কেউ আসবে! কেউ আসবে…
এক লিটার কেরোসিন কিনলাম। দাম দিতে গিয়ে আমার আক্কেলগুড়ুম, ‘বাষট্টি টাকা’!
কি বলে ইনি! আট/দশ টাকার কেরোসিন বাষট্টি টাকা!! মগের মুল্লুক নাকি? বৃদ্ধ দোকানির উপর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেলাম। সেই থমকে যাওয়া মুহূর্তে আবিস্কার করলাম, অনেক বছর কেটে গেছে, আমি শেষবার বাজারে এসেছি। অনেক বছর! সেই ক্লাস ফোর, ফাইভ কিংবা সিক্স-সেভেনে থাকতে শেষ বাজারে গিয়েছি, তখন কেরোসিনের দাম ছিল আট, দশ কিংবা বড়জোর পনের টাকা! বাড়ীর পাশের ছোট্ট আড়িয়াল খাঁ’য় এরপর কত জলা গড়াল, স্কুলের পেছনের বিশাল পুকুরখানা ভরাট হয়ে বালুর মাঠ হয়ে গেল, টিনের ভাঙ্গা স্কুলখানা পাকা দালান হোল। সব বদলাল। কেরোসিনের দাম তাতে কি-ই বা বদলেছে! মাত্রতো ৫ কিংবা ৬ গুণ। মানুষ বরং বদলেছে তারচেয়ে অনেক বেশি, অনেকগুণ বেশি…
সপ্তাহে হাট দুইদিন। শনি আর মঙ্গল।
আব্বা তখন ঢাকায় থাকেন। আমরা দুই ভাই, আম্মা আর দাদী থাকি বাড়িতে। ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়া আমিই তখন বাজার সদায় করি। আব্বা মাস শেষে টাকা পাঠান, সেই টাকার প্রতিটি পয়সা তিনবার করে গুণে খরচ করেন আম্মা। তাতে যদি খরচ কিছু কম হয়! ৫ টাকা ১০ টাকায় চিংড়ি কিংবা পুঁটিমাছের ভাগ পাওয়া যায়, আমরা দুই হাটে একবার সেই মাছের ভাগ নিয়ে যাই। সেই মাছ দেখে আম্মার বকুনি অবধারিত, ‘মাছ নাকি পচা! এই পচা মাছ তিনি কি করবেন?’
তিনি অবশ্য ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নন। সেই মাছ কড়কড়ে করে ভাজেন। আমরা দুই ভাই ভাতের পাতে যত্ন করে একপাশে সেই মাছ সাজিয়ে রেখে তার গন্ধে গপাগপ ভাত খেয়ে ফেলি। মাছ পড়ে থাকে পাতে। আম্মা তৃপ্তি নিয়ে দেখেন। আম্মা তার শাড়ীর আচলে আমাদের মুখ মুছিয়ে দেন। ভাত খাওয়া শেষে কড়কড়ে ভাজা মাছ হাতের তালুতে নিয়ে আমরা গ্রাম বেড়াতে বের হই। ধুলো মাখা আদুল গায়ের ছালেক, সবুজ কিংবা পলাশকে দেখিয়ে দেখিয়ে মচমচ করে খাবো! মাছের স্বাদ তখন বেড়ে যাবে অনেক গুণ! আরও অনেক অনেক গুণ!!
কিছু একটা হয়েছে! আব্বার কোন খোঁজ নেই। গতমাসে তিনি টাকা পাঠান নি। আম্মা প্রতি সকালে কান উৎকীর্ণ করে শুয়ে থাকেন। ওই যে ঢাকার লঞ্চ এলো। বাড়ীর পাশ দিয়ে ঢাকা থেকে আসা লোকগুলো হেঁটে যায়। আম্মার বুক ধরফর করে, ‘এই বুঝি কেউ ডেকে বলবে, ও ভাবী, ঘুমান? ওঠেন, ওঠেন, সাদাতের আব্বায় টেকা পাঠাইছে আর চিঠিও পাঠাইছে’।
কিন্তু কেউ ডাকে না। আমরা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ভাত খেতে বসি। আম্মা কম্পিত হাতে আমাদের প্লেটে ভাত বেড়ে দেন। পানি দেয়া পান্তা ভাত। আমরা চুপচাপ পিয়াজ মরিচ আর লবণ দিয়ে খেয়ে উঠি পড়ি। আব্বা যে টাকা পাঠান নি সেটা আমরাও বুঝি! চাল শেষ হয়ে আসে, নুন, ডাল, তেল, লবণ, কেরোসিনও… আম্মার মুখ ক্রমশই চুপসে আসে। তিনি একবেলা আধবেলা উপোষ দেন, আমরা খেতে বসলে আমাদের মুখের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে থাকেন, ‘এই বুঝি আমরা আবার ভাত চাইবো! এই বুঝি বলবো, ‘মাছ ছাড়া ভাত খামু না’।
শুরু হয় ধারের পালা, এক কেজী চাল, দুই কেজী চাল। পাশের বাড়ির মিস্ত্রির বউ, ঘরামীর বউ, ধারের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। নুন, তেল, ডাল। আব্বার কোন খবর নেই। আমরা অপেক্ষায় থাকি। রোজ ভোরে আমরা দুই ভাই চুপি চুপি উঠে আধোঅন্ধকারে লঞ্চঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ওই বুঝি আব্বা এলো, কিংবা টাকা পাঠাল। কতদিন কড়কড়ে মাছ ভাজা খাই না! আম্মাকে অবশ্য বুঝতেও দেই না, ভাত খাওয়ার সময় পেট পুরোটা ভরে না, ভরে অর্ধেকটা। আমরা দুই ভাই ভান করি, আমাদের পেট ভরে টইটম্বুর। আর একদানা ভাত খাওয়ার জায়গাও পেটে ফাঁকা নেই! মাছ না হলেও ভাতের স্বাদ ভালো হয়েছে!
কিন্তু আম্মা বোঝেন। তিনি আচলে চোখ লুকিয়ে কাঁদেন। আর অপেক্ষায় থাকেন। আব্বা কবে আসবেন? কবে টাকা পাঠাবেন? আমরা অপেক্ষায় থাকি… আবার কবে, প্লেট জুড়ে ফুলের মতন ফুটে উঠবে ধোয়া ওঠা গরম ভাত, আর কড়কড়ে ভাজা পুঁটিমাছ…!! কবে?
আব্বা এসেছিলেন। তার কিছুদিন পরেই এসেছিলেন। সরকার বদলাবে বলে তখন দেশের অবস্থা খারাপ। ঢাকায় ছোট্ট একটা চাকুরি করেন আব্বা, সেই অফিসের ব্যাবসায় তখন তুমুল মন্দা। আব্বা তাই দু’মাস বেতন পান নি।
আজ নিউমার্কেট থেকে মতিঝিল যাবো।
রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘মামা যাবেন?’
হন্তদন্ত হয়ে এতোগুলা রিকশাওালা ছুটে এলো ‘জ্বে মামা, যামু চলেন’
আমি বৃদ্ধ দেখে একজনকে বললাম, ‘যামু যে বললেন, কই যামু জানেন?
বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা কেমন অদ্ভুত গলায় বললেন, ‘যেইহানে যাইবেন অইহানেই যামু, চলেন’।
আমি কিছুটা অবাকই হলাম। ঢাকা শহরের রিকশাওয়ালাদের আচার-আচরন নিয়ে আমার চরম বিরক্তি এবং আপত্তি! আজ হঠাৎ কি এমন হোল!!
রিকশায় উঠে বললাম, ‘কি ব্যাপার মামা, আজকে এমন করে সবাই ঝাপাই পড়লেন? অন্যদিনতো পাত্তাই দেন না’।
রিক্মশাওয়ালা মামা সাথে সাথে কোন উত্তর দিলেন না। অনেক্ষন পর বললেন, ‘কি কমু বাজান? প্যাডে ভাত না থাকলে বাছবিছার থাহে না। কথায় কয় না, খয়রাতির চাউল, কাড়া আর আকাঁড়া ( ভিক্ষার চাল, ভালো আর মন্দ)।
আমি বললাম, ‘মানে কি?’
উনি বললেন, ‘বাড়ী থেইকা আইছি দুইমাস হইছে, খ্যাপ নাই। রাস্তায় মানুষ নামে না। দ্যাশের যা পরিস্থিতি! বেবাকের ব্যাবসাপাতি খারাপ, আয় রোজগার নাই। মাইনসের পকেটে টেকা নাই। কি করমু বলেন। যে টেকা পাই, নিজের খাওন, থাকন আর রিকশাভাড়া দিতেই শ্যাস। তারউপর, জিনিসপত্রের দাম গ্যাছে বাইরা। কেমনে বাচুম কন। বাড়ির কোন খবর নিতেও মন চায় না। কি কমু? বেবাকেতো আমার দিক চাইয়াই আছে!’
আমি কি বলবো, বুঝি না। চুপচাপ বসে থাকি। উনি ক্লান্ত পায়ে প্যাডেল চাপছেন। আমি বললাম, ‘দুপুরে খাইছেন?’
– ‘কি কইলাম হুনেন নাই? এই মাসে বাড়িতে যাইতেই হইবো। কিছু টেকা হাতে রাখতেই হইব। খরচ যত কমান যায়। খামু যে, মাইনসে কি মাগনা খাওয়াইব? ভিক্ষাওতো করতে পারুম না।’
কি বলবো আমি? এ ক’দিনে একবারও মনে হয় নি। আসলেইতো! আমারওতো ঠিকমত বেতন হচ্ছে না, গত মাস দুয়েক ধরে! এই মাসেও এমন হোলে বিপদেই পড়ে যাবো! কিন্তু এরা কি করবে? আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দ্যাশের বাড়িতে কি অবস্থা?’
– ‘কি অবস্থা, আল্লায় জানে! দ্যাশে তো ভিক্ষা করনেরো অবস্থা নাই। আমার বাড়ী কুড়িগ্রাম। চড়ের মইধ্যে। হেইহানে বেবাকেরই একই অবস্থা! ভিক্ষাটা দিবে কি? হাসিনা দেবে? না খালেদা দেবে? কেউ দেবে না, কেউ না! টেনশনে রাইতে ঘুম হয় না। খালি মনে হয় ঘরে বেবাকটি আমার পথ চাইয়া আছে!’
আমি জবাব দেয়ার মত কিছু খুঁজে পাই না। শুকনো খটখটে পায়ে প্যাডেল মেরে যাওয়া মানুষটার প্যাডেলের দিকে তাকিয়ে থাকি! ঘুরছে! ঘুরছে!! চক্রের মত! সেই জীবন, সেই গল্প, সেই চক্র! সব একই! আমার হঠাৎ মনে হয়, কুড়িগ্রামের কোন এক ক্ষুধার্ত চড়ে ভাঙ্গা বেড়ার ভেতর থেকে একজোড়া নির্ঘুম চোখ অপেক্ষায় আছে। প্রবল শীতে ছেড়া কাঁথার তলায় দু-চার জোড়া নিস্পলক চোখ অপেক্ষায় আছে।
কেউ আসবে! কেউ আসবে…
প্লেট জুড়ে ফুলের মতন ফুটে উঠবে ধোয়া ওঠা গরম ভাত, আর কড়কড়ে ভাজা পুঁটিমাছ…