দেশ প্রেম বিষয়ক নিরপেক্ষতা

দেশ প্রেম বিষয়ক নিরপেক্ষতা

নিরপেক্ষ। কোন পক্ষেই নই। কি দেশের পক্ষে, কি দেশ বিরুধী। কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, কি রাজাকার চেতনা, আমি নিরপেক্ষ। কোন পক্ষেই নই আমি। যদি মুক্তিযুদ্ধ চেতনা যুক্তি তর্কে জেতে, অথবা রাজাকার চেতনা, অসুবিধা নেই, তা মেনে নেব। কারণ আমি নিরপেক্ষ। জয় বাংলা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বা পাকিস্তান জিন্দাবাদ, যে পক্ষই হোক আমি সবার কথাই শুনতে চাই। এমন কি যে লাল, সবুজের পতাকা পোড়ায় বা বুকে ধারণ করে – মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ভাঙ্গে, মানুষ হত্যা করে – সবার সাথেই আমি আলোচনায় বসতে চাই। কারণ আমি নিরপেক্ষ এবং আলোচনার কোন বিকল্প নেই। যে খানেই থাকি, বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তান, কিছুই যায় আসে না আমার এবং কোন অবস্থাতেই নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করব না আমি। এটা আমার নিরপেক্ষতার কসম।

যেহেতু আমি ঠিক জানি না কোন পক্ষ শক্তি শালী, সে হেতু চুপচাপ থাকাই ভাল। বলা তো যায় না। যে পক্ষই জিতুক, আমি তাদের সাথেই আছি। মনে মনে ওদের পক্ষেই ছিলাম এতদিন। বাচ্চা কাচ্চা, সামাজিকতা আছে, সম্প্রীতি নষ্ট করে নিজেকে ঠকাতে চাই না। নিজেকে একা করে দিতে চাই না। দু’ই চেতনাতেই আমার বিশ্বাস আছে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্যে – “যা কিছু করার” দোষ দেখিনা। প্রাণ হানি, ইজ্জত হানী এগুলুতো একটু আকটু হবেই। হোক না আমার মা কিংবা বোন! যুদ্ধ বলে কথা। ভাইকে ভাই থেকে আলাদা, এটা ভারতীয় চক্রান্ত ছারা আর কিছুই নয়। আবার এটাও সত্যি যে, একটা স্বাধীন দেশে কে না থাকতে চায়? যে ভাবে পাকিস্তানিরা আমাদেরকে শাসন করছিল, তাতে ওদের সাথে এক থাকার কোন অবস্থা ছিল না। আগে আর পরে আমাদের কে আলাদা হতেই হত। ভালই হয়েছে – কিছু বোকা অসম্ভব কে সম্ভব করল, লাখে লাখে মরল। আমরা মাঝখান থেকে একটা নিজস্ব ভূখণ্ড পেলাম। যার নাম এখন বাংলাদেশ। ফল গাছে থাকুক আর মাটিতে পড়ুক – আমার ভাগ আমাকে দিতেই হবে। এটা আমার গণতান্ত্রিক অধিকার।

আসলেই কি তাই? আমার পরিচয় কি? আমি কোথায়? আমার দেশ কোনটি? নিজেকেই নিজের প্রশ্ন, আপন বিবেকের থেকেই। এতেই বুঝতে পারি বিবেক এখনও আছে, মরে যায়নি অথবা যাত্রা, নাটকের চরিত্র হয়ে কাল অক্ষরে কোথাও বন্দি হয়ে পড়েনি।

না, যুদ্ধ অপরাধীদের বিষয়ে আমি নিরপেক্ষ না। আমার পক্ষ আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আমি। কোন আপোষ নেই এ ব্যাপারে। কেন? কারণ, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমি আমার স্বাধীন ভূখণ্ড বাংলাদেশ কে বিশ্বাস করি। যারা বাংলাদেশকে চায়নি, এখনও একমত না কিন্তু ভাগ বসাবে নাগরিক সুযোগ সুবিধায়, তাদেরকে ধিক। তাদের সাথে কোন ভাবেই আপোষ নয়। আমি চাই না, আমার দেশে কেউ সন্ত্রাস করবে বেআইনি ভাবে, আবার আইনের আশ্রয় নিয়ে, গণতান্ত্রিক অধিকারের বলে রাজনীতি করবে এই দেশে। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই বিশ্বাস করে না, তারা কি ভাবে রাজনীতি করে বাংলাদেশে?

একাত্তরে সবাই মুক্তিযুদ্ধে যায়নি বা শরিক হয়নি। একটা অংশ ছিল, যারা, যে ভাবে যেখানে ছিল – সে খানেই থেকে গেল। কেউ কেউ কথা বলেছে, কখনও পক্ষে কখনও বিপক্ষে। কেউ কেউ চুপ চাপই থেকে গেল সব সময়টা। সামান্য কিছু হল রাজাকার, যারা ঐ সময়টার লুটপাটের সুবিধা নিতেই রাজাকার হয়েছিল। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি হাতে গোনা কিছু উচ্চ এলিট শ্রেণী যারা পাকিস্তান আমলে ভালই ছিল এবং কিছু চোর চোট্টা নিন্ম শ্রেণীর এলিটদের চামচা। প্রায় পুরো ভুক্ত ভুগি মধ্যবিত্ত শ্রেণী হল মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধা, একটা অংশ সরাসরি যোগ দিল সমর যুদ্ধে – অন্য অংশটি নানা ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করল।

দেশ স্বাধীন হল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলো। কয়েক বছরের মাথায়, ১৯৭৫ এ রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে গেল স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে। মুক্তি যোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা আর্মি অফিসারদের কে দমন করা হল কঠিন হাতে। রাজাকারদের পুনর্বাসন শুরু হল। মজিব হত্যাকারীদের দেয়া হল পুনর্বাসন। আইন হল মজিব হত্যা কারিদের বিচার করা যাবে না। পরিকল্পনা মাফিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে ধীরে ধীরে মুছে ফেলা হল। জয় বাংলা নিষিদ্ধ হল। বাংলা হয়ে গেল হিন্দুদের ভাষা। যেমন বাংলাদেশ বেতার হল “রেডিও বাংলাদেশ”। ইসলামকে নিয়ে শুরু হল এক নতুন ধরনের রাজনীতি।

জেনারেল জিয়া মূলত সূচনা করলেন ৭২ এর সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা থেকে সরে আসা। খাল কাটা কর্মসূচির মতই আন্তরিক ভাবে কাটা শুরু করেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। রাজাকারদের গাড়িতে শুরু হল লাল সবুজ পতাকা উড়া। এমন কি স্বাধীন এই দেশে প্রধান মন্ত্রীও হলেন এক রাজাকার। জিয়া যদিও একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কিন্তু ১৯৭৫ পরে তিনি ক্ষমতায় এসে, নিজের ভুল বুজতে পেরেছিলেন। ক্ষমতায় থাকা কালীন তিনি কখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন না, অন্তত তার কোন রাষ্ট্রীয় কাজে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় না। খুঁজতে হলে তা হবে, সমুদ্রের পানিতে হারিয়ে যাওয়া সূচ খোজার মতই। বেগম জিয়াও তার স্বামীর দেখিয়ে যাওয়া মত ও পথেই আছেন, মাঝে মাঝে স্বামীর চেয়েও এককাঠি সরসই আছেন। তার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেও – তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন – অসমাপ্ত করে রাখলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতাকে – পদ দলিত করা হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। এখনও প্রচুর রাজাকার আছেন, আওয়ামীলীগের নানান গুরুত্বপূর্ণ পদে। ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণ, লাখ লাখ মা, বোনদের সম্ভ্রম, হাজার হাজার যুদ্ধ শিশু – ক্ষমতা লোভিদের কাছে এ সব কিছুই না – দেশ প্রেম? সে তো আভিধানিক কথা মাত্র।

আবার ফিরে এলো অসমাপ্ত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ২০১৩ সালে। ৭১ এর মতই মধ্যবিত্ত শ্রেণী যোগ দিল যুদ্ধে। ছোট একটা অংশ রাজাকার দের পক্ষ নিলো এবং একটা অংশ আগের মতই থেকে গেল নিরপেক্ষ। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই তথাকথিত মেরুদণ্ডহীন নিরপেক্ষ অংশটিই সব সময়ই সব চেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। ৭১ এর সময় যেমন, ২০১৩ এর এই সময়টাতেও এর ব্যতিক্রম হবে না। এরাই বনে যাবে সহনশীল দেশ প্রেমিক। ৭১ এর সময়টা যেমন তারা এখন চেপে যায়, ভবিষ্যতে ২০১৩ সালের কথাও চেপে যাবে। সন্দেহ নাই।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে এখন নিরপেক্ষ হতে চান মতিউর রহমান চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, আসিফ নজরুল সহ অনেক নিরপেক্ষ বিশ্লেষক। কাদের ছিদ্দিকির কথা বল্লাম না আর। হুমায়ুন আজাদ স্যারের একটা বিখ্যাত কথা দিয়ে শেষ করি “একজন রাজাকার সবসময়ই রাজাকার কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা চিরজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয়”।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment