Traffic jam in Dhaka
ঢাকা শহরের যানজট প্রসঙ্গে
ভূমিকাঃ
গনতান্ত্রিক দেশে জনগনের সার্বিক কল্যান নিশ্চিত করা নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব । এই দায়িত্বের মধ্যে আছে, দেশের প্রতিটি শহর ও গ্রামকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা । একটি দেশের রাজধানী শহরে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন মানুষ এবং স্থাপনা থাকে । এ ছাড়া যে কোন দেশের রাজধানী সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে দেশের পরিচয় তুলে ধরে । এই সব বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হওয়া উচিত দেশের সব চেয়ে সুন্দর এবং সব চেয়ে ভালোভাবে জীবন যাপনের শহর । আর এই ভালভাবে বসবাসের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হচ্ছে সুন্দর যাতায়াত ব্যবস্থা । বিধির কি পরিহাস, যানজটের জ্বালায় ঢাকার মানুষের প্রান এখন ওষ্ঠাগত । যানজটে আটকে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন অবর্ননীয় কষ্ট ভোগ করে, আর সমস্যা সমাধানে চরম ব্যর্থতার জন্য সরকারকে অভিসম্পাত দেয় । ভুক্তভোগী মানুষকে এখন ভাবতে হচ্ছে, ঢাকা শহর আর কত দিন বাস যোগ্য থাকবে, অথবা কবে পরিত্যাক্ত হবে ।
তবে এসবই দেশের সচেতন নাগরিক এবং ঢাকা শহরে বসবাসকারী ভুক্তভোগী মানুষের চিন্তা। যানজটের সমস্যা নিয়ে এই সরকারের কোন দুশ্চিন্তা আদৌ আছে কিনা বোঝা যাছে না । সরকার বরং ব্যস্ত, একটির পর একটি স্বল্প প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রচুর অর্থ ব্যয়ের কাজে । আমরা জানি, আইন ভঙ্গ বা জনগনকে কষ্ট দিয়ে যে সব প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আর্থিক সুবিধা লাভ করে থাকে তারা তাদের বাড়তি লাভ রাজনীতিক এবং সংশ্লিষ্ট আমলাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয় । বাংলা দেশে রাজনৈতিক দলগুলির রাজনীতি করার জন্য প্রয়োজনীয় খরচের টাকা স্বচ্ছ ভাবে সংগ্রহ করার কোন পথ না থাকায় রাজনৈতিক দলগুলিকে এই ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অন্যায় সহযোগিতার উপর নির্ভর করতে হয় । শুধুমাত্র এই কারনেও সরকারকে অনেক সময় এমন সব প্রকল্প নিতে হয় যেগুলি পরিনামে দেশের জন্য ভাল হয় না । আবার দেশী বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে সরকারকে দিয়ে নানা প্রকল্প বাস্তুবায়ন করতে ব্যস্ত থাকে । শহরের কোন সমস্যার ব্যপারে তাদের হাতে যে আপাতঃ সমাধান আছে তাই বাস্তুবায়ন করতে তারা সরকারকে নানাভাবে উৎসাহ বা চাপ প্রদান করে থাকে । অনেক ক্ষেত্রে এসব সমাধানের একটি গ্রহন করা হলে তা নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দেয় । কিন্তু সেই সমস্যাগুলি দেখিয়ে দিলে প্রকল্প গ্রহন করার সম্ভাবনা থাকে না । তাই এসবের প্রস্তাবের উদ্দোক্তাগন সেগুলি সন্তর্পনে গোপন রাখে । যানজট সমাধানের জন্য প্রস্তাবিত এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, পাতাল রেল, উড়াল রেল ইত্যাদি এ ধরনের প্রস্তাব ।
যানজট সমাধানে নাইজিরিয়ার অভিজ্ঞতা ঃ
শহরে যানজটের কথা উঠলেই উদাহরন হিসেবে নাইজিরিয়ার কথা আসবে । এই লেখকের প্রায় ছয় বৎসর (১৯৮২-১৯৮৮) নাইজিরিয়ায় থাকার অভিজ্ঞতা আছে । যানজট সমাধানের জন্য নাইজিরিয়ায় যে সব ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে আজ যখন এদেশে সেসব ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বলা হয় তখন এবিষয়ে চাক্ষুষ এবং অন্যরকম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা অবাক না হয়ে পারেন না । আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সেদেশের প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই ।
নাইজিরিয়ার সর্ব দক্ষিনে সাগরের মধ্যে আছে বন্দর শহর ল্যাগোস, যা এক সময় ছিল দেশটির রাজধানী । উন্নত দেশগুলি তেল সমৃদ্ধ দেশটির সম্পদ আহরনের জন্য যেসব পন্থা গ্রহন করেছিল তার মধ্যে একটি ছিল দেশটিতে প্রচুর গাড়ী রপ্তানি করা। বলা হতো, “নাইজিরিয়ায় কুঁড়েঘর থেকে মার্সিডিজ বের হয়” । স্বাভাবিক ভাবেই এত গাড়ী যখন সারা দেশ থেকে রাজধানীতে আসতো তখন প্রচন্ড যানজটের সৃষ্টি হত । পশ্চিমা দেশের উপদেশের উপর নির্ভরশীল দেশটিতে এর পর সমস্যার সমাধানে একে একে আস্তে থাকে পশ্চিমা সমাধান ।
শহরের দক্ষিনে সাগরের মধ্যে আছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, ভিক্টোরিয়া আয়ল্যান্ড । পশ্চিমা দেশের সম্পদ ব্যবহার করে কিছু করা গেলেই তাদের লাভ । অতএব তাদের প্ররোচনায় ভিক্টোরিয়া আয়ল্যান্ড-এ গড়ে উঠলো সুউচ্চ ভবন (১৯৮৮ তে এগুলি ছিলো ৬০/৬৫ তলা), আর সেখানে সরিয়ে নেয়া হল রাজধানীর গুরুত্বপুর্ন অফিস আদালত । উল্লেখ করা যায় যে, ল্যাগোসের রাস্তা সাধারন ভাবে যে কোন এশিয়ান শহরের রাস্তার তুলনায় প্রশস্ত । তা সত্বেও যখন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার গাড়ী শহরের আভ্যন্তরীন প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ী দিয়ে ভিক্টোরিয়ায় যাতায়াত শুরু করলো তখন শহরে শুরু হলো প্রচন্ড যানজট । পশ্চিমা উপদেশ এল, তৈরী কর “এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে” । এ জিনিস আবার এমন যে একটি তৈরী করলেই আরো কয়েকটি তৈরী করা প্রায় বাধ্যতামূলক । ১৯৮৮ পর্য্যন্ত ল্যাগোসে তৈরী হয়েছিল ৪ লেভেলের এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে । “এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে” করার পরও যানজট কমে না, তাই প্রস্তাব এলো, একদিন পর পর বিকল্প (জোড়-বেজোড়) নম্বরের গাড়ী চলাচলের ব্যবস্থা কর। ফলে নতুন গাড়ীর বিক্রি বাড়লো এবং যানজট আরো বেড়ে গেলো । এর একটি কারন, বড় রাস্তায় কোন নম্বরের গাড়ী চলাচল করবে তা নিয়ন্ত্রন করা গেলেও ছোট রাস্তায় জোড়-বেজোড় নম্বর নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয় ।
এদিকে “এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে” তৈরীর ফলে রাজধানী ল্যাগোসের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে স্বল্প সময়ে যাওয়া সম্ভব হলো । কিন্তু কোন গাড়ীইতো আর এক্সপ্রেস ওয়েতে থাকবে না, বরং নীচে নেমে আসবে । তারা নীচে নেমে আসতেই শুরু হলো অভাবনীয় যানজট । আগে শহরের প্রবেশ পথ থেকে ভিক্টোটোরিয়া যেতে (ধরা যাক, ৪০ কিলোমিটার পথ ) যানজটের কারনে ৩ ঘন্টা লাগত। “এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে” দিয়ে (ধরা যাক) ৩০ মিনিটে এই পথ অতিক্রম করা সম্ভব হলো । এর পর নীচে এসে গন্তব্যে যাবার পালা । নীচে এসে ১ বা ২ কিলোমিটার পথ যেতে ৩ ঘন্টারও বেশী লাগে । এর কারন কি ? যে কোন শহরে সাধারন নিয়ম, বড় রাস্তার গাড়ী আগে যাবে এবং ছোট লেনের গাড়ী পরে যাবে । কিন্তু শহরে গাড়ীর সংখ্যা খুব বেড়ে গেলে (বিশেষতঃ যখন চলমান দুই গাড়ীর দুরত্ব ২০ ফুটের কম হয়) তখন এই নিয়মটি উলটে দিতে হয় । তখন নিয়মটি হবে, বড় রাস্তার গাড়ী ছোট লেনে কোন গাড়ী দেখলেই তাকে আগে যেতে দেবে, নিজে পরে যাবে । যারা এই অদ্ভুত (?) নিয়মটি বুঝতে পারছেন না তাদের অবগতির জন্য বলি, এটি করা না হলে ছোট লেনে যানজটের কারনে শহর অচল হয়ে যাবে । (আমাদের দেশের নগর পরিকল্পনাকারীগন এই বিষয়টি জানেন বা বোঝেন কি না আমার জানা নেই )। আর এ নিয়মটি প্রচলিত হবার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন চলবে কচ্ছপের গতিতে । যে কথা বলছিলাম, ল্যাগোস শহরের যানজট সমাধানে যখন সকল পশ্চিমা সকল সমাধান ব্যর্থ হবার উপক্রম হলো, তখনই বলা হল, রাজধানীর স্থান পরিবর্তন করতে হবে । সবাই জানেন, পরবর্তীতে নাইজিরিয়ার রাজধানী ল্যাগোস থেকে আবুজা-তে স্থানান্তর করা হয় এবং তার ফলে ল্যাগোস শহরের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় ।
জবাবদিহিতা এড়ানোর পন্থা, নাইজিরিয়ায় ও বাংলাদেশে ঃ
এখানে আমি সকলকে পশ্চিমা সমাধান প্রদানকারীদের ব্যবহৃত এবং উপরে বর্নিত “জবাবদিহিতা এড়ানোর পন্থা”টি বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করার জন্য অনুরোধ করব । নাইজিরিয়ার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ করে নিজেদের আখের গোছানোর সকল পন্থা বাস্তবে ব্যর্থ হবার পর যখন পশ্চিমা সমাধান প্রদানকারীদের জবাবদিহি করার কথা, তখনই তারা বিকল্প প্রস্তাব, নতুন রাজধানীর কথা বলে সবার চোখে ধুলো দিলো । “নতুন শহর, অনেক টাকার কাজ”, রাজনৈতিক নেতা সহ সকলেরইতো এমন প্রস্তাবে খুশি হবার কথা । জবাবদিহিতা এড়ানোর এ এক চমৎকার পন্থা ।
উপরে যে “পশ্চিমা সমাধান প্রদানকারী”-দের কথা বলা হয়েছে তারা কিন্তু আমাদের দেশেও সক্রিয় । আর বিদেশী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাপ্রাপ্ত আমাদের বিশেষজ্ঞদের অনেকে তো মূলতঃ তাদের স্বার্থ রক্ষা করেই উপদেশ দিয়ে থাকেন । আজ ঢাকাবাসী নানা সমস্যা নিয়ে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে । তারা অবাক হয়ে দেখছে যে, বিশেষজ্ঞদের দেয়া সমাধান তাদের সমস্যার সমাধান করার পরিবর্তে তা ক্রমাগতঃ আরও বাড়িয়ে চলছে । এ ক্ষেত্রে নাইজিরিয়ার উদাহরন মনে রাখা উচিত । সেই সঙ্গে এই সম্ভাবনাও বিবেচনা করা উচিত যে, সরকার ও বিশেষজ্ঞগন জবাবদিহিতা এড়ানোর জন্য পর্দার অন্তরালে ‘বিকল্প স্থানে রাজধানী” স্থাপনের প্রস্তাব তৈরী করছে কি না । এর মানে দাঁড়াচ্ছে – সরকার যখন বিশেষজ্ঞদের দেয়া সমাধান প্রয়োগ করে ঢাকার সমস্যার সমাধানের কথা বলছেন, নাগরিকগন যখন সুখের আশায় দিন গুনছে, বিশেষজ্ঞদের দেয়া একটির পর একটি পন্থা যখন ব্যর্থ হয়ে নাগরিক জীবন ক্রমেই আরো দুর্বিসহ করে তুলছে, তখন ভেতরের ব্যাপারটি এমন কি না যে, সরকারের একটি অংশ এবং কিছু বিশেষজ্ঞ ভেতরে ভেতরে এই ভেবে বেজায় খুশী হচ্ছে যে তাদের দেয়া ওষুধে কাজ হচ্ছে, “বিকল্প রাজধানীর প্রস্তাব দেয়ার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে” ।
শহরে যাতায়াত সহজ করার গুরুত্ব ঃ
একটি শহরে ব্যবসা, শিক্ষা, বিনোদন, খেলাধূলা ইত্যাদির যত ভাল উপকরণই থাক না কেনো, সবই ব্যর্থ হয়ে যায় যদি শহরের যাতায়াত ব্যবস্থা হয় ত্রুটীপূর্ন । আর ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থা এখন শুধু ত্রুটীপূর্নই নয়, রীতিমত অগ্রহনযোগ্য । নেহায়েত বাংলাদেশের মানুষের অন্য কোন দেশে চলে যাবার উপায় নেই, তাই তারা মুখ বুঝে সব সহ্য করে যাচ্ছে, সরকারকে অভিসম্পাত দিচ্ছে আর আগামী নির্বাচনে শোধ তোলার চিন্তা করছে ।
ত্রুটীপূর্ন যাতায়াত একটি শহরের সামগ্রিক কর্মকান্ডে এবং সমাজে কি ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলে এই প্রসঙ্গে তা আলোচনা করা যেতে পারে ।
(১) সাধারন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ঃ উর্ধতন ব্যক্তি তার অধঃস্তনকে বাইরে একটি কাজ করতে দিলেন। সে কাজটি করার জন্য সঠিক সময়ের অনেক আগে রওনা হয়েও কাজটি করতে পারলো না । কারন, যানজট । ঢাকা শহরে এখন যে ধরনের “চমৎকার (?)” যাতায়াত ব্যবস্থা আছে তাতে কাউকে লক্ষ টাকা দিয়ে অথবা ফাঁসির শাস্তির ভয় দেখিয়েও, কাজটি করা সম্ভব নাও হতে পারে, শুধুমাত্র অনির্ধারিত এবং মারাত্মক যানজটের কারনে । শুধুমাত্র একটি স্থানে কোন কাজ থাকলে, স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগে রওয়ানা হয়ে কাজটি করা সম্ভব হলেও হতে পারে । কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কাজগুলি এমন যে, একটি স্থান থেকে একটা কিছু সংগ্রহ করে সেটা অন্য কোন স্থানে নির্দি্ষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিতে হয় । এসব ক্ষেত্রে কি হওয়া সম্ভব ?
ঢাকার যানজটের একটি অত্যন্ত খারাপ দিক হচ্ছে, “সরকারের বহু অর্থ ব্যয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে প্রনীত যাতায়াত ব্যবস্থা”র ভুলের কারনে মানুষের কাজ পন্ড হবে, আর এটা যখন একটি সর্বজনবিদিত বিষয়ে পরিনত হবে, তখন মানুষের এই অসহায়তার সুযোগে বা অজুহাতে অনেক ফাঁকিবাজিরও জন্ম হবে । কিন্তু সব জেনে শুনেও যারা ফাঁকি দেবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করার থাকবে না । অন্য অর্থে, ব্যর্থতার কারনে কাউকে জবাবদিহি করার দিন শেষ হয়ে যাবে ।
(০২) শিক্ষাক্ষেত্রে ঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয় । ধরা যাক, পরীক্ষার দিন অনেক ছাত্র সময়মত আসতে পারল না কারন, প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ মাইল দূরে ২ ঘন্টার জন্য তাদের বাস আটকে ছিলো । ক্ষতিগ্রস্থ ছাত্রদের ক্ষতিপূরন কে করবে, অথবা তাদের রোষে প্রতিষ্ঠানটিতে ভাংচুর হলে তারই বা কি প্রতিবিধান হবে তা কারো জানা আছে কি ? বলা যায়, ছাত্ররা অনেক আগে, ভোর রাতে রওয়ানা হতে পারে । এটিও কোন সমাধান নয়, কারন ওই সময় যানবাহন নাও থাকতে পারে । আবার সবাই যখন ভোর রাতে রওয়ানা হবে, তখন ভোররাতেই যান জট হবে ।
(০৩) রোগ, দূর্ঘটনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঃ ত্রুটীপূর্ন বা বিভ্রান্ত যাতায়াত ব্যবস্থা এবং যানজটের কারনে রোগী, ডাক্তার বা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের যথাসময়ে যথাস্থানে পৌছাতে না পারার কারনে কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে তা সবারই জানা । সাধারন মানুষ যানজটের কারনে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে মারা গেলে সরকার কে অভিসম্পাত দেবে, প্রভাবশালী কেউ মারা গেলে ভাংচুর হবে । ফলাফল ? ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অনেক ভাল ভাল কাজ করেও নির্বাচনে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহন করবে ।
যান জটের কারনে বিলম্বের এই বিষয়টি যখন ‘সর্বজন বিদিত’ একটি ব্যাপার হয়ে দাড়াবে তখন “পাংচুয়ালিটি” বা সময়ানুবর্তিতা সমাজ থেকে কার্যত বিলুপ্ত হবে, সমাজ থেকে অনেক বিষয়ে জবাবদিহিতাও বিলুপ্ত হবে । সেটা যে একটি জাতির জন্য কত মারাত্মক তা ভাবাই যায় না । আমরা জানি না, ঠিক কোন সরকারের সময় জাতির ললাটে এই অভিশাপ নেমে আসবে । তবে এত গুরুত্বপুর্ন একটি বিষয়ে চরম ঔদাসীন্য দেখানোর জন্য বর্তমান সরকার অবশ্যই দায়ী থাকবে ।
সরকার কেন রাজধানী শহরের যাতায়াত সমস্যার সমাধান করতে পারছে না ?
প্রশ্ন হলো, আজকের যুগে একটি সরকার কেন রাজধানী শহরের মতন গুরুত্বপূর্ন একটি শহরের যাতায়াত সমস্যার সমাধান করতে পারবে না ? আসুন আমরা প্রশ্নটির জবাব খুজে দেখার চেষ্টা করি । উপরের প্রশ্নটির সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে নীচের যে কোনটি ঃ
(০১) সমস্যাটির কোন সমাধান নেই ।
(০২) সরকার সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছে না ।
(০৩) সমস্যার সমাধান সরকারের বা সরকারের অধীনস্থ বিশেষজ্ঞদের জানা নেই ।
(০৪) সরকার সমাধান চায়, সমাধান আছে, সরকার চেষ্টা করে, কিন্তু ভেতর বা বাইরে থেকে কেউ বাঁধা দেয় ।
এবারে আমরা একে একে উপরের উত্তরগুলি আলোচনা করবো ।
(০১) এযুগে যাতায়াত সমস্যার সমাধান নেই একথা কেউ বিশ্বাস করবে না ।
(০২) সরকার যেভাবে বিভিন্ন ঘোষনা দেয়, তাতে সরকার সমাধান চায় বলেই মনে করা যায় । তা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান না করলে সরকারের কি লাভ ?
(০৩) সমাধান সরকারের বা বিশেষজ্ঞদের জানা নেই প্রসঙ্গে বলা যায়, সরকারে যে জনপ্রতিনিধি থাকেন, আর তারা শিক্ষার যে ক্ষেত্র থেকে আসেন, তাতে তাদের সমাধান জানা না থাকারই কথা। বিশেষজ্ঞরা অবশ্যই সমাধান জানেন । তবে বিশেষজ্ঞদের বিষয়ে যে কথাটি অপ্রিয় সত্য তা হলো, তাদের অনেকের মৌলিক জ্ঞান বা দেশপ্রেমে ঘাটতি আছে ।
(০৪) “সমাধান আছে, সরকার চেষ্টা করে, কিন্তু ভেতর বা বাইরে থেকে কেউ বাঁধা দেয়” প্রসঙ্গে বলা যায়, যাতায়াত সমস্যা সমাধানে সরকার ইতিমধ্যেই কিছু ব্যবস্থা নেবার কথা বলেছিল । কিন্তু এগুলি কার্য্যকরী কি না তা বলা যাচ্ছে না কারন, সরকার এগুলি প্রয়োগই করতে পারে নাই। কে বাঁধা দিয়েছিল ?
সরকারের ভেতর থেকেই যে সরকারের ঘোষিত নানা কর্মকান্ডে বাঁধা দেয়া হয় তা আমরা সবাই জানি । দখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধার, বিপজ্জনক ক্যামিকালের গুদাম সরানো সহ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচী পালন কালে সরকারী দলের সাংসদরা কিভাবে তা প্রতিহত করে এসেছেন পত্র পত্রিকার দৌলতে তা আমাদের সবারই জানা । এটিকে বলা যায় “ভেতর থাকে বাঁধা”। আর বাইরে থেকে যে বাঁধা তাও আমাদের জানা । ঢাকা শহরের মেয়র এবং অধিকাংশ ওয়ার্ড কমিশনার এখন বিরোধী দলের । তারা জানেন, শহরের অবস্থা যত খারাপ হবে, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা তত কমবে । তাই নিঃখরচায় দলের এত বড় উপকার কেনো তারা করবে না ? সরকারী দলের সাংসদরা নিজ দলের স্বার্থ না বুঝলেও বিরোধীদল তা ভালই বোঝে ।
এটা এখন সবারই জানা যে, “আইন ভঙ্গ বা জনগনকে কষ্ট দিয়ে যারা আর্থিক সুবিধা লাভ করে থাকে তারা তাদের বাড়তি লাভ রাজনীতিক এবং সংশ্লিষ্ট আমলাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়” । এই বাক্যটি মনে রাখলে সরকারী কর্মসূচী কেন বারে বারে ব্যহত হয় তা বুঝতে কোন সমস্যা হয় না । দু একটি উদাহরন দেয়া যাক । ঈদ সামনে রেখে সরকার ঘোষনা করে, ফুটপাথ থেকে হকার সরানো হবে । জনগন তখনই বুঝে গেছে, ঈদের বিরাট ব্যবসা বজায় রাখতে হকাররা এখনই সরকার, আমলা বা রাজনীতিকদের সঙ্গে সমঝোতা করবে । দুদিন পরেই সরকার জানালো, ঈদের আগে উচ্ছেদ হচ্ছে না । জনগন বুঝে গেল, সমঝোতা হয়ে গেছে ।
যাতায়াতের উন্নয়নের জন্য সরকার বলল, আবাসিক এলাকা থেকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে হবে । এই কাজের ফলে যাদের আর্থিক ক্ষতি হবে তারা সরকারের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করল, সরকারের উদ্দোগ কমে গেল। সরকার বলল, বেবী ট্যাক্সীতে মিটার অনুযায়ী ভাড়া নিতে হবে । বেবী ট্যাক্সী মালিক চালকরা যথাস্থানে গিয়ে সমঝোতা করল । ফলাফল ? মিটার অগ্রাহ্য হলো, জনগনের খরচ বাড়লো, যাতায়াতের সমস্যাও থেকে গেলো ।
উপসংহার ঃ
ঢাকা শহরের যানবাহন সমস্যা বা যানজট সমস্যার কোন সমাধান দেয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয় । সরকারের দায়ীত্ব সরকারকেই পালন করতে হবে । এইটি সহ দেশের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করার জন্যই জনগন তাদের নির্বাচিত করেছে । সমাধানের ব্যয় নির্বাহ করার জন্য জনগন তাদের কষ্টার্জিত আয়ের অংশ ট্যাক্স হিসেবে সরকারের হাতে তুলে দেয় । দেশের প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তির মেধা বা শ্রম কাজে লাগানোর অধিকার ও ক্ষমতা সরকারের আছে । এর পর সরকার কেন যাতায়াত সমস্যার সমাধান করতে পারবে না ? আর জনগনই বা কেন দীর্ঘকাল সরকারের ব্যর্থতার ফল সহ্য করবে ?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………।
অধ্যাপক বিজন বিহারী শর্মা, ডীন, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদ, আহসানুল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ।