ঢাকাকে বাচাঁতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে বিশেষ আবেদন

ঢাকাকে বাচাঁতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে বিশেষ আবেদন

সেদিন চ্যানল আই আর ডেইলি স্টার এর উদ্যোগে আয়োজিত লাইভ অনুষ্ঠান ‘প্রধানমন্ত্রী সমীপে’ দেখছিলাম, গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাদের এই উদ্যোগকে অন্তর থেকে স্বাগত জানাই। গণসচেতনতাই শুধু সার্থক করতে পারে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীকে বাচাঁতে, ঢাকাকে বাচাঁতে। শুধুমাত্র আইন পাশ করে এ লক্ষ্য অর্জিত হবে না।থাকতে হবে জনগণের শতভাগ অংশগ্রহণ। নতুবা আদালতের বেড়াজালে আটকে থাকবে এই সাফল্য।

আমি একজন প্রকৌশলী। দীর্ঘ আট বছর যাবৎ আমি স্থানীয় সরকারের ‘নগর পরিকল্পনা’র সাথে জড়িত। মূলত পানি নিষ্কাষণ আর পানি ব্যবস্থাপনাই আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। পানি নিষ্কাশন আর পানি ব্যবস্থাপনা প্রধান অবজেক্ট ধরে অস্ট্রেলীয়রা একটি নতুন শহর গড়ার পরিকল্পনা করে। আর আমরা একটি পরিকল্পিত পানি নিষ্কাশন-কে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছি। ঢাকা শহরের নিষ্কাশনকারী সমস্ত নালা/খাল বন্ধ করে দিয়েছি। ঢাকার এক কোটি লোকের ব্যবহৃত পানি কোথায় যাবে? কীভাবে যাবে? অথবা পানি পাবো কোথায়? এর সমাধান আমাদের বের করতেই হবে। সমাধান অবশ্যই আছে। সমাধান বের করতে না পারলে আমাদের ঢাকা হয়তো কালের আবর্তে হারিয়েই যাবে। হয়তো সারাবিশ্ব একদিন টেলিভিশনে দেখবে ঢাকা মহানগর মাটির নিচে ২০ ফুট দেবে গেছে।

উন্নত দেশগুলোর ন্যায় মেলবোর্নে মানুষের ব্যবহারের জন্য গ্রাউন্ড ওয়াটার ব্যবহার করা হয় না। কোনো অবস্থাতেই গ্রাউন্ড ওয়াটার উত্তোলন না করে ব্যবহার করা হয় সারফেস ওয়াটার বা নদীর পানি।

আমরা জানি মাটির নিচে পানি যেখানে জমা থাকে তাকে বলে এ্যাকুইফার। ঢাকায় এ্যাকুইফার থেকে পানি তুলতে তুলতে এর স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। এর তীব্র ক্ষতিকারক দিকটি আমি তুলে ধরছি।

আমরা জানি এ্যাকুইফার এর উপরিভাগে যে মাটি থাকে তা নিচের দিকে একটা চাপ প্রয়োগ করে থাকে আর এ্যাকুইফার এর পানির স্তর উপরের দিকে চাপ দিয়ে থাকে। এই উপর ও নিচে দিকের চাপে ভারসাম্য রক্ষা হয়ে থাকে একটি প্রাকৃতিক নিয়মে। কিন্তু আমরা যদি ক্রমাগত এ্যাকুইফার পানি তুলতেই থাকি তাহলে পানি উপরের দিকে চাপ দিয়ে যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে তা নষ্ট হয়ে যাবে এবং মাটির চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। হয়তো হঠাৎ একদিন সমগ্র ঢাকা অথবা এর অংশবিশেষ ভারসাম্য হারিয়ে ১০ থেকে ২০ ফুট দেবে যাবে।

ঢাকার এ্যাকুইফার এর স্তর বজায় রাখার জন্য আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গ্রাউন্ড ওয়াটার থেকে পানি উত্তোলন কমাতে হবে।

মেলবোর্নে বৃষ্টিপাত ঢাকার চেয়ে অনেক কম। তারপরও এরা বৃষ্টির পানি ঠিকমতো সংরক্ষণ করে রিজার্ভে অথবা নদীতে। এরা পানি নিষ্কাশনের জন্য দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে। একটি সুয়ারেজ সিস্টেম, অপরটি স্ট্রম ওয়াটার সিস্টেম। মেলবোর্নে প্রতিটি বাড়ীতে এই দুইটি লাইন আছে। সুয়ার লাইন দিয়ে সুয়ার ওয়াটার যাচ্ছে। আর সারা বছর যত বৃষ্টি হচ্ছে সমস্ত বৃষ্টির পানি স্ট্রম ওয়াটার লাইন দিয়ে সংরক্ষণাগারে যাচ্ছে, যা পরে ট্রিটমেন্ট করে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্রাউন্ড ওয়াটার থেকে পানি উত্তোলনের ব্যাপারে এরা অত্যন্ত রক্ষণশীল। যেকেউ ইচ্ছা করলে ডীপ টিউবয়েল স্থাপন করতে পারেবন না।

আর আমাদের ঢাকায় তো প্রচুর বৃষ্টি হয়। আমরা যদি এই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে পারি, অন্তত ৫০ শতাংশ পানি গ্রাউন্ড ওয়াটার থেকে কম উঠাতে হবে।

স্ট্রম ওয়াটার কালেকশানের জন্য আমি প্রস্তাবনা দিচ্ছি:

১. ঢাকার সমস্ত বাড়ীর বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে স্ট্রম ওয়াটার পাইপ দিয়ে (বর্তমানে সুয়ার এবং স্ট্রম ওয়াটারে একই পাইপ ব্যবহৃত হচ্ছে) সংরক্ষণ করতে হবে। ইতিমধ্যে ভূমিমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকার ১১টি খাল পুনরুদ্ধার করা হবে। এই ১১টি খাল সংরক্ষণ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।

২. ঢাকার চারপাশে প্রবাহিত নদীগুলোর পানি দূষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কলকারখানার দূষিত পানি শোধন করেই শুধুমাত্র নিষ্কাষণ করতে হবে। এই শোধন কোম্পানির নিজ উদ্যোগে করতে হবে। শুধুমাত্র কঠোর আইন এবং জন সচেতনতা-ই এর সাফল্য আনবে।

৩. প্রতিটি নদীর ‘ফ্লাড প্লেইন’ এলাকা দখল হয়ে গেছে। বেদখলকারীর হাত থেকে শক্ত আইন প্রয়োগ করে নদীর জায়গা উদ্ধার করতে হবে। পানির প্রবাহের জন্য ক্রস সেকশন বাড়াতে হবে।

৪. উদ্ধারকৃত ১১টি খালসহ সবগুলো নদীর ডাটা সংগ্রহ করে সিটি কর্পোরেশনের কম্পিউটারে সংরক্ষণ করতে হবে। এই কম্পিউটারাইজড ডাটা-ই নদীর সীমানা নির্ধারণ করবে। নদীর সীমানায় কেউ কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারবে না। এই ফ্লাড প্লেইন এলাকা সকল সময় উন্মুক্ত থাকবে।

মেলবোর্নের মতো সারা ঢাকা কম্পিউটার এর নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলেও অন্তত ঢাকার সকল খাল ও নদীগুলোর অবস্থান নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আমাদের যে দক্ষ প্রকৌশলীরা রয়েছেন, তাতে এই কাজ কঠিন নয়। শুধু আন্তরিকভাবেই চেষ্টা চালাতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে আসুন তাহলে সাফল্য ১০০ ভাগ। রংপুরের তিস্তা বাধের নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন বাংলাদেশের প্রকৌশলীরাই করেছিল এবং কোনো বিদেশী সাহায্য ছাড়াই। আমরা সব পারি এবং পারবো।

সবশেষে আমার আবেদন ঐতিহ্যবাহী মেগাসিটি ঢাকাকে বাচাঁতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ব্যক্তিগতভাবে আপনি জোরালো উদ্যোগ নিন। ঢাকাকে বাচাঁনোর জন্য আপনার নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে। আমরা চাই না, আমাদের প্রিয় ঢাকা কালের আবর্তে হারিয়ে যাক।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment