আমার আশংকা, ইকোনোমিস্টের র‍্যাংকিং করার সময়

যাদেরকে সার্ভে করা হয়েছে (আমি জানি না কাদেরকে সার্ভে করা হয়েছে, তবে সার্ভের যে উদ্দেশ্য, তাতে মনে হয় ইংরেজীভাষী দেশগুলির যারা ব্যবসা/চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন এবং/অথবা থেকেছেন, তাদেরকে সার্ভে করা হয়ে থাকতে পারে), তারা তাদের নিজ নিজ ব্যাকগ্রাউন্ড এবং তৃতীয় বিশ্ব সম্পর্কে কিছু ঋণাত্নক পূর্নধারনার কারনে এই পুরো বাসযোগ্যতা পরিমাপের পদ্ধতিকেই পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলে থাকতে পারেন। আমি কোন ষড়যন্ত্র তত্ব বানাচ্ছি না এখানে; যা বলছি তার সবটাই অভিজ্ঞতার আলোকে। আসুন, আপনাদের সাথে শেয়ার করি সেই অভিজ্ঞতা।

একসময় আমি কাজ করতাম রাতে, মেলবোর্নের শহরকেন্দ্রে। কাজ শেষ করতে করতে রাত বারোটা। এর পরে পাঁচ মিনিট হেঁটে স্টেশনে, তারপরে ট্রেনে করে আমার লোকাল স্টেশনে আসতে লাগত পঁচিশ মিনিট। আরো দশ মিনিট হেঁটে আমার বাসা। আমার বসবাস সানশাইন এলাকায়, যেটি মেলবোর্নের কয়েকশত এলাকার মধ্যে সোশিও-ইকোনোমিক প্রোফাইলের দিক থেকে এক্কেবারে নীচের দিকে। আমি অস্ট্রেলিয়া এসে এ পর্যন্ত এই এলাকাতেই আছি, কাজেই আমার কাছে অস্ট্রেলিয়া মানেই সানশাইন। কাজ শুরু করার প্রায় মাস ছয়েক পরে একদিন আমার ম্যানেজার আমাকে জিজ্ঞেস করল যে আমি কোথায় থাকি। উত্তর দিলাম। শুনে সে বলল, ওটা তো

ভালো এলাকা না, একটু সাবধানে যেয়ো। তার এই কথার শানে নযুল হল এই যে, ভিক্টোরিয়া পুলিশের প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী সানশাইনে ক্রাইমের হার সবচেয়ে বেশী। সানশাইনে এশিয়ান এবং আফ্রিকান মাইগ্র্যান্টদেরও আস্তানা, ফলে এখানে গড় আয় পুরো মেলবোর্নের গড়ের চেয়ে কম, বেকারত্ব অন্য এলাকার চেয়ে বেশী। ব্যস, এইটুকুই। শুধু সানশাইন নয়, মেলবোর্নের পুরো পশ্চিমাঞ্চলকেই অন্যান্য এলাকার চেয়ে একটু পিছিয়ে আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। ফলে, মেলবোর্নের অনেক মানুষের ধারণা, সানশাইন প্রায় বসবাসের অযোগ্য। এই পশ্চিমাঞ্চলের অঘোষিত রাজধানী হল ফুটস্ক্রে – যেখানে অনেক মেলবোর্নবাসী নাকি দিনের বেলাতে যেতেও ভয় পায়। আসলে ব্যাপার সামান্যই – সানশাইন ফুটস্ক্রেতে নানান রকমের মানুষের সমাহার, যাদের বেশীরভাগই মাইগ্র্যান্ট, আর এখানে পুলিশের কর্মব্যস্ততা অন্য এলাকার চেয়ে হয়তো একটু বেশী। আমার কাছে সানশাইন ফুটস্ক্রেকেই সত্যিকারের মেলবোর্ন মনে হয়, যদিও এদেশের মানুষজনের শতকরা ৯৫ জনই (এশিয়ান ও আফ্রিকান মাইগ্র্যান্টদেরকে বাদ দিলে) আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন। যা হোক, একটা কথা বলতে পারি, পুরো মেলবোর্ন বাদ দেন, শুধু মেলবোর্নের পশ্চিমাঞ্চলকেই যদি Economist Intelligence Unit এর তালিকায় বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে মাপা হত, সেটি তালিকার বেশ উপরের দিকেই থাকত। আমার কাছে সানশাইনই মেলবোর্ন। শহরের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে এর ফারাক নিছকই উনিশ-বিশ। তারপরেও মেলবোর্নের অনেক মানুষ যখন রাতের ট্রেনে সানশাইনে কিম্বা দিনে ফুটস্ক্রে যেতে ভয় পান, তাহলে তারা ইউরোপ-আমেরিকার বাইরের কোন দরিদ্র শহরে যাওয়ার সময়ে যে লৌহবর্ম পরিধান করতে চাইবেন, সেটা বিচিত্র নয়। এদেশের মানুষের কাছে কুইন্সল্যান্ডের গরমই যেখানে অসহ্য, সেখানে Economist এর সার্ভের একটি প্যারামিটার Discomfort of climate to travellers-এ ঢাকা বা আফ্রিকার কোন শহর কত নম্বর পাবে, তাও সহজেই অনুমেয়।

যা হোক, যে উদ্দেশ্যে এবং যাদের জন্য এই তালিকা করা হয়েছে, সেদিক থেকে এই তালিকা ঠিক আছে। মাথায় রাখা দরকার যে, এখানে বাসযোগ্যতার সংজ্ঞাটি সম্ভবত ইউনিভার্সাল এবং নৈর্বৃত্তিক নয়, তা বিশেষ একশ্রেণীর মানুষের মতামতের সঙ্গে মিডিয়া ও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে বানানো। প্রথম বিশ্বের মিডিয়ায় তৃতীয় বিশ্ব সম্পর্কে খবর সাধারনত তখনই আসে, যখন সেটা খারাপ খবর। বাংলাদেশের সরকার যদি বাংলাদেশীদের জন্য বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে কিছু শহরের তালিকা করত, তাহলে সেখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-সিলেটের (এই ধারাক্রমে নাও হতে পারে) পরে নাম আসত সেই সব শহরের, যেখানে বাংলাদেশের মানুষেরা বাস করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। সেই তালিকায় টরন্টো-মেলবোর্ন-ভিয়েনার অনেক উপরে থাকবে দুবাই(৭৭)-কলকাতা(র্যাং কিং জানা নেই)-লন্ডন(৫৫)।. ঢাকার সাফাই গাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়,আগেই যেটা পরিষ্কার করেছি। সম্প্রতি আনিসুল হক তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ঢাকায় শৈশব-কৈশোর কেটেছে, এমন মেলবোর্ন প্রবাসীদের যদি বলা হয়, আপনাকে জীবন বদল করার সুযোগ দেওয়া হলো, জীবিকার নিশ্চয়তাসহ ঢাকা অথবা মেলবোর্নের যেকোনো একটাকে বেছে নিন, বেশির ভাগই বেছে নেবেন ঢাকাকে। সে কথাও মানছি। তবে আমাদের পরের প্রজন্ম, আমাদের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক জানার পরেও, ঢাকায় যেতে চাইবে কি? ঢাকা তো ওদের কাছে বিদেশ। মেলবোর্নের চশমা চোখে দিয়ে দেখলে, বিদেশের সবচেয়ে খারাপ শহরগুলোর একটা। আজকাল দেখি অনেক প্রবাসীই বাংলাদেশে বেড়াতে যাওয়ার সময় বাচ্চাদের জন্য খাবার ও পানি বেঁধে নিয়ে যান। ঢাকা যেমনই হোক, আমরা ঢাকাকে ভালোবাসি ও হৃদয়ে ধারণ করি – এ কথার মধ্যে যেমন আমাদের যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশী কাজ করে, তেমনি ঢাকার বাসযোগ্যতা যে গত কয়েক দশকে ক্রমাগত কমছে, সে কথাও আমরা সহজে ভুলি না, তা যে স্কেলেই অথবা যাদের জন্যই মাপা হোক না কেন। আর এ কথাটা ঢাকার সঙ্গে জড়িত সবাই যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই আমাদের মঙ্গল।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment