আমরা ১৯৭১ সালের মত আপোষহীন

আমরা ১৯৭১ সালের মত আপোষহীন

মেলবোর্ন মেট্রো ট্রেনে বসে ভাবছিলাম মেলবোর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্কন স্কয়ারে বসে আমার বাংলা মায়ের কথা ভাববো এবং সেখানে বসেই এবার লিখব। কারণ বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিষয়টি আবার জটিল হয়ে উঠেছে। এখন এখানে বসন্ত তথাপি একটি সুন্দর দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ গত ক’দিন মেঘ আর বৃষ্টি ও সেই সাথে দক্ষিণ মেরু থেকে আসছে শীতল বাতাস। এবার প্রকৃতি যেন অন্যরকম। আসছে সামার। গাছপালা আবার সবুজ পাতায় ও রঙ্গিন ফুলে ভরে গেছে। এক অদ্ভুত সুন্দর যেন এ পৃথিবী!

যারা দাবী করেন মেলবোর্ন বিশ্বের সেরা শহর তারা সত্যি কথাটাই বলেন। তবে এত সুন্দরের মাঝেও মনটা ছুটে যায় বাংলাদেশে। আমার দেশও এমন সুন্দর ছিল! খুব কষ্ট হলেও বলতে হলো মেলবোর্ণ সুন্দর, মানতে হলো বাংলাদেশ এর চেয়েও সুন্দর ছিল। সেই যে পাকহানাদাররা পুড়িয়ে দিল, আর বুঝি আমরা ফিরে পেলাম না বাংলা মায়ের সেই সবুজ-সোনালী-কোমল শানি-র বুক- যেখানে মাথা পেতে নি:চিনে- ঘুমতে পারি।

গত কয়েক দিন বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি বসনে-র আমেজ নষ্ট করে দিচ্ছে। তথাপি এদেশের মানুষ খুশি। কারণ মিষ্টি পানির অভাব আছে দেশটিতে। বৃষ্টি তাই সব সময় সুস্বাগতম। মিষ্টি পানি- এই একটি জিনিষের অভাব আমার বাংলা মায়ের ছিল না। এখন সার-কীটনাশক-ফারাক্কাপ্রভাব-ট্যানারি ও গার্মেন্টস বজ্য সেটিকে ধংস করছে।

ভাবছিলাম আধুনিক দর্শনের জনক রেনে ডেকার্টের সংশয় পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ নিয়ে ভাববো আর লেখার চেষ্টা করবো। কারণ ইতিমধ্যে আবার ধংসের হরতাল শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ফোন কোন প্রভাব বেগম জিয়ার মাঝে পড়েনি। তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে “না” বলেছেন। ইতিমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা স’গিত হয়েছে। সকল স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্দ। তবে বিদেশী ডিগ্রি পরীক্ষা চলবে! হরতালেও ধনীরা মাফ পাবেন? জননেত্রী বটেন।

নিজেকে প্রশ্ন করেছি আর জানতে চেষ্টা করেছি- এভাবে কি একটি জাতি চলতে পারে? একবার বাঙালি, আরেকবার বাংলাদেশী। একবার বঙ্গবন্ধু, আরেকবার জিয়া। একবার দেশনেত্রী, আরেকবার জননেত্রী। আমরা জনগণ এভাবে আর কত নিষ্পেষিত হব? আব্রাহাম লিঙ্কন কি এই গণতন্ত্রর জনক? যদি গণতন্ত্র মানে হরতাল দিয়ে নিপীড়ন তবে আমরা কি ওই গণতন্ত্র চাই?

বেশ শীত। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। তাই নেমেছি প্রশান- মহাসাগরের পাড়ে নর্থ মেলবোর্ণ রেল স্টেশনে। সেখানে দাড়িয়ে শহরটাকে যেমন দেখা যায় তেমনি প্রশান- মহাসাগর। প্লাাটফর্মে দাড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবছি- আমরা গণতন্ত্র চাই, আবার উন্নয়নও চাই। আবার রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ চাই। এসব যেমন চাই, তেমনি চাই নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার যা বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

কোথাও থামতে হবে। হিলারী বুদ্ধিমতি। তিনি থেমেছেন। তিনি ওবাবমাকে ২০০৮ সালের ২রা জুলাই পর্যন- চ্যালেঞ্জ করেছেন। অত:পর থেমেছেন। ওবামা দ্বিতীয় দফায় দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। এবং তিনি ওই রাষ্ট্রপতি পদে থেকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। জনগণ যদি চায় তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন। কেন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম জিয়া সেখানে অন-রায় হয়ে দাড়াবেন?,কেন সুশীল সমাজ একটি ভুল পথে দেশকে নিয়ে যাবেন? কেন বেগম জিয়া বিজয়ের পথ তৈরীতে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবি করবেন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাড়িয়ে? কেন একটি স্বাধীন দেশের অগ্রযাত্রায় ৬০ ঘন্টা হরতালের ডাক দেবেন আ সমগ্র দেশকে জেলখানায় পরিণত করবেন? এটা কি দেশপ্রেম না ক্ষমতা প্রেম?

অনেকেই হয়তো বলবেন বেগম জিয়া ক্ষমতা লোভী নন। তিনি অহমিকায় ভোগেন না। তিনি সবাইকে সম্মান দিতে পারেন। হয়তো ঠিক। আমিই ভুল করছি? না- আমি ভুল করছি না। কারণ আমি মুক্ত। এখানে আমার ভাবতে কোন বাধা নেই। বরং, তিনি আজ বন্দিনী। বন্দি হয়েছেন রাজাকার শিবিরে। তাই তিনি হরতাল আর ধংসের পথ বেছে নিয়েছেন। জাতি যেন এই হরতালে মাথা নত না করে। হরতাল আল বিদা।

স্টেশন ছেড়ে বাসে চড়লাম। বিশ্ববিদ্যালয় সার্ভিস। বাস গিয়ে থামবে লিঙ্কন স্কয়ারে। আমি আবার ভাবছি- আমরা জানি বেগম জিয়া বীরাঙ্গনা সম। তিনি ১৯৭১ সালে সেনানিবাসে বন্দী জীবন যাপন করেছেন। তিনি সন-ানদের নিয়ে সেই সময় কষ্টের জীবন যাপন করেছেন। বিগত ৬ বছর তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন। সরকারের দায়িত্ব এই মহান নেত্রীর- (যার প্রায়ত স্বামী একজন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার ছিলেন- যার অবদান কোন অংশেই কম নয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও দেশ গড়ায়- )জন্য একটি ব্যবস’া করা যাতে তিনি যেন আবার পরিবারের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। একজন লন্ডন আর আরেকজন থাইলা্যান্ড। তিনি বাংলাদেশে। সবাইকে তিনি যাতে এক সঙ্গে পান সেজন্য সরকারের উচিত লন্ডনে সবার জন্য চিরস’ায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া অথবা তারেক ও আরাফাত রহমানকে দেশে ফিরে আসতে অভয় দেওয়া। সেক্ষেত্রে সরকার নিরপেক্ষ থাকবে। কোনভাবেই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবেন না এবং যতদিন ওনাদের অপরাধ প্রমাণিত না হবে ততদিন কোন হয়রানির শিকার হবেন না। সরকার যদি এমন একটি অফার বেগম জিয়াকে দিতে পারেন তবেই হয়তো একটি ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

এমন অফার নেবেন কি? হয়তো বলবেন- না- আমি দেশকে ভালবাসি। বিদেশে আমার কেঊ নেই। এই কেঊ মানে আমরা নই- এই কেঊ হল রাজাকার-আলবদর-আলশামস- শিবির-যুদ্ধাপরাধী। তিনি ওদেরকে ভালবাসেন। বন্ধু ভাবেন। বিশ্বাস করেন। তিনি কোথাও যাবেন না।

আচ্ছা- সরকার কেবল এক তরফা সহযোগিতা দিলেই চলবে? বেগম জিয়াকেও কি বলতে হবে না তিনি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ কখনই নেবেন না। তিনি আর কোনদিন হরতাল দেবে না। তিনি জনগণের জন্য জনগণের পাশে থাকবেন। তিনি জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দেবে ক্ষমতায় গেলে আবার সংবিধানে কাঁটাছেড়া করবেন না। জাতির জনকের নাম মুছে দিতে মাঠে নামবেন না, তিনি ১৫ আগষ্ট জাতির জনকের মাজারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে তবে কেকে কাটবেন। জম্মদিন পালনের অধিকার আছে তবে সেটি কাঊকে আঘাত করতে নয়। আমরা প্রতিটি জম্মদিন সুন্দরভাবে পালন করতে চাই তেমনি সকল হত্যাকান্ডকে নিন্দা জানাতে চাই। আমরা জিয়াকে আর খুনি বলে অভিযুক্ত করবো না, আমরা বলবো না ২১শে আগষ্ট গ্রেনেড হামলায় তারেক জড়িত ছিলেন। আমার কল্পনা থেমে যায়। কারণ বাস চালক বলছেন- নামতে হবে। আমরা লিঙ্কন স্কয়ারে পৌছে গেছি।

লিঙ্কন স্কয়ার। অনেকগুলো বটগাছ। সবচেয়ে বড় গাছটির নীচেয় দাঁড়ালাম। মনে পড়লো রমনা বটমুল। সেখানেও পহেলা বৈশাখে হামলা। মনে পড়লো প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা। সেখানে ১৯৮২-৮৩তে এরশাদের হামলা। আমি ভাবছি দেশকে নিয়ে। এই মাত্র যা ভেবেছি- জানি এমনটি হবে না। কারণ একথা সত্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে টেক্কা দিয়ে মেজর জিয়া ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হতে চেয়েছিলেন। তিনি সেদিন ব্যর্থ হয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের হাত মিলিয়ে ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের দায় গ্রহণ করেছেন এবং দেশে অবৈধ্য শাসনের দ্বার উম্মোচন করেছেন এবং সেই পথে এরশাদ-মঈন হেঁটেছেন।

তিনি যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন ততদিন পত্রিকার পাতায় বঙ্গবন্ধুর নামটিও ছাপা যেত না। আমরা কি করে ভুলে যাব জেলে চার নেতার হত্যার কথা, কেন ভুলে যাব কর্ণেল তাহেরকে হত্যা করার বিষয়টি? কেন ভুলে যাব আমরা জেনারেল মঞ্জুর হত্যা ও ১২ জন সামরিক অফিসারের ফাঁসি কথা? সেদিনতো বেগম জিয়া ওই ১২ জন সামরিক অফিসারকে বাঁচাতে আসেন নি। তিনি জেদ ও লোভ তাড়িত হয়ে ১২ই ফেব্রুয়ারী একক নির্বাচন করেছেন। তিনি কিভাবে ২৫ শে ফেব্রুয়ারী হত্যাকান্ডের দায় এড়াবেন? কারণ তিনি আবারও বলেছেন ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন’ তিনি ক্ষমা চাননি। তিনি কোনদিন বলেননি ১৫ আগষ্ট যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তারা খুনি। বরং, তিনি ও জিয়া তাদের উওরসূরী।

আবার ঝম ঝম করে বৃষ্টি এল। আমার আর বটতলায় বসে ভাবা হলো না। তবে যাওয়ার আগে চিৎকার করে বললাম- লিঙ্কন, আমরা ওই বাংলাদেশ আর চাই না যেখানে রাজাকার ও খুনি শাসকের আসনে বসে। ১৯৭১ সালে যেমন আমরা আপোষহীন ছিলাম তেমনি চিরদিন আপোষহীন থাকবো গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য। লিঙ্কন তোমাকে ধ্যবাদ, বঙ্গবন্ধু তোমাকে অভিবাদন। জয় বাংলা।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment