স্পন্দনের চ্যারিটি অনুষ্ঠান ও আমার অনুভূতি

স্পন্দনের চ্যারিটি অনুষ্ঠান ও আমার অনুভূতি

কেনবেরা এখন হাজার বাঙ্গলাদেশীর ঠিকানা। এখানে যারা রয়েছেন প্রায় সকলেই সরকারী চাকুরে- এদের সপ্তাহের ৫দিনই ৯টা-৫টা অফিস। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঘর বাড়ি ধোয়া মোছা, হাট-বাজার করা, আর বন্ধু-বান্ধব’দের বাসায় আড্ডা মারার মতো একঘেয়েমি জ়ীবন থেকে কিছুটা স্বস্থি পেতে এরা সুজ়োগ পেলেই সম্ভবত সময় কাটায় গানবাজনা’র অনুষ্ঠানে। এখানে গানবাজনা হয় জাতীয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে, বিয়ে বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। গান বাজনা হয় পুজোর অনুষ্ঠানে, গান বাজনা হয় ঈদ পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠানে, আবার ঘরোয়া ভাবেও বসানো হয় গানের জলসা। আমরা যারা গান গাইতে জানি না কিন্তু গান ভালোবাসি তারা ৫, ১০, ১৫, ২০ এমনকি ৪০, ৫০ ডলার জনপ্রতি খরচ করেও গান শুনি। গান’কে আমরা, কেনবেরার বাঙ্গালীরা এমনই ভালবাসি যে আমরা গান শুনতে শত শত ডলার খরচ করে কেনবেরার বাইরে অনেক দূরে দূরেও যাই। শুধু কি তাই-ই, বেশী দাম দিয়ে টিকিট কিনে হলের প্রথম সারিতে বসে গান শোনার লোকের অভাব নেই আমাদের কেনবেরাতে- এখানে গানের অনুষ্ঠান গুলিতে প্রথম সারির টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে যায়।

গানপ্রিয় বাঙ্গালীদের গান শুনাতে কেনবেরাতে তাই গানের শিল্পীরা তৈরীও করেছে কয়েকটি গানের দল – ‘স্পন্দন’ ঐ রকমই একটি গানের দল। ওরা দল বেধে গান করে ২০০৬ সাল থেকে। ভিন্ন ভিন্ন শিরনামে ভিন্ন ভিন্ন অনুস্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ নিয়ে গান করে যাছে ওরা।

গত ১৩ অক্টোবর ২০১২ ওরা একটি সঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন করেছিল- যেটার নাম দিয়েছিল ‘মনে পড়ে দেশকে’। ওদের সেই সঙ্গীত সন্ধ্যার লক্ষ ছিল ‘বাংলাদেশ কেনবেরা ফ্রেন্ডশিপ স্কুল’- এর জন্যে ফাণ্ড রেইস করা। সেই অনুস্ঠান উপলক্ষ্যে বেড় করা ওদের সুভেণীর পড়ে জেনেছি এর আগেও এধরনের চ্যারিটির জন্যে এই দলটি গানের অনেক অনুষ্ঠান করেছে- কষ্টে থাকা বাঙালীর কষ্ট দূর করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে স্পন্দনের ডাকে সারা দিয়েছে অনেক বাংগালীরা।

চ্যারিটির জন্যে এধরনের গানের অনুষ্ঠান যতই হবে ততই ভালো বাংলাদেশের জন্যে। অস্ট্রেলিয়াতে আমরা যারা বাংলাদেশী রয়েছি ভালো তাদের জন্যেও। এখানে আমরা যারা বিভিন্ন্ কাজের চাপে পিছনে ফেলে আসা দেশী বন্ধু-বান্ধব, আত্তীয়-অনাত্তীয়দের একটু মনে করার ফুরসতও পাই না তাদের জন্যে এই ধরনের চ্যারিটি অনুষ্ঠান খুবই ভালো। কারন, এধরনের অনুষ্ঠান আর না হোক ২-১ ঘন্টার জন্যে হলেও দেশটির জন্যে, দেশের মানুষের জন্যে, দেশে ফেলে আসা আমাদের প্রতিবেশীদের জন্যে ভাবতে সাহায্য করে আমাদের। জাগাতে সাহায্য করে বাঙ্গালীর অনুভুতিকে- একজনের কষ্ঠে অন্যের কষ্ঠ পাওয়ার অনুভুতি। এ এধরনের গানই পারে বাঙ্গালী অনুভুতিকে জাগিয়ে রাখতে।

গানের সাথে মিল রেখে স্পন্দনের অনুষ্ঠানে সেই সন্ধাতে প্রজেক্টরে দেখান হয়েছিল গ্রামবাংলার অনেক ছবি। ঐ সব ছবি আর গানে আমার গ্রামের কথা মনে পড়ছিল, মনে পড়ছিল সে দিনগুলির কথা যখন ধান ক্ষেত পেড়িয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে স্কুলে যেতাম; স্কূলে কাদা মাটিতে কবাডি খেলে বাড়িতে ফিরলে মায়ের বকুনি খেতাম। স্মৃতিতে ভাসছিল আমার কলেজ বন্ধু শৈলেন । বকেয়া বেতন পরিশোধ না হওয়ায় কলেজের প্রিন্সিপ্যাল যখন ওকে পরীক্ষাতে বসতে দিতে রাজি নন সেসময় পরীক্ষাতে বসতে চেয়ে প্রিন্সিপ্যালের কাছে কাকুতি মিনতি করে ও বলছিল ‘বোড়ো ধানে মাত্র শিষ বেরিয়েছে, ধান কাটা হলে ওই ধান বেচে কলেজের বকেয়া বেতন দিয়ে দেবে বলেছেন বাবা- আমাকে তাই পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেসন পত্রটা দিয়ে দিন স্যার’- । পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেসন পত্র নিতে লাইনে শৈলেনের পিছনে আমি দাড়ান ছিলাম- ওর কথার আওয়াজে মনে হচ্ছিল ও কান্না করছে – রেজিস্ট্রেসন পত্র না পেয়ে শৈলেন সেদিন লজ্জায় প্রিন্সিপ্যালের ঘর থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ী চলে গিয়েছিল। এর একমাস পড় শৈলেনের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল মাদারীপুরের পরীক্ষার হলে। ওর সাথে আলাপে জেনেছিলাম, শৈলেনের বাবকে প্রিন্সিপ্যালের সাথে দেখা করতে হয়েছিল শৈলেনের পরীক্ষায় বসাবার ব্যবস্থা করতে। সেদিন শৈলেনকে উপলব্ধি করতে না পারলেও আজ আমি ভালো ভাবেই বুঝতে পারি শৈলেনের মতো লক্ষ শৈলেন এখনো আছে যারা অর্থের অভাবে থেকেও পড়ালেখাকে আকড়ে থাকে কেন। শৈলেন এখন অনেক বড়ো চাকুরি করে- ও এখন গ্রামের গরিব ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার প্রতি খেয়াল রেখে ২টো স্কলারশিপ চালায় বলে জেনেছি।

প্রজেক্টরে গ্রামবাংলার ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল গলাচিপার বন্যা বাধের উপর ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া ঘরের মধ্যে মরে পরে থাকা সেই বৃদ্ধার কথা। এমনি সব এলোমোলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে হটাত দেখলাম স্টেজের পর্দা পড়ে যাচ্ছে – গানের বিরতির পর্দা।

বিরতিতে হলের বাইরে এলে বন্ধুদের অনুরোধে স্কুলের ফান্ড তুলতে খাবার বেচা-কিনা করতে বাধ্য হলাম। যে স্কুলের জন্যে ফান্ড তুলা হছে সেই স্কুলের উদ্যোগতাদের মধ্যে আমিও যেহেতু একজন- তাই ওদের অনুরোধ উপেখ্যা করে বিরতির পর স্পন্দনের গান শুনতে আমার আর হলের ভিতরে যাওয়া হয়নি। তবে হলের ভিতর আমাকে আবার যেতে হয়েছিল রাফেল ড্র-এর কুপন হাতে বন্ধুদের অনুরধেই। স্কুলের জন্যে ফান্ড তুলতে এই রাফেল ড্র।

মঞ্চে যখন ড্র’র বিজয়ীদের নাম ঘোষনা করছিলাম তখন ‘৩য় আর ২য়’ পর পর দুটো পুরস্কারই একই ছেলের ভাগ্যে পড়েছে দেখে ভাগ্যবান ছেলেটির দিকে চোখ গেল- ভাল ভাবে ওর দিকে খেয়াল করলাম- তখনও ওর হাতে রাফেলের অনেকগুলো টিকিট। বাঙ্গালী বলেই কৌতুহল হল ওর এতোগুলো টিকিট কেনার কারন জানার- সোজা সাফটা ভাবে ছেলেটি বলল, ‘টাকাটাতো স্কুলের জন্যেই যাবে, টিকিট কিনে স্কুলের জন্যে কিছুটা যে সাহায্য করতে পারছি তাতেই আমার আনন্দ। আমার পূরস্কারগুলির টাকাও আমি স্কুলের জন্যে দিতে চাই। এ পূরস্কারদুটির টাকাও আমি স্কুলের জন্যে দিলাম।’ [পরে জেনেছি ছেলিটিকে ওর পূরস্কারগুলি পৌছানো হয়েছে]।

স্পন্দনের সেদিনের সেই সুভেণীরটি পড়ে জেনেছি এর আগেও চ্যারিটির জন্যে অনেক অনুষ্ঠান করেছে স্পন্দন- এমন নয় যে এটিই চ্যারিটির জন্যে স্পন্দনের প্রথম অনুষ্ঠান। তার উপর, কেনবেরাতে ক’দিন আগেই বাঙ্গালীরা যেখানে ২০,৩০ এমনকি ৫০ ডলারে টিকিট কিনে গান শুনেছে, সেটা জ়েনেও ‘স্কুলের জন্যে ফান্ড তুলতে যে গানের অনুষ্ঠান’ সেই গানের অনুষ্ঠানের উদ্যোগতারা কেন যে প্রতিটি টিকিট মাত্র ৫ ডলারে বিক্রি করছে- সেটা বুঝতে পাড়ছিলাম না।

নিজের মত করে এর উত্তর খুজতে ছেস্টা করেছিলাম। তবে কি এই স্থানীয় গানের দলটি সন্ধিহান ছিল যে ওদের গানে শ্রোতা হবে কি হবে না ? নাকি ওরা চেয়েছিল সকলের সাধ্যের মধ্যে যাতে থাকে সেই ভাবে টিকিটের দাম রেখে মানুষকে গান শুনাতে – গানের মাধ্যমে শ্রোতাদের অনুভুতিকে জাগিয়ে তুলতে? অভাবীর অভাব উপলব্ধি করার অনুভুতি। আমার মনে হয় দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের দুর্দশা দূর করতে ওরা অনুষ্ঠান করতে করতে এটা বুঝেতে পেড়েছিল যে, গান-বাজনার শক্তি দিয়ে মানুষের বিবেক নাড়াতে হবে, জাগাতে হবে মানুষের অনুভতিকে। ওরাকি সেই কাজটি করবে বলেই টিকিটের দাম তুলোনামুলক ভাবে খুব কম রেখেছিল?

তবে, নাম মাত্র দামে টিকিট বিক্রি করায় প্রায় ৩৭৫ আসনের হলটি ভরে গিয়েছিল শ্রোতাতে। টিকিট কেনার পাশাপাশি অনেকে ওদের উদ্দেশ্যকে সফল করতে ডোনেশন দিয়েছে- আর সেটার প্রমান পাওয়া গেল ‘৩য় আর ২য়’ রাফেল পুরস্কার প্রাপ্ত ছেলেটির কথাতে। পরে জেনেছি, স্পন্দন ওদের প্রাথমিক হিসাবের তুলনায় বেশি ফান্ড তুলতে পেরেছিল সেই সঙ্গীতসন্ধ্যাতে।
স্পন্দন সেই সঙ্গীতসন্ধ্যাতে নাড়া জাগাতে পেরেছিল বাঙ্গালীকে; জাগাতে পেরেছিল মানূশের মনুস্যত্তকে যে মনুস্যত্ত মানুষকে জাত পাত ভুলিয়ে মানুষের কষ্টকে লাঘব করতে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্দ করে। কেনবেরার বাঙ্গালীরা চরফাসনের ৩০০ গরীব ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সাহায্যে যে সহানুভুতি দেখিয়েছিল, যে ভাবে আর্থিক সাড়া দিয়েছিল স্পন্দনের সঙ্গীতসন্ধ্যাতে, সে ধরনের সহানুভুতি নিয়ে আমরা যারা দেশটির বাইরে রয়েছি তারা যদি দেশটির মানুষের জন্যে ভাবতে পারি তাহলে ‘বাংলাদেশ-কেনবেরা ফ্রেন্ডসীপ স্কুল’ই কেবল নয়, আমরা এধরনের অনেক প্রকল্প হাতে নিয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment